শেষ আপডেট: 6th August 2022 13:16
(১০)
— বাদ দাও বলে দিলেই কি বাদ দিয়ে দেওয়া যায় এসব ঘটনা, তুমি পারতে সবকিছু মাথা থেকে বের করে দিতে ?
— পারতাম। অবশ্যই পারতাম। কেন পারা যাবে না? তোমার থেকে আমার সঙ্গেই তো ফরহানের চেনা জানা ছিল বেশি। আমিই যেখানে সব মাথা থেকে বের করে দিতে পারলাম, আর তুমি পারছো না? একটু বড় করে ভাবতে শেখাও তো দরকার। না হলে মনের কুঠুরিতে হাওয়া-বাতাস খেলবে কি করে? বল?
— মানলাম। আমি না হয় আর বলব না এসব। কিন্তু তুমি আবার একথা যেন ইরার সামনে বোলে বসো না। তোমার তো আক্কেল নেই।
— কী যে বলো! ইরাকে একথা বলে কেউ? তোমার কোন কথাটা শুনি না, বল তো?
— ঢং
ঠাকুমা চুপ করে গেলেন। সম্ভবত ঘুমানোর চেষ্টা করতেই। এদিকে আমি তখন ভাবছি— দাদার বাবার বদ গুণ? বদ গুণ কাকে বলে? দাদার এই বাবাটা আবার কে? এই ফারহান লোকটা কে? তাকে নাকি এরা চিনত? দাদার বাবা আর আমার বাবা আলাদা কেন হবে? উত্তর খুঁজে পেতে মরিয়া, কিন্তু উপায় নেই, ফলে এবার কান্না পেতে থাকে আমার। (Bengali Novel)
এরপর ধাঁধার মতো কত প্রশ্ন নেমে এল আমার আর দাদার মাঝখানে। কোনও এক ইনটিউশন থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, এসব কথা বড়দের জিজ্ঞেস করতে গেলে, অনিবার্যভাবে ধমক খেতে হবে। মা হয়তো একটা থাপ্পড়ই দিয়ে বসবে! বলা যায় না! দাদাভাইও ভারি রাগি মানুষ ছিলেন। আমার বারবার তারপর থেকে চিন্তা হতে লাগল— দাদা কি তাহলে অন্যদেশের কেউ? নাকি ও আলাদা কোনও বাড়ির ছেলে? অন্য কারও দাদা? তাই-ই বা কী করে হয়? লালকমল-নীলকমল বলে তাহলে ডাকে কেন আমাদের দু’ভাইকে ঠাম্মা? ওরা তো দুই ভাই-ই ছিল। ওরাও তো আমার আর দাদার মতো মারামারি করে, ঠাকুরমার ঝুলিতে পড়েছি। সাইকেল চড়া থেকে শুরু করে— কে আগে ইস্কুল থেকে ফিরে কেক খাবে তাই নিয়ে পর্যন্ত ঝামেলা, সারাক্ষণ। আমাদের মতের মিল হয় না। মারামারি করি। পরস্পরের বিরুদ্ধে নালিশের অন্ত নেই। তবু দাদা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে, এই কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমিও পারতাম না আলাদা থাকতে।
সেই দিনটায় যা যা শুনেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল একমাত্র দাদা-ই পারবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। সুযোগ পেলেই, আড়ালে কতবার যে দাদাকে জিজ্ঞেস করেছি এ-সব ব্যাপারে! দাদা কিন্তু বিরক্ত হয়নি। বরং বিষণ্ণ হয়েছে। দীর্ঘ সময় জুড়ে অনেক কথা হয়েছে আমাদের।
— তোর যে আলাদা বাবা, জানতিস দাদা?
— কেন জানব না? আমার সব মনে আছে তো।
— ফারহান কে ছিলেন, জানতিস ?
— হ্যাঁ। ফারহান সিদ্দিকি। আমার বাবা। মায়ের প্রথম স্বামী। বারবার এক কথা কেন যে বলিস!
— মায়ের স্বামী?
— তা নয় তো কার?
— মায়েদের কি দুবার বিয়ে হয় দাদা?
