শেষ আপডেট: 2nd July 2022 12:40
(৯)
প্রকাশকে সাইকেল তুলে নিল সে। এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। চারিদিকে জোনাকিরা ওড়াউড়ি শুরু করেছে ততক্ষণে। মা চিন্তা করছে ঠিক— এই ভেবে, সে, এবার খুব তাড়াতাড়ি প্যাডেল শুরু করল।
— কেমন আছিস রে, তুই? রণো?
প্রকাশ তার খুব কাছের বন্ধু। তার মানসিক টানাপোড়েনের অনেকখানি খোঁজ সে রাখে।
— আছি। ভালই তো।
— মাঝে মাঝে শমীকেও তো সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারিস। ছেলেটা এত দাদা-দাদা করে! এমন ভাবে একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে ?
কী করে যে বোঝায় সে একে, শমীকে সে এতই ভালবাসে যে, তার মতো আলায়-বালায়, রোদে ঝড়ে জলে ঘুরিয়ে ছোট ভাইটাকে কষ্ট দিতে মন সরে না একেবারে। তাছাড়া শমীর এখন নিজস্ব বন্ধুবৃত্ত তৈরি হয়েছে। ও আজকাল তাদের সঙ্গেই বেশি স্বছন্দ।
— চুপচাপ চল! বকিস না বেশি।
একটু বিরক্তি প্রকাশ না করে পারে না এবার সে।
প্রকাশ বুঝতে পেরে আর কথা বলে না।
ইদানীং তার নিজের ঘরে থাকলে, দম আটকে আসে। বাইরে বেরোলে ক্লান্ত লাগে। সোনাঝুড়ির আড্ডায় জয়েন্টে ভাগ করে তামাক টানতেও তার তেমন ভাল লাগেনি। এদিকে বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়াও সে থাকতে পারে না। আবার বন্ধুদের সঙ্গেও সে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারে না। এখন সে নিজেই বোঝে কেমন যেন খিটখিটে হয়ে থাকে মেজাজ! কী যেন একটা তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই ছোট্টবেলা থেকে। পড়তেও যে খুব ভাল লাগত তার— তা নয়। কিন্তু পড়তে হবে— এই বোধ থেকেই সে বইখাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ইস্কুলে যেত নিয়মিত। খুব খারাপ রেজাল্ট সে কখনও করেনি। তবে আহামরি কিছুই করেনি কখনও। ধীরে ধীরে এইভাবেই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যায় সে। কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে বিশেষ মাথা-ব্যথা ছিল না তার নিজের। বাবাই-ই তাকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল। সেই কলেজে পড়া মোটেই ভালো লাগত না তার। তাই কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয় ধীরে ধীরে। গোড়ায় কেউ জানতে পারেনি। তবে দ্রুত ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে, বাড়িতে এই নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়। (Bengali Novel)
