শেষ আপডেট: 18th June 2022 11:34
(৮)
কেন এই রাগ? ধর্ম, সে কী এমন ব্যাপার যা একেবারে অন্ধ করে ছাড়ে লোকজনকে? শতকের পর শতক ধরে হত্যা ছাড়া যে অন্য কোনও ভাষা শেখাতে পারল না মানুষকে— তার জন্য কীসের এত মোহ? বোঝে না সে।
রণো সাইকেল চালিয়ে যখন পৌঁছোয়, তখন সূর্যদেবের জটা থেকে আগুন নেমে আসছিল মাটিতে। গাছের নীচে বসে সে ল্যাপটপ অন করে লেখা শুরু করে। বিকেল নাগাদ যখন ঝড়টা ঝামড়ে পড়ল, এলোচুল উড়িয়ে আর কালো কাজল পড়া মেঘ নিয়ে, সে মাথা তুলে একবার দেখেই ছুট লাগিয়েছিল মাথার ওপর একটা নিরাপদ আচ্ছাদনের জন্য। এদিকে শালবনের সে কি মোহময় আন্দোলন! পাখিদের উড়ন্ত দৌড় –লাল ধুলোয় ঢেকে যাওয়া বাতাস –পাতাদের নাচ - এসবের মধ্যে সে পাগল হয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করে। শ্যামবাটির মুখে এসে একটা চায়ের দোকানে যখন সে বসতে পারে, ততক্ষণে তার সর্বাঙ্গ ভিজে চুপচুপে। ল্যাপটপটা ব্যাগপ্যাকে ছিল বলে ভেজে নি। তার মাথা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরছে দেখে চায়ের দোকানের মালিক রামদা একটা শুকনো গামছা এগিয়ে দেন। (Bengali Novel)
— আরে তুমি তো একদম কাকভেজা হয়ে গেছ রণোবাবা!
— কী আর করবো বল, সাইকেল চালাতে চালাতে তো আর ছাতা মাথায় দেওয়া যায় না! তাছাড়া ছাতা নিয়ে বেরনোর অভ্যাস নেই। বলে কতবার যে ছাতা হারিয়েছি তার ঠিক নেই।
— দাঁড়াও একটা গামছা এনে দি। মাথাটা মুছে নাও। এই জলে আবার জ্বর এসে যায়।
— আদা দিও তো চায়ে।
— সে তোমাকে বলতে হবে না।
রামদা খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার এ চত্বরের। এর কথা সে লিখে পোস্টও করেছে ফেসবুকে। রামদার জন্ম এক সাঁওতাল পরিবারে। খুব ছোটবেলায়, যখন বয়েস মাত্র বছর চারেক, রামদার বাবা-মা বিষাক্ত হাঁড়িয়া খেয়ে মারা যায়। পলাশতলিতে সে সময় এক খ্রিষ্টান পাদরি এসেছিলেন কোন একটা কাজে। তিনিই অনাথ শিশুটিকে নিয়ে গোয়া চলে যান। রামদার নাম হয়, রাম গোমেজ। স্কুল ফাইন্যাল পাশ করার পর সে ফিরে আসে জন্মস্থানে। ওই পাদরি সাহেবই তাকে দেশ-ঘরের ঠিকানা দেন। কিছু টাকাও দেন সঙ্গে। সেই টাকা দিয়ে ক্যানেল রোডের মুখে রামদা চা-টোস্টের দোকান দেয় বছর কুড়ি আগে। মাঝে মাঝে সে সাহেবকে দেখতেও যেত। তিনিও মারা গেছেন প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। রামদা কিন্তু নিয়মিত চার্চে যায় রবিবার করে। আবার নামটাও সেই একই আছে। রাম গোমেজ। কী আশ্চর্য তাই না? রামদা মানুষটি বিয়ে-থা করেনি। খুব স্নেহপ্রবণও বটে। এইসব কথা সে নানা সময়ে ওর মুখ থেকেই শুনেছে।
চায়ের দোকানে সে বসে থাকে আরও ঘণ্টাখানেক। লাল চা খায় বার-দুই। নিমকি বিস্কুটও। ঝড় থেমে গিয়ে বৃষ্টি নেমে গিয়েছিল তখন। মোবাইল সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি বলে বাড়িতে খবরও দিতে পারেনি। মোবাইল ব্যাপারটাই তার সয় না। মায়ের আবদারে একটা নিতে হয়েছে বটে। কিন্তু জিনিসটা সুবিধের নয়। বাথরুমেও যে বস্তু মানুষকে শান্তিতে কমোডে অব্দি বসে থাকতে দেয় না, তাকে কি ভালবাসা যায়? এখন কেবল, মাঝে মাঝে ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ চেক করতে গেলে, কাজে লাগে। যদিও সে ল্যাপটপ থেকে কাজ করতেই পছন্দ করে। ভাই সারাদিন ফোন নিয়ে কাটিয়ে দেয় বলে তাকে সে বকাবকি করে প্রায়ই। ভাই কথা শোনে না। এই ভাইটি— তার অত্যন্ত দুর্বলতার জায়গা। হাসপাতাল থেকে মা যখন ন্যাড়া মাথার সোনালি রঙের পুতুলের মতো বাচ্চাটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল, তার তখন বয়েস সাত। অবিকল বেড়ালছানার গলায় কাঁদত ভাই। সারাক্ষণ ঘুমাতো, আর জেগে উঠলেই কান্না। মা বলত, এটা কোলে ওঠার কান্না। সে অবাক হয়ে ভাবত, আচ্ছা, তার কোলে উঠবে বলে, কাঁদছে ভাইটা?
