গ্রাফিক্স: শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 6th March 2025 16:20
দ্য ওয়াল ব্যুরো: একজন শিল্পীর জীবন কোথায় আলাদা? অনেকভাবে এর উত্তর দেওয়া যেতে পারে। একটা সম্ভাব্য জবাব: তাঁর যাপনে। শিল্পী, তিনি যে ক্ষেত্রের হোন না কেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় স্বতন্ত্র। একজন অভিনেতা তাঁর চরিত্রের মাপজোক নিয়ে মগ্ন থাকেন, নৃত্যশিল্পী মজে থাকেন কঠোর অনুশীলনে, চিত্রী বেছে নেন ক্যানভাসের পট আর একজন কণ্ঠশিল্পী বুঁদ হয়ে থাকেন রোজকার রেওয়াজে।
সেই জীবন ব্যক্তিগত, কখনও কখনও একঘেয়েও বটে। কিন্তু আর পাঁচজন মানুষের ছকবাঁধা রুটিনের দৈনন্দিনতা থেকে তা আলাদা হয়ে যায় শিল্পের নান্দনিকতায়। শিল্পীর রেওয়াজ, তা যতই নিয়মতান্ত্রিক হোক না কেন, ব্যাগ হাতে বাজারযাত্রী কেরানিবাবুর একঘেয়েমির চেয়ে এখানেই আলাদা। শিল্পের স্পর্শ আর দোকানের ফর্দের মধ্যে ফারাক আশমান-জমিনের।
তাই কোনও সংগীতশিল্পী যখন তাঁর ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণ করেন, আমরা আশায় থাকি, তিনি এমন এক সিন্দুক খুলবেন, যার গুপ্ত সম্পদ আমাদের জাগতিক বেঁচে থাকার তুচ্ছতাকে শিল্পের জাদুদণ্ডে আলোকিত করবে, তাকে নতুন মাত্রা এনে দেবে। এমন কিছু ঋষিবাক্য উচ্চারণ করবেন তিনি, যা সাধারণ পাঠকের অসতর্ক মুহূর্তের প্রহরী হয়ে উঠবে।
গায়িকা, সুরসাধিকা হৈমন্তী শুক্লার স্মৃতিকথন ‘এখনও সারেঙ্গীটা বাজছে’ এই প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করেছে। হৈমন্তীর লেখা, হৈমন্তীকে নিয়ে লেখা এবং তার সঙ্গে সাদা-কালো ছবির অ্যালবাম মিলিয়ে সুদৃশ্য বই, যা হাতে নেওয়ার আগে এবং হাতে নেওয়ার পর পাঠকের চোখ ও মন—দুই-ই জিতে নেয়। শিল্পীর অনুলিখনভিত্তিক সমস্ত রচনা। সম্পাদক অমিত মিত্র। প্রায় দেড় বছর ধরে অল্প অল্প করে হৈমন্তীর স্মৃতিসম্পুট সঞ্চয় করেছেন তিনি। মুখের কথাকে ধরে রেখেছেন কলমে। তারপর থরে-বিথরে সাজিয়ে দিয়েছেন দু'মলাটের অন্দরে।
ধারাবাহিক আত্মজীবনী লেখেননি শিল্পী। বরং, ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু বিগত মুহূর্ত জুড়ে তৈরি করেছেন এক অনুপম স্মৃতিস্তবক। সেই মুহূর্তে মিশে গেছে ঘটনা, মিলে গেছে মানুষ। বহু স্মরণীয় অনুষ্ঠানের ব্যাকস্টেজের ঘটনা যেমন ঠাঁই পেয়েছে, তেমনই বইয়ের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে রেকর্ডিংয়ের অ্যানেকডোট! একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও জনপ্রিয় শিল্পীর স্মৃতিচারণে তাঁর অনুরাগীরা তো এইসমস্ত লুকোনো ভাণ্ডারের সম্পদই দু'চোখ ভরে দেখতে চায়! প্রতিটি অধ্যায়ে সেই ঔৎসুক্যই বজায় রাখা হয়েছে, এমনকী নামকরণেও। ‘মা বলে ডাকতেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য’, ‘বোনের মতো আপন করেছিলেন আলি আকবর খাঁ সাহেব’, ‘মান্নাদা জুড়ে ছিলেন দাদার মতো করেই'—এই নামেই বিন্যস্ত গ্রন্থের সমস্ত অধ্যায়।
প্রথম লেখায় হৈমন্তী শৈশবের গল্প শুনিয়েছেন। একটি ছোট মোমবাতি জ্বালিয়ে বাবার নির্দেশ ছিল: ‘এটা যতক্ষণ জ্বলবে, ততক্ষণ তুমি প্র্যাকটিস করবে।’ খোলা চোখে মনে হতেই পারে এ এক কঠোর অনুশাসন। কিন্তু গানই যাঁর আজীবনের অনুধ্যান, তাঁর পক্ষেই বলা সাজে: ‘সেই থেকেই আমার গানের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়ে গেল।’ আর সেই সখ্যের পরিণাম: ‘আমার ছোটোবেলায় মেয়ে হয়েও কখনও পুতুলের বিয়ে বা পুতুলের সংসার এমন খেলা খেলিনি।’ খেলেছেন গায়িকা হওয়ার খেলা। দেশলাই বাক্সকে মাইক্রোফোন বানিয়ে সামনে পুতুলদের শ্রোতা হিসেবে বসিয়ে রেখে জলসা বাঁধতেন শিশুশিল্পী হৈমন্তী!
