শেষ আপডেট: 15th October 2022 13:36
(১৪)
মেয়েটা জানত সে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে, বাবার বন্ধুর খামার বাড়িতে। শহর থেকে দূরে। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিয়ে দিতে। বাবার বন্ধুর সঙ্গে। লোকটি লম্পট এবং কামুক। তার চেয়ে তিরিশ বছরের বড়। বাবা অনেক টাকা ধার করেছিল তার কাছ থেকে। শোধ দিতে না পারায়, মেয়ে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায়। থেকে যেতে হল মেয়েটিকে, সেই অজ পাড়াগাঁয়ে। স্বামী ও অশীতিপর শাশুড়ি সারাদিন গঞ্জনা দেয়। আঠারো বছরের মেয়েটি খামারের রাখালের সঙ্গে বনে বনে ঘুরতে লাগল। লুকিয়ে। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন তারা জোনাকি দেখতে বের হয়। একদিন মিলন হল তাদের। গর্ভবতী হল মেয়েটি। স্বামী আনন্দে আত্মহারা। বংশরক্ষার আনন্দ সেলিব্রেট করতে, সে রাতে দাসীকে নিয়ে এল ঘরে। সম্ভোগে লিপ্ত হল, স্ত্রীর সামনেই। আর কী আশ্চর্য, এবার দাসী গর্ভবতী হল তার ঔরসে।
দিন যায়। স্ত্রী ও দাসী একসঙ্গেই জন্ম দিল দুই পুত্রের। বড় হতে লাগল তারা। লোকটির স্বভাব বদলায় না। এক বসন্তের রাতে, মেয়েটি জানতে পারল, তার প্রেমিক যে রাখাল ছেলে— তার বাবাও তারই স্বামী। আর পারল না সে! দাসীকে ডেকে খুলে বলল সব। লোকটি শুনল আড়াল থেকে মেয়েদুটির কথা। মারতে এল বন্দুক নিয়ে। স্ত্রীও প্রস্তুত ছিল। বসিয়ে দিল আমূল শলাকা বুকে। গলগলিয়ে রক্ত। ছবি শেষ...
এই পোলিশ ছবিটি দেখতে গিয়ে তিথির সঙ্গে আলাপ হয় আমার। আগে ওকে একদিন দেখেছিলাম, কলেজের সঙ্গীত বিভাগের সামনে। ছোট করে ছাঁটা চুল। ঝকঝকে মুখ। হলুদ লং স্কার্টের সঙ্গে এমন সুকুমার মুখ যে দেখে মনে হয় তেরো-চোদ্দ বছরের কিশোরী। সদ্য ফোটা ফুলের মতো। আমি ক্যান্টিনে যাচ্ছিলাম। কলেজ বিল্ডিং-এর সামনে দুপুরের সিল্যুয়েটে মেয়েটি ফুটে উঠেছিল। মনের ভেতর থেকে গিয়েছিল ওই মুখ। দিন তিনেক পর গীতাঞ্জলিতে সিনেমা দেখতে গিয়ে দেখি, সে মেয়ে পাশের সিটে। সবুজ-সাদা লং ফ্রক সেদিন। কাঁধে ক্যাম্বিসের ঝোলা। ছবি শেষ হতে দেখি, রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। সঙ্গে মৃদু ফোঁপানির আওয়াজ। (Bengali Novel)
আমি, অভি আর সারা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। স্টুডেন্ট ফেডারেশনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমি রোজই যেতাম। যাইও। অনেক বিদেশি ছবি দেখানো হয়। অন্য সময় যেগুলো দেখার সুযোগ মেলে না। অভি আর সারার আ্যফেয়ার বহুদিনের। ওরাও আমার মতো সিনেমার পোকা। একেবারে ‘মুভি বাফ’ যাকে বলে। তিথি, সারার বন্ধু। ওরা দুজনেই অন্য জেলার মেয়ে। শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছে। অভি, আমার ছোটবেলার বন্ধু। এখানকার ছেলে। সারা এগিয়ে এসে জানাল— এই তিথি, এ হল রণদীপ। সঙ্গীত ভবনের রাজর্ষি স্যারের ছেলে।
এই এক ঝামেলা। আমার যেন কোনও আইডেনণ্টিটি থাকতে নেই। সারাক্ষণ কেবল ‘রাজর্ষি স্যরের ছেলে’ শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। তিথি বলে উঠল, স্যারের ছেলে তো কী হয়েছে? আমি রণদীপকে দেখেছি সেদিন ক্যান্টিনে। ও তো দুর্দান্ত গান গায়। আর কী সব কঠিন কঠিন বই পড়ে। বাবা রে!
