শেষ আপডেট: 15th October 2022 13:31
(১২)
আমার অন্য অ্যাম্বিশান। আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। জাস্ট, চলে যেতে চাই। ইনফ্যাক্ট, সামনে জি.আর.ই আর টোয়েফেল। ও দুটো ক্লিয়ার করতে না পারলে আমার কোনও আশা নেই। এখানেই পচে মরতে হবে। এই গান, শিল্প, মুক্ত চিন্তা– এসব থেকে দূরে আমি নিজের আলাদা দুনিয়া বানাব। একটা হার্লে ডেভিদসন বাইক কিনব। উইক-এন্ডে বেড়িয়ে পড়ব ভাইকিংদের মতো। তাঁবু নিয়ে যাব ব্যাকপ্যাকে। ইচ্ছে মত জায়গায় থেমে যাব। রাতের পর রাত কাটাব পরিষ্কার আকাশে মিল্কি ওয়ে দেখে। ফল-এ, মানে ওদেশের হেমন্তকালে যখন হলুদ পাতায় ছেয়ে যাবে মাটি, লম্বা পথ হাঁটতে বেরব। সন্ধেয় ঘরে ফিরে রান্না সেরে, হট শাওয়ার নিয়ে কফি হাতে বসব। বার-বি-কিউ-এর জন্যে গোটা টার্কি কিনে আনব সুপার মার্কেট থেকে। শীতে বরফ কেটে পথ করে গাড়ি বের করব গ্যারেজ থেকে। এখনকার এই সব হাবিজাবি কাজ এবং তুচ্ছ বন্ধনের বাইরে ওই দেশেই শুরু হবে আমার অন্য জীবন। এখানকার এই মহৎ সংস্কারের থেকে আমার বিস্তৃত যজ্ঞ পছন্দ। তারপর আবার কাজ। ওখানে কাজ করতে গেলে এখানকার আকাট, লোভি, আখের গোছানো রাজনীতির দাদাদের দরকার হবে না। আমার মেধাকে কাজে লাগানো যাবে। শুধু মেধা আর পরিশ্রম। ব্যস! আর কী চাই? স্বীকৃতির পরোয়া আমি করি না। দুনিয়া-শাসন করা ডলারেরও না। আমার ওই বিশাল দেশে একটা ঘর চাই। একদম নিজের একটা ঘর। বিষণ্ণতার হাওয়াহীন সেই বাড়িতে আমি কাজ করব। অনেক কাজ।
সেসবের জন্যে আগে এই জায়গা থেকে আমাকে দূরে চলে যেতে হবে। নতুন জায়গায়। একদম অন্য পরিবেশ দরকার আমার। এ দেশ তো অনেক দূরের কথা– আগে এই পরিবার থেকে পালাতে চাই। আমাদের বাড়িতে সব কেমন আলগা-বিষণ্ণ। কেউ জোরে কথা বললেই মা তাকাবে, করুণ চোখে। বাবা বিরক্ত হবে। দাদার কাছে তো কিছু পৌঁছবেই না। সারাক্ষণ দশমীর সুর ভাসে এ বাড়ির বাতাসে। ভালো লাগে না আমার। একদম ভালো লাগে না। মা বোঝে না, দাদার আজকের অবস্থার জন্য আমি দায়ি নই। ও নিজেই এই হাল বানিয়েছে নিজের। আমি বড় জোর অনুঘটক। বাবা চুপ করে থাকে। দাদাই যা কেবল আমাকে কিছু বলে না। ওরা কেউ বোঝে না, আমি শমী। আমি রণো হতে চাই না। চাইনি। গান গাইতে আমার ভালো লাগে না। শুনতে ভালো লাগে। আমি একদম আলাদা একটা ছেলে। কিন্তু আমি নিষ্ঠুর, বিবেকহীন নই। মণিপুরের এই পরিবারে আমি যেন সব সময় এক অনুপ্রবেশকারী। তাই আজকাল মনে হয়, আমেরিকা নামের মহাদেশটা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
খেতে গিয়ে দেখি, দাদা একা বসে আছে টেবিলে। অল্প ভাত, দুধ দিয়ে মেখে খাচ্ছে।
— বাকি সব কোথায়?
— বাবা-মা পরে খাবে। আমার খিদে পেয়েছিল। তাই খেয়ে নিচ্ছি।
— সেকি! আমাকে তো এতক্ষণ তাড়া দিয়ে দিয়ে পাগল করে দিচ্ছিল।
এমন সময়, হরির বউ চা-মুড়ি দিয়ে গেল। আমাদের দেখে দাদা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাতে, বললাম
— মাথা ধরেছে। অন্য কিছু খাব না আজ। তুই এখন ভাত খেয়ে নিলি, রাতে কী খাবি?
আবার ভাত খাব।
বলে দুলে দুলে হাসতে লাগল দাদা।
আচ্ছা, ওর কি আমার ওপর রাগ হয় না তিথির ব্যাপারটায়? নাকি সব ভুলে গেছে? তাও কি সম্ভব?