চিন্ময় লাহিড়ী থেকে আলি আকবর খাঁ। চলার পথে প্রত্যেকের থেকে শুধুই সুর নয়, সহবতেরও পাঠ নিয়েছেন। বাবা হরিহর শুক্লা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য। উত্তর ভারতীয়। অথচ স্ত্রী পাবনার। দুইয়ে মিলে পরিবারে হিন্দি মেশানো বাঙাল ভাষার অদ্ভুত কথাস্রোত বয়ে চলত। কৌতুকভরে তা উপভোগ করতেন হৈমন্তী। উগ্র সাজগোজ, জোরে কথা বলা বরদাস্ত করতেন না হরিহর। মেয়েকে সেভাবেই মানুষ করেছেন তিনি। হৈমন্তীর অকপট স্বীকারোক্তি: ‘ছোটোবেলা থেকে গানের তালিমের পাশাপাশি, মানুষ হওয়ার তালিমও আমি পেয়েছিলাম বাবার থেকেই।’
তান বেঁধে দিয়েছিলেন হরিহর৷ আকাশবাণীর শিশুমহলে তা আলো-ছায়া লাভ করে। সেখান থেকে গল্পদাদূর আসর এবং শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড। কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গানের নাম ‘এ তো কান্না নয় আমার’। সাল ১৯৭২। ওয়ান টেক ওকে দিয়ে রেকর্ডিংয়ের যাত্রাশুরু। সেই ছন্দোময় সফর বয়ে চলে আজীবন।
গ্রামের একটি অনুষ্ঠানে গাইতে গেছেন হৈমন্তী। সঙ্গী কিংবদন্তি মান্না দে৷ স্কুলবাড়িতে আয়োজনের তেমন ব্যবস্থা করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। একটু বিরক্তিভরেই তা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছিলেন হৈমন্তী। ঠিক তখনই নজরে পড়ে, বাইরের বেঞ্চিতে বসে মান্না দে ভাঁড়ে চা খাচ্ছেন। এতটুকু ক্ষোভ নেই। নেই কোনও হতাশাও। অনেক জমকালো কথার মধ্যে সেই আপাততুচ্ছ একটি দিনের স্মৃতি এখনও জেগে রয়েছে মনে। রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—‘সেদিন শিখেছিলাম, যত বড়ো শিল্পীই হও না কেন, সহজ হতে হবে। সবার মাঝে থাকতে হবে।’
অধ্যায়ের নাম ‘কোনো রটনায় কান দেয়নি হেমন্ত-হৈমন্তী জুটি!’ শিরোনামে গসিপের ছোঁয়া থাকলেও সচেতনভাবে তা এড়িয়ে গেছেন শিল্পী। ‘কোনো এক কারণে আমার সঙ্গে সমস্ত রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন হেমন্তদা’ লিখেই প্রথম বন্ধনীতে হৈমন্তী জুড়ে দেন ‘যে কারণ আজও আমার জানা নেই!’ ব্যক্তিগত সম্পর্কের অন্তর্ঘাত, হিংসা-বিদ্বেষকে না মনের খাতা, না বইয়ের পাতা কোথাও তিলার্ধ জায়গা দেননি তিনি। সহ-শিল্পী, বরিষ্ঠ শিল্পী ও অনুজ গায়ক-গায়িকাদের সখ্য ও সংসর্গের যে আলেখ্য এঁকেছেন হৈমন্তী শুক্লা, তা তাঁর হাসির মতোই প্রাণবন্ত, শুচিস্মিত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মনান্তরের কিসসা শোনানোর বদলে তিনি লেখেন: ‘উনি অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য অ্যাডভান্সে কখনও হাত দিতেন না… কোনো কারণে অনুষ্ঠান না হলে আয়োজকদের ফেরত দিতেন ওই অগ্রিম অর্থ। আমিও এটা করতে শিখেছি হেমন্তদাকে দেখে। আমিও মনে করতে শুরু করলাম, অ্যাডভান্সের টাকা আমার টাকা নয়। গান হয়ে যাওয়ার পর ওটা আমার টাকা হল।’ প্রশ্ন জাগে: এই শিক্ষা এখনকার কতজন শিল্পীর রয়েছে? আদৌ রয়েছে কারও?
এমনই টুকরো টুকরো রুচি, কৌলীন্য, আভিজাত্য, পেশাদারিত্ব ও সভ্রমের দ্যুতিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সুরজিৎ সেনগুপ্ত থেকে কবীর সুমন। প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য ও সৌহার্দ্যের ছায়ালোক নির্মাণ করেছেন হৈমন্তী। নিরাভরণ সাজ। অথচ প্রবলভাবে আন্তরিক। আর এখানেই এই স্মৃতি-আলেখ্যর আসল জয়৷ তা সৎ, অকপট। ভাষায় বিভ্রমের মায়া জন্মায়, কখনও বিভ্রান্তির জন্ম দেয় না।
প্রকাশনা সংস্থা মান্দাস যত্ন নিয়ে বইটি নির্মাণ করেছেন। তবু প্রকাশক প্রুফরিডিংয়ে আরেকটু যত্ন নিতে পারতেন। তাহলে হয়তো বাগেশ্বরী (শুদ্ধ: বাগীশ্বরী), রজঃশলা (শুদ্ধ: রজঃস্বলা)-র মতো পরিচিত বানানভুল, ঊর্ধ্বকমার এলোমেলো ব্যবহার এড়ানো যেত। বাকি প্রোডাকশন এতটাই নিখুঁত যে, এই আপাততুচ্ছ ভুলচুকগুলো প্রকট ত্রুটি বলে মনে হয়!
'এখনও সারেঙ্গীটা বাজছে': হৈমন্তী শুক্লা
প্রকাশক: মান্দাস