আগাগোড়াই সে চুপ করে ছিল। এই চুপ থাকাটাই তার অস্ত্র। সে কোনও প্রতিবাদ করে না। যে যা বলে, শুনে যায়। কিন্তু নিজের যা ইচ্ছে করে, সেটাই ধরে থাকে। তাই তাকে ঘাঁটিয়ে লাভ হয় না তেমন। তাই যে যাই চেঁচাক, পড়ার বইটই বড় একটা ধরত না সে। তাকে বরাবর বাঁচিয়ে রেখেছে গান আর বই। আর জল। জলের গল্প অনেক। জল তাকে দিয়েছেও নানা কিছু।
ছোট্ট থেকে গান গায় সে। একা একা। পরে তালিম নেওয়া শুরু করেছে পণ্ডিত ভাস্কর পাটিলের কাছে। মা আর সে একসঙ্গে শিখতে যেত আগে। এখন মা সময় পায় না একদম। সকালে যেদিন রেওয়াজে বসতে পারে, এই জিনিসটাকে সে বুঝতে পারে— সেই জিনিসটা যে, তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সুরের আসনে থাকা, সেই কি ঈশ্বর? যদি ঈশ্বর নাও হন তবু সে শুধু জানে, এই ঈশ্বর তাকে মুক্তি চেনাবেন একদিন। নিশ্চিতভাবেই। তিথির মতো এ তাকে ছেড়ে যাবে না। বিচ্ছেদহীন এক জগত তার জন্যে অপেক্ষা করছে এখানে। এবং এখানেই।
আর তাকে ডাকে এক অদেখা ঝাউবন। সারাদিন সেখানে নির্জনতার হাওয়া বয়ে যায়। আধোচেনা কুয়াশা দামালপনা করে। নেমে-আসা মেঘ লুকোচুরি খেলে। রোদ্দুর খাপ পেতে বসে থাকে পাতার বিছানায়। আর তার পাশেই থাকে জল। সরোবর— আর সেই জলের নীচের শান্তি তাকে হাতছানি দেয়। এমনকী ঘুমের মধ্যেও।
এই ঝড়ের দিনটাই তার জীবনকে পালটে দেওয়ার নাবিক। ওই দিন দুপুরেই সে ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করে নিজের ভাবনা। আর বিকেলের মধ্যেই পাঁচশো লাইক। দুশো কমেন্ট। তার মধ্যে দেড়শোটাই থ্রেট। হুমকি ও গালাগাল। পোস্ট ভ্যাইরাল।
শমীন্দ্রসিংদেও
আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো ছবির অ্যালবাম আছে। খুব পুরনো। আগেকার দিনের অ্যালবাম যেমন হত, তেমন। পাতা উলটে উলটে ছবি দেখতে হয়। বেশিরভাগই সাদা-কালো, অল্প কয়েকটা রঙিন। ছোটবেলা থেকে আমি ছবি দেখতে ভালবাসি। কাজের সময় জ্বালাতন করলে, ঠাম্মা আমাকে ওই অ্যালবামগুলো ধরিয়ে দিয়ে বসিয়ে রাখত। তখন মা বাড়িতে থাকত না। আমি শান্ত হয়ে বসে বসে ছবি দেখতাম। ওই অ্যালবামগুলোতে এমন অনেকের ছবি ছিল, যাদের আমি চিনতামই না। একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি ছিল। সাদাকালো ছবি। মাথায় দুটো ঝুঁটি করা, আঙুলগুলো এমন ভঙ্গিতে যেন প্রজাপতির পাখা ধরে আছে। আমার ভারি মজা লাগত ওই ছবিটা দেখে। ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, ঠাম্মাও জানে না ওটা কার ছবি! মনে হয় ঠাকুরদার দিকের কোনও আত্মীয়ের। ঠিক জানা যায়নি। এরম তিন-চারটে ছবি আছে যারা, কে আর কী সূত্রে আমাদের পারিবারিক অ্যালবামে তাদের ছবি আছে তা জানাই যায় না!
