গ্রাফিক্স: শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 11th March 2025 22:17
২০২৫ সালে একজন মোটা মাইনের কর্মীর চাকরি চলে গেলে কী হতে পারে?
যদি তিনি হন আত্মান্বেষী, সংশয়বাদী এবং সংবেদনশীল, তাহলে চাকরি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর কোন কোন বিষয় স্রেফ গায়েব হয়ে যেতে পারে তাঁর জীবন থেকে?
কতটা ভেঙে পড়তে পারে তাঁর মনোবল?
স্মৃতির বিবর আর বিস্মৃতির কবর ফুঁড়ে কি উঠে আসতে পারে ছেলেবেলায় না-মেলা-অঙ্কের ব্যর্থতা? কারও কাছে শোনা, এতদিন আবছায়ায় রয়ে যাওয়া অপমানকর শব্দের ঝাঁক? ‘ওয়ার্থলেস’ কিংবা ‘এক্সপান্ডেবল’ বলেছিল কেউ, কোনওকালে… আচমকা কোন্ দমকা হাওয়ার টানে ভেসে এল তারা আর বিবশ করে তুলল শরীর… বিস্রস্ত করে দিল যাবতীয় মনোবল? সেই আগের মতোই?
এইসমস্ত প্রশ্ন আর বিস্ময়ের কারণ খুঁজতে চেয়েছে সোম লাহিড়ী; খুঁজতে চেয়েছেন শমীক ঘোষও, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অপদার্থ’-য়।
সোম আখ্যানের চরিত্র। একদিন আচমকা তার চাকরি চলে যায়। নিমেষে তোলপাড় ওঠে জীবনে। সেই তোলপাড় দশার অব্যবহিত বিবরণ দিয়েই উপন্যাস শুরু। গোড়াতেই বিরাট কোনও তত্ত্ব কিংবা আত্মিক সংকটের ক্যানভাস আঁকেননি শমীক৷ চাকরি হুট করে চলে গেলে মোটা টাকার মাসমাইনে পাওয়া একজন তরুণ ঠিক সেই মুহূর্তে কী ভাবতে পারে, উপন্যাসের প্রথম পাতায় সেই ভাবনার অলিন্দে আলো ফেলেছেন। এরপর পাকচক্রে কাহিনি এগিয়েছে। ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ি কেনার পার্সোনাল লোন, সংসারখরচ, মাকে টাকা পাঠানো… ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মিউচুয়াল ফান্ড, শেয়ার—যাবতীয় সাংসারিক ও জাগতিক বিষয়সংকট ধীরে ধীরে সামনে এসেছে। এই সংকটের চোরাটানে কখনও পথচারী, কখনও বা পুলিশ—অনেকের সঙ্গে তর্কাতর্কি, মারামারিতে লিপ্ত হয়েছে সোম।
কিন্তু এহ বাহ্য। এ এসবই বাইরের খোলস। উপন্যাসের উপরিতল। অধ:স্তলে বয়ে গিয়েছে আত্মিক সংকটের চোরাস্রোত। কখনও অস্ত্র ফ্ল্যাশব্যাক, যেখানে বাবা ফিরে এসেছেন কল্পনায়। চাকরিহারা সন্তানকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। জানিয়েছেন—জুটমিল লক আউটের জেরে সোমের জয়েন্টের টিউশানির খরচ তুলতে স্ত্রীর গয়না পর্যন্ত বিক্রি করেছিলেন তিনি। তারপর ছুড়ে দিয়েছেন প্রশ্ন: ‘সেই তুই নিজেকেই লক আউট করে দিলি সোম?’
সংকট ধাক্কা দিয়েছে স্মৃতিতে, আঘাত হেনেছে বর্তমানেও। ফিনান্স কোম্পানি থেকে যখন ফোন আসে, জানায় ‘লোন অফারে’র কথা, তখন সোম পুতুলের মতো, যন্ত্রের মতো বলে চলে: ‘আমার চাকরি চলে গেছে!’ হাস্কি গলার মেয়েটি টেলিফোনের ওপার থেকে জবাব দেয়: ‘স্যার! আপনি মজা করছেন স্যার।’ তারপর খানিক বেপরোয়া ভঙ্গিতে অনুরোধ জানায়: ‘স্যার! আপনি লোনটা না নিলে আমার চাকরি চলে যাবে, স্যার! আমাদের টার্গেট আছে।’
লোন আর কোনওভাবে প্রসেসড হয় না। ফোন কেটে যায়। তারপর রাইটিং প্যাডে লেখা হয়: ‘সোম লাহিড়ী—ভ্যালুয়েশন মাইনাস চুরাশি লাখ টাকা।’
২০২৫-এ মানুষের ভ্যালুয়েশনের সংজ্ঞা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন লেখক শমীক ঘোষ। এ যেন একুশ শতকের নির্মম বাস্তুতন্ত্র। যার খাদ্যশৃঙ্খলে বাঁধা প্রত্যেকের জীবন। কোম্পানির এইচআর হেড—সোম লাহিড়ী—এটুজেড ফিনান্সের মেয়ে… প্রত্যেকে এই পিরামিডের থাকবন্দি। একের বিপর্যয় প্রভাব ফেলে অন্যের বেঁচে থাকায়। টাল খায় কৌম-যাপন।