— তুমি জানলে কী করে?
— পরশু লাইব্রেরিতে যখন বই ইস্যু করাচ্ছিলে, আমি ছিলাম তো।
— কোথায় ছিলে? দেখিনি তো!
— তোমার একটু পেছনে। তাই খেয়াল করোনি।
— চলো, চা খাওয়া যাক। সারা, তোরাও চল।
সারা বলল, এই... আমার একটু কাজ আছে। আমি কাটছি। তোরা চা-ফা খা। অভি থাকবি না যাবি?
অভি ঘাড় নেড়ে সায় দেওয়ায় ওরা দুজন চলে যায়। সারা আর অভির অ্যাফেয়্যারের কথা সবাই জানে। আমরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে কলাভবনের সামনে থেকে চা কিনে ওখানেই দাঁড়াই। তিথি লাইটার বের করে জানতে চায়, 'চলবে?' তখন আমার চলত না। সিগারেট ধরায় ও। টুকটাক কথা হয়। বাড়িতে কে কে আছে। কেমন লাগছে কলেজ ইত্যাদি। মিনিট দশেক পরে, ও চলে যেতে, মনে মনে হায় হায় করে উঠি। ফোন নম্বর নেওয়া হয়নি যে!
অস্থির লাগতে থাকে বড়। সারাকে ফোন করি। সে ব্যস্ত বোধহয়। ফোন বেজে যায়। ‘তিথির নম্বর দে, প্লিজ’... হোয়াটসঅ্যাপ করে রাখি ওকে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ইচ্ছে করছিল সেদিন। সাইকেল নিয়ে যাইনি বলে হাঁটছিলাম। ক্লান্তিতে ঘুম পেয়ে যাওয়ার আগের মুহুর্ত অবধি হেঁটেছিলাম সেদিন। এর মধ্যেই সন্ধে সাতটা নাগাদ পিং করে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রিপ্লাই এল। তিথির নম্বর। সারা পাঠিয়েছে। আহা শান্তি! শান্তি!
বাড়ি ফিরে এলাম। মা আর শমীর সঙ্গে আড্ডা দিলাম খানিক। বাবাই বাড়ি ছিল না। দিল্লি গিয়েছিল পরীক্ষা নিতে। যেমন প্রায়ই যায়। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সেদিন সোজা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। না, তিথিকে ফোন করিনি। মেসেজও নয়। পরের দিন সকালে ফোনটা এল।
— রণোদীপ, তিথি বলছি। আজ কী আসছ, সিনেমা দেখতে?
— আজ? কী ছবি?
— আজ ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখাবে।
— বাংলা ছবি দেখায় না তো!
— এবার স্পেশালি দেখানো হবে। আসবে কি?
— কটার সময় ?
— চারটে থেকে শুরু।
— আচ্ছা। আসব।
— ওকে। দেখা হচ্ছে।
— তুমি একটু আগে এসো।
— কেন?
