মৃণালিনী
বর্তমান সময়ে যখন করোনার থাবা আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও সম্পর্ক, দিনের আলোয় রাস্তাঘাট থেকে খোলা মাঠে অদ্ভুত নিস্তব্ধতার ছায়া, নিউ নর্মাল লাইফে নিজেকে মানিয়ে নিতে বাধ্য মন, ঠিক তখন অন্ধকারের সুর চিরে বেরি
বর্তমান সময়ে যখন করোনার থাবা আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও সম্পর্ক, দিনের আলোয় রাস্তাঘাট থেকে খোলা মাঠে অদ্ভুত নিস্তব্ধতার ছায়া, নিউ নর্মাল লাইফে নিজেকে মানিয়ে নিতে বাধ্য মন, ঠিক তখন অন্ধকারের সুর চিরে বেরিয়ে আসে মন মাতানো উদাসীন বাউল সুর, কবিতার সুর। কবি অভিজিৎ পালচৌধুরীর লেখা "নিঃসীম উদ্যানের অর্কেস্ট্রা" বইয়ের প্রত্যেকটি কবিতায় অন্ধকার ও আলোর চিরচেনা সুর যেন পাশাপাশি খেলা করছে।
প্রথম কবিতায় তিনি লিখেছেন, "শূন্য-বাঁচার ফানুস জ্বেলেছ সবাই / বিপরীত ঘিরেছে সময় আকণ্ঠ/ কোন অশ্বারোহী নেই, দুর্বার/ নগ্ন তরবারি, হাসে গুপ্ত ঘাতক" ঘাতক ভাইরাসের আতঙ্কে আতঙ্কিত মাছকে বলেছেন, "শূন্যতার তারল্যে ডুবে আছ মাছ/ রক্তের ওম খেয়েছে হিম ভালোবাসা/ তবুও একবার লাফ দাও, ওগো মাছ/ ছিঁড়ে ফেল অন্তহীন মায়া তন্তুজাল" 'শূন্য'তাকে অনুভব করা সম্ভব নয় তবে 'দূরত্ব' দিয়ে কিছুটা হলেও অনুভব যেতে পারে। স্বাভাবিক জীবন যে বদলে গিয়েছে, নিউ নর্মাল লাইফে শূন্যতার সঙ্গে স্বাভাবিকতার যে দূরত্ব তা আরও পরিষ্কার হয়েছে, দুঃখকে "হীন মনে হয় দুঃখের অতলান্তে/... বেঁচে থাকার দায় বাড়ে সুখের পাথর ভেঙে"
সমসময়ে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং অদ্ভুত জীবনযাপনে অনভ্যস্ত মনের কথা উঠে এসেছে কবিতায়, "নিবৃত্তি/ দাও ক্ষান্ত এবার/ প্রবৃত্তি ঘোরাও মুখ / জীবন বড় বিচিত্র এক/ মুহূর্ত বাঁচার সুখ ( খেলা যখন...) প্রকৃতির কাছে মানুষের জীবন খেলাই তো, মানুষ চাইলেও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে পারে না, সে নিজের মধ্যে এক অন্ধকারকে লালন করে, উদযাপন করে, "এক গভীর অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছি আজীবন/ আরও গাঢ় কোন আঁধারের খোঁজে" কিন্তু অন্ধকার শেষে যে "ভোর হয় কোথাও"। কবিতায় অন্ধকার উঠে এলেও বিষণ্ণতা, অবসাদ মুহূর্তের জন্য মনকে আচ্ছন্ন করলেও একটি ক্ষীণ আলোর রেখা থাকবে, আলো থাকবে কোথাও না কোথাও কারণ অন্ধকারের কোন ছবি হয় না, কোন মুখ আঁকা সম্ভব নয়।