হয়তো তাই থানার লক আপে সোম যখন সার বেঁধে পিঁপড়েদের চলে যেতে দেখে তখন তার মনে হয়: ‘সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার হল পিঁপড়েরা একা-একা নিজেদের জন্য বাঁচে না। তাঁদের বেঁচে থাকা গোষ্ঠীর জন্য। কৌমের জন্য। তাদের সবার নির্দিষ্ট কাজ আছে।… আর শৃঙ্খলা মেনে এই কাজটুকু নিখুঁত ভাবে করে যাওয়াই তাদের জীবন। এর বাইরে তাদের নিজস্ব কোনও চাহিদা নেই। মতামত নেই।… পিঁপড়েদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় সোমের। তার মনে হয় পিঁপড়ে হয়ে ওঠাটাই মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সার্থকতা। তারপরেই খুব দু:খ হয় নিজেকে নিয়ে। কিছুই তো সে করতে পারল না। দেশের জন্য। সমাজের জন্য। এমনকী অফিসের জন্যও।’
জটিল চিন্তাস্রোত এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়ালেও এসে থিতু হয়েছে আন্তরিক আত্মধিক্কারে, অবসন্ন আত্মকণ্ডুয়নে: ‘অপদার্থ! আমি একটা অপদার্থ! সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে বলে উঠল সোম।’
উপন্যাসে আত্মসংকটকেই মুখ্য করে তুলতে চেয়েছেন লেখক। কিন্তু চেতনাপ্রবাহরীতিকে অবলম্বন করেননি। বদলে কথালাপের মাধ্যমটিকে বেছে নিয়েছেন। আখ্যানের চরিত্রেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে গেছে। অনর্গল। একে ‘সংলাপমুখ্য উপন্যাস’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু সেই কথোপকথন কোনওভাবে বিস্বাদ জাগায় না। বরং, খুলে দেয় আঁতের দুয়ার। যে দরজা এতদিন বন্ধ ছিল। একটা চমৎকার দৃষ্টান্ত লক-আপে পরিচয় হওয়া অবিরাম মিত্রের সঙ্গে সোমের আলাপ:
‘আরে মশাই। কত লোকের কত লোকের কত টাকা ধার আছে। সবাই বহাল তবিয়তে আছে। আর আপনি…’ (অবিরাম)
‘আমার মিউচুয়াল ফান্ড, শেয়ারগুলো… সব কিছুর দাম পড়ে গেছে!’ (সোম)
‘ধুর মশাই। সে তো সব কিছুই পড়ে যাচ্ছে। কেউ কি সেটা নিয়ে কান্নাকাটি করছে?’
‘কী পড়ে যাচ্ছে?’
‘মূল্যবোধ! টাকার দাম। সরকারি ব্রিজ…’
মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো আবার মাইক্রো—সমস্যার ফোকাসকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন লেখক। ব্যষ্টি আর সমষ্টির সংশয় ও সংকটকে তুলাযন্ত্রের দুটি পাল্লায় রেখে অবিরত মাপজোক চালিয়ে গেছেন।
আর এই ‘সেরিব্রাল সমস্যা’কে প্রকট করে তুলতে কখনও বিজ্ঞান কখনও দর্শন—কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ‘শ্রডিংগারের তত্ত্ব’ থেকে শুরু করে প্রোব্যালিটির ‘মন্টি হল প্রবলেম’—সুচতুরভাবে কাজে লাগিয়েছেন শমীক। সোমের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবিপর্যয়কে সামনে রেখে অনেকটা চেন রিঅ্যাকশনের মতোই নন্দিনী, সোহিনী, অভিলাষদের সমস্যাকেও নজরে আনতে চেয়েছেন।
উপন্যাসের ভাষা গতিশীল, নির্মেদ, ঝরঝরে। সংলাপ বাস্তবোচিত। আকছার ইংরেজি বাক্য এবং শব্দ প্রয়োগ করেছেন লেখক। কিন্তু সেসব কানে বাজে না। চরিত্রদের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে মেলালে যথোপযুক্ত বলে মনে হয়৷
বর্ণনা বিষয়াভিমুখ। দৃষ্টান্ত: ‘শেয়ার মার্কেট ওঠে। শেয়ার মার্কেট পড়ে। ব্যালকনির ওধার থেকে আকাশ ফুঁড়ে প্রতিদিন বেরিয়ে আসে একটা সূর্য। টপকে টপকে পেরিয়ে যায় বাড়িগুলোর মাথা। আবার ডুবে যায় ব্যালকনির ওধারে৷ দেখে সোম।’
পাশাপাশি চিত্রকল্পও প্রাসঙ্গিক, জোর করে পুরে দেওয়া নয়। একটি নমুনা: ‘খুব রুগ্ন একটা চাঁদ। পড়ে আছে আকাশের এককোণে। ভুগে ভুগে রোগা হয়ে গেছে। বেঁকে গেছে শিরদাঁড়া। ফ্যাকাশে মুখ করে দেখছে নীচের পৃথিবীটাকে। কালো কালো বাড়িগুলো। ফাঁকা রাস্তাঘাট। ঝিমন্ত রেললাইন।’
এই টুকরো খণ্ডচিত্রটিতে উপন্যাসের মূল সুর কোথাও যেন ধরা পড়েছে। শুধুই ব্যক্তিচরিত্রের বিপর্যয় নয়—এক রুগ্ন, ফ্যাকাশে, বেঁকে যাওয়া, ঝিমন্ত সময়েরও দলিল হয়ে উঠেছে শমীক ঘোষের ‘অপদার্থ’।