আমি একটু বড় হতে না হতেই, ওই অ্যালবামগুলো হারাতে থাকল। তখন থেকেই আমি-দাদা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে শুরু করে দিলাম। মুশকিল হল, এখনও মাঝে মাঝে অনেকটা সময় একলা থাকতে হলে, ওই ছবিগুলো মাথার মধ্যে হানা দেয়। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ছবির মানুষগুলোর পরিচয়। আসলে অজানা, রহস্যময় ব্যাপার-স্যাপার ছেলেবেলা থেকেই আমাকে টানে। আজকাল তো ওই রকম অ্যালবাম দুনিয়া থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছে। ডিজিট্যাল ছবি থেকে হার্ড কপি ক’জন আর করে! বেশিরভাগ ছবিই সফট কপি। আমার এটা ভালো লাগে না। আসলে ছবি দেখতে ভালবাসি বলেই ফেসবুক আমার এত প্রিয়! ইনস্ট্রাগ্রামও ভাল লাগে এই একই কারণে। অজানা-অচেনা লোকগুলো দুনিয়ার কোথায়-না-কোথায় বসে আছে, আর আমি ঘরে বসে গল্প করে যাচ্ছি তাদের সঙ্গে! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আমাদের অ্যালবামে যে সব অচেনা লোকদের ছবি আছে, তাদের ছবি ফেসবুক-এ পোস্ট করে দি। দেখা যাক– কেউ যোগাযোগ করে কিনা। এই ব্যাপারটা অবশ্য এখনও করা হয়নি। তার আগেই দাদাটা এমন ঝামেলা বাঁধিয়ে বসল।
দাদা আগে এত ফেসবুক করত না। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপারটাই ওর অপছন্দ ছিল বরাবর। বলতে গেলে, আমিই দাদাকে ধরে বেঁধে ভার্চুয়াল জগতে নিয়ে আসি। প্রোফাইল খুলে দিই। ও বলত, ‘অচেনা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব? ও আমি জীবনে পারবো না’। দাদা মুখচোরা খুবও। কথাই বলতে চায় না তেমন। যারা কম কথা বলে, তাদের নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় খুব। তাই ওকে ঠিক মতো বোঝাও মুশকিল সবার পক্ষে। দাদা চারপাশের চেনা –জানা মানুষদের থেকে একদম আলাদা। এবং ওর বাবা আলাদা। ওর চেহারা অন্যরকম। মানুষটাও। সেই ছোট্ট বেলার পুচকে দাদাও একদম আলাদা ছিল। মনে আছে, একবার ওদের স্কুলে রচনার টপিক দিয়েছিল, বড় হয়ে কী হতে চাও। ও তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। দাদা লিখে এসেছিল, ও বড় হয়ে কাগজ কুড়াতে চায়। সবাই অবাক! কেন? না, একখানা বস্তা ছাড়া আর কিছু মূলধন লাগবে না তাই। বাড়িতেও খুব হাসাহাসি করেছিল। দাদা করুণ মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একা একা। শেষটায় মা কোলে নিয়ে অনেক আদর করতে তার মুখে হাসি ফোটে।
দাদার বাবা যে আমার বাবা নয়, তা আমার কাছে এক বড়ো আবিষ্কার। এই ব্যাপারটা বুঝতে অনেকখানি সময় লাগে। এই ঘটনাটা আমার ছেলেবেলার মনের অনেকটা অংশেই সুনামির মতো আছড়ে পড়ে। অনেকখানি ভাঙাচোরাও হয়। দাদাভাই মানে ঠাকুরদার কাছ থেকে আমি জানতে পারি এ ব্যাপারটা। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম দাদাভাইয়ের ঘরে। স্কুল থেকে ফিরে ওই ঘরেই আমরা দুই ভাই ঘুমাতে যেতাম। ঠাম্মা চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে গান গাইত।
সেদিন ঘুম আসছিল না বলে মটকা মেরে শুয়েছিলাম। ছটফট করলেই ঠাম্মা পাখার বাড়ি দিত বলে চোখ বন্ধ করে রাখতাম জোর করে রাখতাম। সেদিনও ঐভাবেই শুয়ে থাকতে থাকতে, শুনতে পেলাম, ঠাম্মা দাদাভাইকে বলছেন ,
— আমাদের রণোর কীরকম মুখটা শুকনো থাকে আজকাল দেখেছো?
— দেখেছি। কী করব বলো? ছেলেটা জীবনের উজ্জ্বল দিক তো বেশি দেখেনি।
— হ্যাঁ। বাবাকেও পেল না। তার ওপর চোখের সামনে ঐভাবে মৃত্যু! সেই ছেলেবেলায় দিনের পর দিন অভাব-অনাহার! কতদিন ঠিক করে খায়ওনি। আহা ! ভাবলেও বুকে কষ্ট হয় আমার।
— এখন আর তুমি অত ভেবে করবে কী? জানোই তো ওর বাবার নানা বদ গুণ ছিল। বাদ দাও।