আমি বরাবরের বোকা। আর এই জাতীয় আলাপের সময়ে আমার মাত্র ক্লাস সিক্স। দাদা হাসত।
— হয় হয়! তুই তো তখন ল্যান্ডই করিসনি দুনিয়ায়। ওই নিয়ে ভাবছিস কেন? মায়েদের, বাবাদের সবারই দুবার বিয়ে হয় অনেক ক্ষেত্রেই।
আমি মাথা নীচু করে ভাবতে শুরু করি। বিজ্ঞ দাদা পকেট থেকে হজমিগুলি বের করে হাতে দেয়। আবার খেলা শুরু হয়। এভাবেই টুকরো টুকরো করে কথবার্তা হত এই বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে। তখন কথা হত অনেক। আড্ডা মারতাম রাত জেগে। তারপর এসে গেল, ওই ফেসবুক! ওখান থেকেই যা যা গোলমাল হওয়ার হয়ে গেল। মুখোমুখি হওয়া কমে গেল হঠাৎ।
আমার সহজ সরল দাদাটা আমাদের মতো ভার্চুয়াল আর রিয়্যাল আলাদা করতে পারেনি। এটাই সমস্যা হয়ে গেল। যে সমস্যা মিটবে কি না আদৌ— আমি জানি না।
— শমীইইই
মা ডাকছে।
— যাই – ই।
বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলে, মা ডেকে ডেকে পাগল করে দেবে যতক্ষণ না জলখাবার খাব। আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। কলেজে সারা দিন ছোটাছুটি গেছে খুব। হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের পলাশের পা ভেঙে গেল ক্রিকেট খেলতে গিয়ে। তাকে নিয়ে হাসপাতাল-ওষুধ ইত্যাদি করে, ছোটাছুটিতে মাথা ধরে গেছে। আমার সাইনাসের সমস্যা আছে। দাদারও একই প্রবেলম। না খেয়ে থাকলে, রোদ্দুর লাগালেই মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। এখন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে ঘর অন্ধকার করে। কিন্তু মা কিছুতেই ছাড়বে না, না-খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে। এমনিতে আমাকে নিয়ে, মায়ের খুব একটা চিন্তা-ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না। কোনওকালে ছিলও না। আমি বরাবর ঠাম্মার কাছে থেকেছি। যা সব বায়না-আবদার করেছি— সবই ঠাম্মা আর বউ সামলেছে। দাদাও আমার অনেক বায়নাক্কা সামাল দিয়েছে। মা তো চিরকালের অন্যমনস্ক! বাবাই ব্যস্ত। ভাগ্যিস, দাদাটা ছিল!
এখন আমি নিজেই, নিজেকে নিয়ে সারাদিন ভাবি! যা করেছিলাম, তার ক্ষমা নেই — দাদা বলেছিল। কিন্তু দাদার ছাতার আড়ালে পড়ে যেতে যেতে রাগ হত খুব। বাবা আজীবন নিজেকে দাদার ‘আসল বাবা’ প্রমাণ করতে ব্যস্ত রইল। মা তার আগের বিয়ের হ্যাং-ওভার কাটাতে পারল না। ঠাম্মা, দাদাভাইও খানিকটা ওরমই জীবন কাটিয়ে গেল। এ বাড়িটা আমার ভালো লাগত না। ঠাম্মা আর দাদাভাই যত দিন ছিল, তত দিন তবু ব্যাপারটা এক রকম ছিল। ওরা মারা যাওয়ার পরে, বাড়িটা চুপচাপ হয়ে গেল খুব। একটু শব্দ করলেই হরি ছুটে আসত— আওয়াজ কোরো না খোকা। কেন? খেলাও যাবে না? কিছু বলতে গেলেই শুধু চুপ-চুপ। ভালো লাগত না আমার।
ছোটবেলায় জ্বর হত আমাদের দুই ভাইয়ের। পালা করে। মা হোমিওপ্যাথির মিষ্টি গুলি খাইয়ে গরম জলে গার্গল করাতো আমাদের। বারবার দেখত, দাদার গলার মাফলার ঠিকঠাক আছে কি না! আমি মাফলার খুলে ফেললেও মায়ের চোখে পড়ত না সেভাবে। দাদাকে বলত, ইশ তোর গলাটা যাবে এবার, এত ঠান্ডা লাগালে! আর আমাকে বলা হত— শমী, তাড়াতাড়ি হোম-টাস্ক শেষ করো। তোমার তো গানের প্রতি মন নেই।
কেউ জানতো না, আমি গান গাইতাম না রাগে। বাবাই সারাক্ষণ অভিযোগ করত আমার অমনোযোগ নিয়ে। গোড়ায় মা আমাকেও দাদার সঙ্গে নিয়ে বসেছে, কিন্ত আমার গাফিলতিতে, মা কয়েক বার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। কেন গাইবো আমি? হারমোনিয়াম দেখলেই রাগ হত আমার। আজও হয়। মা ওই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে ভুলেই যেত দাদা ছাড়াও একটা শমী আছে। দাদাকে গান শেখানো যেন একমাত্র পুণ্য কর্ম ছিল এ বাড়ির। বাবাই রাতে ফিরে এসে আগে জিজ্ঞেস করত, রণো আজ রেওয়াজ করেছে? আহির ভৈরব নিয়ে একটু বেশি সময় বসতে হবে ওকে। মনে রেখো। মা, মাথা নাড়ত। তারপর দাদার রেওয়াজের খুঁটিনাটি পেশ করতো। ওরা দাদাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ডুবে যেত, আর আমি ক্রমশ একা একা খেলতে শুরু করতাম। মনখারাপ করত। ধীরে ধীরে বুঝতে পারতাম, এই সমবেত ভালবাসা কেবল দাদার জন্যে— আমার কথা সব সময় পরে এসেছে। আমি যেন এই পরিবারের অ্যাডিশ্যনাল সাবজেক্ট । বরাবর।