শেষ আপডেট: 2nd April 2022 10:37
অদিতি বসুরায়
(৫)
অনেকেই বলে, মেয়েদের অবস্থান নাকি আমাদের এখনকার সমাজে অনেকখানি এগিয়েছে- আমাকে দেখে যাক তারা। সারা জীবন শুধু মেয়ে বলে আমাকে যা যা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। মনে পড়ে, সেদিন আমার হাতে মাত্র কুড়িটি টাকা। ওই-ই শেষ সম্বল। তাই রণোর ঠাকুমার দেওয়া খামটা যেন আমার কাছে তখন বেঁচে থাকার ছাড়পত্র। কী করে ‘না’ বলি? ওই টাকা দিয়েই সে রাতে আমরা মা-ছেলে মাখন দিয়ে আলু-ভাতে ভাত খাই। পর দিন বাজার থেকে আলু, পেঁপে, চাল, বিস্কুট, মুড়ি আর চা কিনেছিলাম। আজও মনে আছে, তিনদিন পরে নিজের ঘরে বসে চা খেয়েছিলাম সেদিন! (Bengali Novel)
রণো বড্ড কষ্ট করেছে আমার সঙ্গে। ওর মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হত আমার! ছেলের তবু কোনও বায়না ছিল না। কান্নাকাটি ছিল না। তার শুধু মাকে চাই। ব্যস। আমি রান্না করলে, কাছটিতে চুপ করে বসে খেলত। সেরকম খেলনাও ছিল না ওর। বাবার রঙের প্যালেট, ফাঁকা রঙের শিশি, তুলি, ফাটা বল, ভাঙা গাড়ি– এইসব ছিল ওর খেলার সরঞ্জাম। গান শেখাতাম যখন, তখনও বসে থাকত কোলের কাছে। ফারহানের মায়ের দেওয়া টাকায় ছেলেকে কয়েক দিন ভাত দিতে পারলাম পেট ভরে।
কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা তো অশেষ কিছু নয়। ফুরিয়ে যাবেই এক সময় - আর গেলও তাই। ফের শুরু হল আমাদের আধপেটা খাওয়ার দিন! পাশের বাড়ির রত্নামাসীমা যথেষ্ট সাহায্য করতেন। কিন্তু মুখ ফুটে কি খাবার চাওয়া যায় ? আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষরা যখন নিম্নবিত্ত হতে হতে একেবারে শূন্য হতে থাকে– তখন তাদের মনে হয় আত্মহত্যা ভিন্ন উপায় থাকে না। ফারহানের বন্ধু-বান্ধবরা এসে সামান্য দু-একশো টাকা দিয়ে ওর আঁকা ছবি– কিছু কিছু করে নিয়ে যেতে লাগল এবার। সে সব বিক্রি করে খুব বেশি টাকা পাওয়া যেত না। তবু তারা আমাকে যখনই যা পেত– দিয়ে যেত। আমার গানের টিউশুনির সামান্য উপার্জন! সব মিলিয়ে, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন অবস্থা! আক্ষরিক অর্থে সেই সময় চোখে অন্ধকার দেখছিলাম! সেই অন্ধকারের মধ্য থেকেই আবার রাজ এগিয়ে এল! ওর সঙ্গে আবার দেখা হওয়াটা আদতে নিয়তিতাড়িত ব্যাপার!
“কী গো, চা দেবে নাকি আমি করে নেবো?” – রাজ ডাকছে। ঠিক সকাল সাতটা বাজে। ও ঘুম থেকে ওঠে সাড়ে ছ’টায়। আগে আমি ডেকে দিতাম। ইদানীং ওর ঘুম আসতে খুব দেরি হয় বলে আর ডাকি না! তবে একবার ঘুম ভেঙে গেলে ডাকাডাকি করে মাথা খারাপ করে দেয়! আগে চাই, চা। সেই চা আমাকেই বানাতে হবে। সকালে আমার হাতের চা ছাড়া রাজের চলে না। মুখ ধুয়ে, মিনিট পনেরোর মধ্যেই চা নিয়ে বসি আমরা। আমার এটা দ্বিতীয় কাপ এই বারান্দাতেই। মাঝে মাঝে ছেলেরাও থাকে। শমী অবশ্য চা খায় না। সে কফি-ভক্ত। বীরভূমের তীব্র গরমে যখন ও তারিয়ে তারিয়ে গরম কফি খায়, দেখে আমারই ঘাম হতে থাকে। তাছাড়া এই আবহাওয়ায় নাকি গরমকালে কফি খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো নয়। আমি, রাজ, রণো শীতকাল ছাড়া কফি খাওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। রাজ আবার চায়ের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। এখন বাড়িতে যে চা-টা খাওয়া হচ্ছে,সেটা খাস দার্জিলিং-এর বাগান থেকে আনা অরেঞ্জ পিকো। ওর এক ছাত্রের বাবা এটা এনে দেন আমাদের। রাজের সঙ্গে আমার জন্যেও এক কাপ বসালাম।
এবার দিন শুরু হবে। এক এক করে কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে বেরিয়ে যাবে বাপ-ছেলে। হরির বউ ভাত গলিয়ে ফেলে মাঝে মাঝেই। রাজ একেবারে নরম ভাত খেতে পারে না। দেখা দরকার ওদিকে কী অবস্থা!
রণো কি উঠবে না? গান নিয়ে বসবে না আজও?– আমার রোজের টেনশন এই নিয়ে।
রাজ চা নিয়ে আসার জন্যে ডাকছে। ডেকে সাড়া না পেলে, ও অস্থির হয়ে যায় একেবারে!