— আগে এলে পাশাপাশি সিট পাবো।
— ঠিক আছে।
সেই শুরু।
চমৎকার সময় কাটতে লাগল আমাদের। সিনেমা থেকে সম্পর্ক— কতকিছু নিয়েই না কথা বলতাম আমরা। তিথির বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে ও সবাইকে বলত, কলকাতায়। আদতে ওরা ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার গোপালপুরের বাসিন্দা। ওর বাবা, হাইস্কুলের শিক্ষক। মা-ও তাই। ও এক সন্তান। ওর বাড়ির গল্প শুনতে খুব ভালো লাগত আমার। ভালো লাগত ওদের একান্নবর্তী পরিবারের কূটকচালি শুনতে। ওর বাবারা পাঁচ ভাই। সবার একসঙ্গে রান্না হয়। রোজ প্রায় তিরিশজনের পাত পড়ে ওদের টানা দালানে। এই তিরিশজনের মধ্যে দুটি কুকুর এবং তিনটি বেড়াল। পোষ্য। থাকেও সবাই এক বাড়িতেই। ওর ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা। গান শেখা। সেই কারণেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ও সঙ্গীত ভবনে ভর্তি হয়েছে। গান নিয়েই। বাবাই ওর শিক্ষক ওখানে। যে গ্রীষ্মে ওর সঙ্গে পরিচয় হয়, তার পরবর্তী বর্ষাতে ওকে আমি চুমু খাই। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন সেটা।
সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। আমি কলেজে গিয়ে দেখি, ক্লাস-টাস কিছু হচ্ছে না। চারিদিক জলে জল। হাতেগোনা চার-পাঁচ জন ক্লাসরুমে বসে গজল্লা করছে। কয়েকটা ভেজা ছাতা খুলে রাখা। ফ্যানের নীচে। শুকোনোর জন্য। তিথিকে হোয়াটসঅ্যাপ করতে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখি, ও মেসেজ করেছে। ‘সোনাঝুড়ি?’ রিপ্লাই দিলাম। ‘হ্যাঁ’। ‘চলে আয়’।
গেলাম। রাস্তায় জল। বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। দোকান-পাটে ঝাঁপ ফেলা। পাখিগুলো অসহায় ভিজছে। সাইকেল কলেজের গ্যারেজ থেকে বার করতেই ঝেঁপে নামল আবার। কী করে যাই? ভাবতে ভাবতে প্যাডেল করতে আরম্ভ করলাম। ফোনটা জিন্সের পকেটে। তিথিটা একেবারে পাগলের মতো বর্ষা ভালবাসে। তা না হলে, এই জল-বাদলে কেউ সোনাঝুড়ি যায়? ক্যানেলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কানে এল, এই –এই এইখানে নাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, একটা টালি-ছাওয়া বন্ধ দোকানে তিথি বসে আছে, কাঠের বেঞ্চিতে। ধারে-কাছে কেউ নেই। সাইকেল রেখে বসলাম। রুমাল বার করে দিল ও।
— মাথাটা মুছে ফেল।
আকাশ অন্ধকার করে এল আবার। আমরা হাতে হাত রেখে বসে আছি। এমন সময় তিথি বেজে উঠল– গানে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। একই গান ঘুরে ফিরে গাইছে। দুবার-তিনবার। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ওর ঠোঁট দু’খানিতে যেন পলকা ঢেউ খেলছে। আমার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে! পারা যায়, না ছুঁয়ে থাকতে?
— তোর ঠোঁট ছোঁব? একবার? প্লিজ?
— না বললে শুনবি?
জলতরঙ্গের মতো হাসি ওর। রাজহাঁসের মতো তুলে ধরল গ্রীবা। আমি নামালাম মাথা। মিনিট তিনেকের সেই বিস্ফোরণ— কী যে হল! এত সুখ থাকে তবে দুনিয়ায়? এত সুখও ছিল? আমার মাথার চুল মুঠোয় ধরে সে বলল— এই মুখ? এই ঠোঁট তবে ধ্বংস হয়ে যাক?
— হোক।
— আগুনে হোক, না জলে?