কাল রাত থেকে বেড়াতে যাওয়ার কথা হচ্ছে। দেখা যাক! যদি যাওয়া হয়, দাদার সঙ্গে কথা বলব। ওখানে ওকে একা পাওয়া যাবে। সত্যি, কতদিন বেড়াতে যাই না আমরা। এদিকে বাবা বলছে বর্ষাকালে পাহাড়ে না যাওয়াই উচিত ইত্যাদি। আবার ছুটিরও সমস্যা আছে। একটা না একটা ফ্যাকড়া উঠবেই। একটাই আশার কথা, দাদা যখন বলেছে যাওয়া হবেই। মা এখন বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। দাদাকে নিয়ে ভেবেই যাচ্ছে শুধু। তবে সত্যি কথা বলতে, আমারও খুব ইচ্ছে করছে বেড়াতে যেতে। খুব। অবশ্য ওই দিনগুলোর মধ্যে ভিসা ইন্টারভ্যিউ-এর ডেট পড়ে গেলে যাওয়া হবে না। (Bengali Novel)
“Religion is based, I think, primarily and mainly upon fear. It is partly the terror of the unknown, and partly the wish to feel that you have a kind of elder brother who will stand by you in all your troubles and disputes. Fear is the basis of the whole thing - fear of the mysterious, fear of defeat, fear of death”. রাসেল-এর এই কথাগুলো লেখা ছিল আমার বাবার খাতায়। একটা হলদে হয়ে যাওয়া ‘গুডবয়’ খাতায়— বাবার অসামান্য হাতের লেখায়। পাতাটার ছবি তুলে, আমি ফেসবুকে পোস্ট করি।
আমার বাবার নাম ফারহান সিদ্দিকি। বাবাকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন নাকি সিদ্দিকি বংশের নিয়ম— মা বলেছিল। কিন্তু ফারহান সিদ্দিকি ‘তুমি’ ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না আমার কাছে!
আমার মায়ের নাম ইরাবতী মিত্র। আমার নাম রণদীপ। রণদীপ সিদ্দিকি। এই ‘সিদ্দিকি’টা আমি মানি না। র্যাদার, মানতে পারি না। আমি ‘মিত্র’ মায়ের সন্তানও তো। তাহলে কেন আমাকে ‘সিদ্দিকি’ বহন করতে হবে? তা বলে, এও ধারণা করার কোনও কারণ নেই, আমি ‘মিত্র’ হতে চাই। আমি মিত্র, সিদ্দিকির বাইরের লোক। শুনেছি, বাবার বাড়ি থেকে মা-সহ বাবাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করার অপরাধে। আর মায়ের তো বাড়িই ছিল না। পিসিদিদা মাকে তাড়াতে পারলেই বেঁচে যেত, এবং শেষ পর্যন্ত তাড়িয়েওছিল।
মায়ের কাছেই শুনেছি, বীরভূমের জোতদার গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন আমার ঠাকুরদা রমজান সিদ্দিকি। প্রভূত সম্পত্তির মালিক রমজান সিদ্দিকির একমাত্র ছেলে– আমার বাবা। এই মণিপুর থেকে তাঁদের জলটুংরি গ্রামের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। ওই গ্রামে প্রাইমারি স্কুল থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবই তাঁর তদারকিতে নির্মিত। সিদ্দিকি বাড়ির সম্পত্তির মূল উৎস ছিল চাষ-আবাদ এবং বন্ধকি কারবার। পরের দিকে এলাকার দুটি চালকল এরাই কিনে নেয়। গ্রামের গরিব মানুষ বিপদে-আপদে সিদ্দিকি বাড়ির দ্বারস্থ হত। শোনা যায়, গত প্রায় একশো বছর ধরে এটাই রেওয়াজ। এই বাড়ির একমাত্র ছেলে, আমার বাবা ফারহান সিদ্দিকি। তাকে সরিয়ে দিতে পারলে সিদ্দিকি বংশের একচ্ছত্র আধিপত্য কমিয়ে দেওয়ার স্বার্থে, জ্ঞাতিরা যে বাবার আব্বাকে উশকে, বাবাকে ওবাড়িতে ঢুকতে দেয়নি– তা বোঝার মতো কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন না রমজান সিদ্দিকি।