কাল রাতে রাজকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু ও একটু দোনামনা করছে! এই সময় লম্বা ছুটি নেওয়া মুশকিল কলেজ থেকে। নতুন সেশন শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে। আমি সবই বুঝি কিন্তু ছেলের ব্যাপারে যুক্তি মানতে ইচ্ছে করে না একদম। তাই সে প্রসঙ্গ তুলতেই হল আবার !
-আজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে মনে করে খোঁজ নিও।
-কিসের খোঁজ?
-উফ। কাল রাতে বললাম যে? বেড়াতে যেতে হলে ছুটি লাগবে তো। বললে যে আজ গিয়ে জানতে পারবে! মনে থাকে না বাড়ির ব্যাপার বলে, তাই না?
-ও হ্যাঁ। সে তো মনে আছে। কেন থাকবে না? দেখা যাক! তবে শোনো, এখন তো নতুন সেশন শুরু হওয়ার টাইম, এখন ছুটি নেওয়া প্রায় অসম্ভব। প্লিজ একটু বোঝো। তার ওপর এই বর্ষা-বাদলে পাহাড়ে যাওয়া মারাত্মক ঝুঁকির ব্যাপার।
-তার মানে, যাওয়া হবে না – তাই তো?
-যা বল্লাম তার মানে কী এই হলো তোমার কাছে?
-যা বোঝার ঠিকই বুঝে নিয়েছি। বাদ দাও।
-মোটেও ঠিক বোঝোনি। আচ্ছা, ইরু, তুমি যদি না বোঝো কী করে হবে, বল? এভাবে ভেবো না, প্লিজ।
এর উত্তরে আর কি-ই বা বলার থাকতে পারে? আজকাল ছোটখাটো ব্যাপারেও আর ‘না’ শুনতে পারি না। কিন্তু উপায় তো নেই। আমার ইচ্ছের তোয়াক্কা কে আর কবে করেছে! সব ‘বোঝার’ দায় আমার ঘাড়ে দিয়ে সবাই নিশ্চিন্তে থাকে।
ফারহান নিজে কোনও রকম ধর্মীয় আচরণ পছন্দ করত না, পালন করা তো দূরের কথা। কিন্তু আমি যদি সিঁদুর পরতাম– রেগে যেত। মুখ ভার করে থাকত। যে ধর্মই মানে না, তার কাছে তো সিঁদুরের গুরুত্ব থাকারই কথা নয়। আমি সাজতে ভালবাসতাম বলে মাঝে মাঝে সিঁদুর পরতাম তখন। ফারহান একদিন স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আমার সঙ্গে থাকলে সিঁদুর পরবে না।
-কেন? আমি তো সাজের জন্য পরি।
-না। পরবে না। আমি তো তোমাকে নাকফুল পরতে বলিনি। তবে তুমি কেন সিঁদুর পরবে? সাজের সঙ্গে সিঁদুর যায় নাকি? কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়েদের সাজে সিঁদুর থাকে। তোমার কেন তা থাকবে?
কে বোঝাবে, এভাবে তুলনা করার ব্যাপারটাই ধর্মকে প্রশ্রয় দেওয়া। তাছাড়া আমি কী চাই– তা ফারহান জানার দরকারই মনে করেনি। রাজও না।
রাজ সাধারণত বলে থাকে, তোমাকে স্বাধীনতা দিলাম, ইচ্ছে মতো থাকবার। আচ্ছা, স্বাধীনতা কি একজন, অন্যকে দিতে পারে? স্বাধীনতা তো আমাদের জন্মকবচ। প্রত্যেকে নিজের স্বাধীন সত্তা নিয়েই জন্মায়। এরা আসলে এমন পরিবেশে এমনভাবে বড় হয়েছে যে মেয়েদের ‘কমোডিটি’ ছাড়া ভাবতে পর্যন্ত শেখেনি।
দীর্ঘদিনের জীবন তো এভাবেই কাটিয়ে এলাম। অনেক অ্যাডজাস্ট করতে হয়েছে। রাজের মা খুব ভালবাসতেন আমাকে। ছোটবেলা থেকেই চিনতেন। কিন্তু উনিও বিয়ের পরে বলে দিয়েছিলেন, লোহা বাঁধানোটা হাতে রেখো। তা না হলে রাজের অকল্যাণ হবে। সামান্য এক খণ্ড লোহার এতো ক্ষমতা, যে একজন মানুষের কল্যাণ–অকল্যাণ নির্ধারণ করতে পারে? এ নিয়ে কথা বলতে গেলে, মা অখুশি হতেন। আমিও তাই কথা বাড়াতাম না। গুমরে থাকতাম। বুঝতে পারি, এখন বড্ড জেদ হয়েছে আমার! বড্ড রাগও।
রাজ, শমী খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে যেতে, কাপড় ভেজালাম। মালতি এসে বকুনি দিল।
-কি যে হয়েছে তোমার বউমণি! এই বাদলার দিনে কেউ এতো জামাকাপড় কাচে নাকি?
-ওমা যাহ্! মেঘ এতো ভারি হয়ে এসেছে খেয়াল করিনি তো! কি হবে এখন?
-সরো। ঘরে যাও। আমি দেখছি।
মালতিই এসব সাংসারিক ঝামেলায় আমাকে বাঁচায়। সে আমার অনেকদিনের রক্ষাকর্ত্রী। আসলে রণোর হাসিমুখ দেখে মনটা একেবারে পালকের মতো হালকা হয়ে উঠেছে যে মাথায় ছিল না আর অন্যকিছু।
অঙ্কন: সৌজন্য চক্রবর্তী