— চুপ। চুপ। চুপ।
আমি তাহলে এতদিন এক অন্ধকার দেওয়াল, এক নেশাড়ু জন্মদাতা, অসম ও নিষ্করুণ ছোটবেলা নিয়ে কেন বন্দি ছিলাম? কেন আটকে ছিলাম অকালে মরে যাওয়া বিষণ্ণ তরুণ ও ধর্মের চক্রব্যূহে? এসবও তো আছে দুনিয়ায়। সেই দিনই প্রথম মনে হয়, এই জীবন বদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ধর্মের সাঁড়াশিতে। এর থেকে মুক্তি চাই। আমার। আমাদের। সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখত ফারহান সিদ্দিকি। সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে সবাইকে। চারিয়ে দিতে হবে। বোঝাতে হবে, মানুষ সব্বাই এক। একইরকম। সমান সংখ্যক অস্থি সবার দেহে। সবার রক্তের রং লাল। এর কোনও ব্যতয় নেই। এই প্রেম আমাকে চোখ খুলে দেখতে শেখাল। কত আগড়ুম-বাগড়ুম কথা হত সারাদিন! কতবার ফোন! কত মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ তখন আমাদের। আশ্চর্য সব আইডিয়া ঘুরে বেড়াত ওর মাথায়। অনেক খুঁজেপেতে, তিথি আমাকে জন্মদিনে একটা নাম উপহার দিয়েছিল। শালপাতায় রং দিয়ে লিখে দিয়েছিল— খোয়াই। আমাকে বলেছিল, তোকে এমন নাম ছাড়া মানায় না।
বলেছিল, খোয়াই, তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব।
— আমাকে?
— তাছাড়া আর কাকে? মা-বাবাকে বলতে হবে না? আমাদের পুকুরধারে বসে থাকব তোকে নিয়ে।
— পুকুর ধারে কেন? তুই সাঁতার জানিস না?
— ওমা! সাঁতার জানব না? কী যে বলিস! আমি চার বছর বয়েস থেকে সাঁতরে এপার-ওপার করি।
— তাহলে দেখা যাবে, কে আগে ওপারে যেতে পারে।
— দেখব। দেখব।
— দেখিস!
— আচ্ছা, তোদের বাড়িতে গরু আছে?
— হ্যাঁ। গোয়াল আছে তো। আমাদের লক্ষ্মীদি গরুদের দেখাশোনা করে। বিকেলে মশার ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। স্নান করায় অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে। পরিষ্কার জল খাওয়ায়।
— আর কুকুর?
— উফ! তোর কী কিছুই মনে থাকে না, রে? বলেছিলাম তো লালু ভুলুর কথা।
— তাই তো! প্রেমিকার বাড়ির কুকুরের খোঁজ রাখাটাও প্রেমিকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, ভুলেই গিয়েছিলাম।
তিথি রেগে দুমদুম করে কিল মারতে থাকত আমাকে।
— মহা অসভ্য তুই। যাচ্ছেতাই একদম।
আমার হাসির শব্দে তিন-চারটে পাখি উড়ে যেত।
আমি সেই সব দিনে, বাড়ি ফিরে মনে মনে দেখতে পেতাম সেই একটেরে পুকুর। সেই হাস্যমুখী ধানের গোলা। সেই ছোট্ট একটা মেয়ে, মাথায় ঝুঁটি... যে এখন প্রজাপতি হয়ে ‘তিথি’ নাম পেয়েছে।
রোজ সকালে ও আমাকে ফোন করত। কখনও কখনও ওর ফোনেই আমার ঘুম ভাঙত। অন্তত এক ঘণ্টা কথা হত আমাদের। তারপর দেখা হত। কলেজ কেটে। কিংবা ছুটির পরে। সাইকেল নিয়ে আমরা কোথায় না কোথায় চলে যেতাম! ওর ঝোলা থেকে বেরত জয় গোস্বামী, শঙ্খ ঘোষ, দেবারতি মিত্র, নবনীতা দেবসেন। সাইকেল থামিয়ে কোথাও বসে আমরা পড়তাম। ওর ভালো লাগা লাইনগুলো ও পেনসিল দিয়ে আন্ডারলাইন করে রাখত।
তিথির সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় হতে লাগল যত, তত আমার বিষাদ কমতে লাগল। ও আমাকে খুব লিখতে বলত। বলত, রণো তুই লেখ। সবার জানা দরকার তোর কথাগুলো। আমি বলতাম, আচ্ছা আমার ধর্ম কী, তুই জানিস? আমি মুসলমান, না কি হিন্দ।।
— তুই কিচ্ছু না। তুই সেই গুটিকতক লোকের একজন, যাদের কোনও ধর্ম নেই। তাই তারা সব ধর্মের। তোর সব আছে, রণো। তুই লেখ। এই দেখ, তোর লেখা নিয়ে আমি ঘুমোতে যাই। দেখ–
বলে পড়তে শুরু করল...