"নীলিমাহীন নৈরাজ্য এক/ নিঃস্ব মনোভূমি" অথবা "ছিন্নভিন্ন হতে হতে / নতুন আমি-র জন্ম দিই প্রতিদিন...বিচ্ছুরিত অলৌকিক মুদ্রায়/ বৃষ্টির নুপূরে/ বাজতে থাকি খুব। (বোধ) " কবি তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে যে পর্যবেক্ষণ করেন তা অনুভূতির শব্দ রূপে প্রকাশ করেন। পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির পুনরাবৃত্তি সম্ভব হয়না বলেই একটি কবিতা আরেকটি কবিতা থেকে আলাদা হয়ে উঠে। তার সুর ছন্দ শব্দ অর্থ ভিন্ন। অভিজিৎ পালচৌধুরীর এই কবিতার বইয়ে রয়েছে ছন্দের দোলা আবার কখন গদ্য ছন্দে লেখা, "হঠাৎ আমার ভেতরের একাকীত্বটা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বসল তার পায়ের কাছে। অমনি সহস্র ঘাসের পালক দুলে... নাম না জানা সাদা ফুল ফুটে উঠল নক্ষত্রের মতো আমার একাকীত্বের চারপাশে। দেখলাম একাকীত্ব, লাবণ্যপ্রভা, ঘাসের পালক... রূপোলি পাখিদের পিছু পিছু...( পথিক) "রাতভোর বৃষ্টির চাদরে ঢেকে যাক আমার লাশ...ঘাস উঠুক...ফুল ফুটুক...আমার লাশ ফুঁড়ে...সবুজের নিশান উড়িয়ে ( ফেল্টহ্যাম পার্ক), শব্দ অপরিমেয় অর্থ, অর্থ অ্যাবসার্ড না হলেও অনুভূতির গভীরতায় শব্দশূন্য বোধের সৃষ্টি করে যাকে নৈঃশব্দ নীরবতা বলা যেতে পারে। বেশ কয়েকটি কবিতায় তা সুস্পষ্ট, ইচ্ছে, যাপন, জিহাদ, বোধ, বিরহী, টু-বি-এইচকে সম্পর্কতে।
আবার মানুষের আকাঙ্খিত "ভালোবাসাবাসি শেষ হলে"তে ফিরে এসেছে সেই অন্ধকারের কৃষ্ণগহ্বর, সব রঙ মিলেমিশে সর্বস্বান্ত, লুপ্ত, তখন শব্দকে চিনতে হয় দৃষ্টি দিয়ে, "দুঃখ ভেসে যায়/আনন্দ /ভালোবাসাও/ঘরে ফেরা নেই আর/বালিয়াড়ি ভেঙে / শুধুই হেঁটে যাওয়া / নিঃস্ব হয়ে / নদীর কাছে / ভালোবাসাবাসি শেষ হলে" কবি উপলব্ধি করেছেন, আমি পতন জেনেছি উত্থানের চূড়ায়/...এই পাথর স্থবিরতায়/ তাই আঁকি/ আত্মাহুতি / বিষাদমূলে"। এই বিষাদ, এই উপলব্ধি অন্তরে নিবিষ্ট আনন্দময় চেতনার যা শব্দকে তার চিরপরিচিত অর্থের গন্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে যান পাঠকের নিজস্ব অনুভূতিপুঞ্জে, কারণ কবি যখন কোন দৃশ্যকে শব্দরূপ দেবার জন্যে প্রস্তুত হন, তিনি যুক্তিবিন্যাস, শৃঙ্খলার বাইরে অবস্থান করেন, " মধ্যরাতে শপথ নেয় / এই জন্মের সভ্যতাকে/ জন্মান্তরে পাঠাবে বলে/ ভোরের আলো ফুটলে" অথবা "দু-একটা বিছুটি শব্দ / কখন কবিতা হয়ে / ঘাই মারছে।"
তাই, কবি অভিজিৎ পালচৌধুরীর কবিতা সমসময়ের চিত্র ছাড়িয়ে সুদূর ভবিষ্যতের আলো দেখাতে পারে, অন্ধকারের পাশাপাশি হেঁটে চলছে আলো। " নিঃসীম উদ্যানের অর্কেস্ট্রা" বইটিতে ছন্দ এবং ছন্দ ভেঙে বেরিয়ে আসবার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকটি কবিতা থেকে বিচ্ছুরিত আলোর সুর, যে সুর একে ওপরকে ছাড়িয়ে যেন স্বতন্ত্র। পাঠক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির মূল্য একশো পঞ্চাশ টাকা।