ফারহান খুব অল্প বয়েস থেকে দারুণ ছবি আঁকত। পড়াশোনাতেও বরাবরের মেধাবী। হাইস্কুল শেষ করে, কলকাতায় চলে আসে ফারহান। গভর্নমেন্ট কলেজ অফ ফাইন আর্টসে ভর্তি হয়। আমার মায়ের সঙ্গে কলকাতাতেই তার দেখা। তবে মা-বাবার প্রেম আর বিয়ের ডিটেইল আমার সেভাবে জানা নেই। ফারহানের যেটা সমস্যা হয়, তা আসলে চিরকালের মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা! নগর-জীবনের কিছু অভিশাপ থাকে। জলটুংরির কিশোরটি তাকে এড়াতে পারেনি। প্রথমে সে পড়ে শুকনো নেশার খপ্পড়ে। বন্ধুরাই এসব ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। ফারহানের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এরপর নিজেকে ডুবিয়ে দেয় মদে। নেশায় সে এক তূরীয় আবেশের খোঁজ পায়। ধীরে ধীরে মদই তার সারাক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠে। কলেজ শিকেয় ওঠে। বিয়ে হয়— এই জায়গাটা আমার কাছে অনেকটা মিসিং লিঙ্ক-এর মতো। কীভাবে কী হয়েছিল— সব ব্যাপারটা স্পষ্ট জানতে পারিনি। তাই এখনও অপার কৌতূহল জেগে আছে।
বাবাকে যে খুব স্মরণে আছে তা নয়! আমার যতটুকু মনে আছে, বাবা সারাদিন ঘরে বসে জানালার ধারের টেবিলে চায়ের কাপ রেখে, প্রচুর বই পড়ত। ছবি আঁকত। আমাদের তখন একটাই ঘর ছিল ওই বাড়িতে। একটানা লম্বা সে ঘর। ইংরেজি ‘আই’ অক্ষরের আকারের। একপাশে রান্না হত। অন্য পাশে খাওয়া। কামারডাঙার গলির মধ্যের সেই ছোট্ট বাড়িতে বাবা-মা ভাড়া থাকত। ঘরে দুটো জানলা ছিল। তারই একটার পাশে থাকত বাবার ইজেল। বাবা ওয়াটার কালার পছন্দ করত। জানলার পাল্লাতেও কী সুন্দর সব পাখি এঁকেছিল। আমাকে পেনসিল ধরতে শেখাত তখন থেকেই। বলত, গুগাবাবা ও গুগাবাবা, এসো রং খেলি। আমি বলতাম— রং তো দোলে খেলে। তুমি কিচ্ছু জানো না। বাবা হাসত— আমাদের তো সারা বছরই দোল।
— তাহলে সারা বছরই ‘লাগলো যে দোল’ কেন গায় না মায়ের ছাত্রীরা?
— আরে! যাদের বাড়িতে রং থাকে, তাদের গান, ছবির মধ্যে মিশে থাকে। আলাদা করে গান গাইতে লাগে না, তাদের। তুমি জানো?
বাবা আমাকে ‘গুগাবাবা’ বলে ডাকত। গুপী গাইন আর বাঘা বাইন মিলিয়ে। এসব কথা আবছা মনে পড়ে এখনও। আর ভয় করে, এই রং-তুলির বাবা যখন মদ খেয়ে ফিরত, সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে। তখন কেবল খিস্তি-খেউড়, চিৎকার। মারামারি। কখনও কখনও পা পিছলে পড়ে যেত রাস্তার পাশের নালায়। মা গিয়ে টেনে নিয়ে আসত। আমি কাঁদতাম। চিৎকার করে কাঁদতাম। মা থামাত। বলত, সকাল হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যিই সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, বাবা-মা চা খেতে খেতে গল্প করছে কিংবা মা রেওয়াজে বসেছে, পাশে বাবা মাথা দোলাচ্ছে সুরের তালে। এ যেন এক অলীক ছবি। যেন এমনই চলে এসেছে। কেউ যেন মদ খেয়ে চেঁচায়নি। কেউ যেন পড়ে যায়নি নর্দমায়। এমনভাবেই যেন গান লেগে আছে সুরের গায়ে সবসময়। (Bengali Novel)
দুপুরে বাবা ছবি নিয়ে বসত। আবার কোনও কোনও দিন বাবার বন্ধুরা আসত। আড্ডা জমে উঠত। আমাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে হাল ছেড়ে দিত মা। কানে আসত পিকাসো, ভিঞ্চি, রাফায়েল— এই সব নাম। মা চা করে দিত ওদের। বিকেলে আবদার হত গান শোনার। মা গা ধুয়ে আসত তখন। চওড়া পাড় দেওয়া সুতির শাড়ি পরত মা। আকাশি, চন্দন, সাদা রঙের জমিতে সে সব পাড় যেন হেসে উঠত। মা বেশিরভাগ সময়েই চুল বাঁধে না। তখনও বাঁধত না। কী সুন্দর দেখতে লাগত মাকে! যেই সন্ধে হয়ে আসত, আতঙ্ক শুরু হত। বাবাকে ভয় হত আমার। এ যেন এক ডাক্তার জেকিল, মিস্টার হাইডের মতো ব্যাপার। সন্ধের পরে যেন অমন চমৎকার মানুষটাকে রাক্ষসে ধরত। কেবল শিং আর দাঁত দেখতে পাওয়া যেত না, এই যা! আমি জন্মানোর পর বেশ কিছুদিন বাবা মদ স্পর্শ করেনি– মা বলেছিল। তারপর আবার শুরু। মূলত বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হয় না। বাবা মারা যাওয়ার দিনটা আমি ভুলতে পারিনি চেষ্টা করেও।