“সে তোমাকে টেনে নামাবেই রাস্তায়।
সে তোমাকে শুঁকবে কুকুরের মতো
এতক্ষণে তার নখের বিষ তোমার শরীরে
তার ট্রিগার তোমার গলা ছুঁয়েছে ইতিমধ্যেই।
আর হাজার-লক্ষ-কোটিবার সে জানতে চেয়েছে।
কী মাংস? কী মাংস?”
আমি লিখতে শুরু করলাম। যা যা বলার ছিল— সব লেখা শুরু করলাম।
পাঠাতে লাগলাম নানা ম্যাগাজিনে। প্রথমটায় নিজেই পাঠাতাম। ধীরে ধীরে লেখার ডাক আসতে শুরু করল।
শরৎকালের এক সোনা আলোর সকালে, এক বৃদ্ধ মানুষ এলেন। সৌম্যদর্শন মানুষটি সেই বাঁকুড়া থেকে এসেছেন। তিনি একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদক। আমার লেখা পড়ে দেখা করতে একেবারে বাড়ি এসে হাজির।
— তোমার লেখা পড়ে চলে এলাম বাবা। কিন্তু তুমি যে দেখছি একেবারে বাচ্চা ছেলে।
আমি প্রণাম করাতে চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদ করলেন।
— অনেক বড় হবে তুমি। এমন লেখার ধার, এমন যুক্তি, এমন ভাষা! পাঠকের ক্ষমতা কোথায় তোমাকে প্রত্যাখ্যান করার? আমি আজ তিরিশ বছর লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে আছি। আমি বুঝতে পারি। তোমার প্রতিভা আছে বাবা। নিজেকে যেন নষ্ট করো না। অনেক লেখো। অনেক। জীবন আছে তোমার লেখায়।
সেদিন সেই বুড়ো মানুষটার কথাগুলো খুব গভীরে স্পর্শ করেছিল আমাকে। এরপরই এক রবিবার সকালে বাড়িতে হইহই কলরব। বাংলার অন্যতম প্রধান ও নামকরা সংবাদপত্রে আমার লেখা উত্তরসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। এবার নানা লিটল ম্যাগাজিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে দিল।
এই সময়ে একদিন বিকেলে বাবাই কলেজ থেকে ফিরে মাকে জানালো, শোনো, তোমার বড় পুত্রের একজন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। জানো?
— তাই নাকি? ওমা। আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।
— তোমাকে বলবে কেন? মায়ের আঁচলচাপা ছেলে না কি? কিছুই তো খবর রাখো না।
— মেয়েটা কে? চেনো?
— চিনি মানে? আমার সাক্ষাৎ ছাত্রী যাকে বলে।
— কেমন সে?
এবার বাবাই একটু ভ্রু কুঁচকে ভাবল
— কেমন আমি কী করে বলব? এমনিতে তো ভালোই। তবে…
— তবে?
— মানে মেয়েটা একটু প্রতিবাদী আর কি!
— সেটা আবার কী রকম?
— শোন, থিওরির ক্লাসে সুতনু মানে আমাদের সুতনু কুণ্ডু পড়াতে পড়াতে নাকি মেয়েদের ‘মেয়েমানুষ’ বলে মেনশন করেছে। সে মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছে, স্যার, মেয়েদের মেয়ে বা নারী বলুন। মেয়েমানুষ আবার কী টার্ম? সুতনু তাকে ক্লাস থেকে বার করে দিতে সে সটান প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে উপস্থিত। স্যারের নামে নালিশ করতে। বোঝ একবার? কী সাহস!
— এ তো রেবেল একেবারে। তবে যাই বল, কাজটা কিন্তু ভালোই করেছে।
— মানে? সব কিছুতেই তোমাদের এরকম কেন মনে হয় বল তো? 'মেয়েমানুষ' কথাটা খারাপ? আজীবন তো এটাই শুনে এলাম।
— খারাপ নয় তবে শুনতে কানে লাগে। আজীবন যা শুনে এসেছ, তার সবটাই কি সমর্থন করার মতো? ভেবে দেখো মন দিয়ে। কত কীই তো শোনো। একটু ভেবো এবার।