প্রথম দিন পনেরো মায়ের ঘরে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবু সে সবসময় ওই ঘরের সামনেই ঘুরঘুর করত। মায়ের থেকে দূরে থাকার এই দিনগুলোতেই সেই ঘটনাটা ঘটে। একদিন হরির বউ তাকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে বলেছিল, “এইবার তোমার আদর কমে যাবে এ বাড়িতে। আপন রক্তের জন এসে গেছে কি না! তুমি একদম দুষ্টুমি করো না আর রণোবাবা। তাহলেই তোমাকে বনে ছেড়ে দিয়ে আসবে দাদাবাবু”। ঠাট্টার ছলে বলা এই কথাগুলো একেবারে শেলের মতো বিঁধল তাকে। সে তবে কে? বাবাই যে তাকে ‘রণোবাবা’ বলে আদর করে? বাবাইয়ের কোলে না উঠে তার দিন যায় না! সেই বাবাই তাকে বের করে দেবে? দিতে পারবে?
— আমি কি বাবাইয়ের আপনার নই? আমি তবে কে?
— তোমার বাবা তো আলাদা গো। তুমি দাদাবাবুর সৎ ছেলে যে!
— সৎ ছেলে কী জিনিস, বউ?
— জানি নে বাপু। তাড়াতাড়ি খেয়ে উদ্ধার কর। রাজত্বের কাজ পড়ে আছে এখনও।
সৎ ছেলে এবং ‘বনে ফেলে দিয়ে আসার’ বিষয়টা তাকে তাড়া করে এমন যে বিকেল থেকে জ্বর আসে তার। ভয়ে। বুলবুলিদির মাকে বুলবুলিদির বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল। বুলবুলিদিরা তাদের তিনটে বাড়ি পরে থাকে। সেই রাতে প্রান্তিক স্টেশনে বুলবুলিদির মায়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাকে যদি বাবাই তাড়িয়ে দেয় তবে কী হবে? সেও কি মরে যাবে? মরে যাওয়া কী জিনিস সে তো জানে। খুব ছোটবেলায় ‘বাবা’ বলে একজন ‘মরে’ গিয়েছিল। মা বলেছিল, মরে গেলে আর কেউ ফিরে আসে না। আকাশের দিকে উঠে যায়। যারা ভাল তারা, তারা হয়ে থাকে, আর যারা দুষ্ট, তারা হারিয়ে যায়। সেই ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতার মেয়েটার মতো। সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হারিয়ে যাওয়া-র মেয়েটা তো দুষ্টুমি করেনি। তাহলে?
— ও একা একা ছাদে গিয়েছিল তো। বাচ্চাদের তো রাতের বেলা একা যেতে নেই ছাদে। সেটাই দুষ্টুমি।
সে ঠিক করে ফেলেছিল দরকার নেই বাপু ছাদে গিয়ে। সে কখনও ওরকম করবে না। হারিয়ে যাওয়ার খুব ভয় তার।
হরির বউ-এর কথায় তাই শিশু রণো ভয় পেয়ে যায় খুব। জ্বর এসে যায়। লাফিয়ে লাফিয়ে পারদ চড়তে থাকে। রাজর্ষি বাড়ি ফিরে হাসপাতালে নিয়ে যান তাকে। সঙ্গে যান তাঁর মা। ইরাবতীর পক্ষে শমীকে ফেলে বাড়ি থেকে বেরোনো সম্ভব ছিল না। খুব সিরিয়াস কিছু হয়নি বলে, হাসপাতাল থেকে ওষুধ-পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
‘সৎ বাবা’— শব্দটার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় তার। এ আসলে বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্রাকচারের কূটনীতি। যা যুগযুগ ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছে অনেকটা ভাইরাসের মতো। পরিবারগুলোতে এইসব ভাইরাস জল-বাতাস পেয়ে বেঁচেবর্তে থাকে।
লাভ কী এতে হরির বউয়ের? কিছুই না। শিশুটির প্রতি শ্রেণিগত হিংসা। একজন আশ্রিতের, অপর আশ্রিতের প্রতি অসূয়া! যা হরির বউ অবচেতনে বহন করে চলেছে। এতে তাকে বিশেষ দায়ী করাও যায় না। বহুকাল ধরে চলে আসা, এই মনোভাব বদলানো সহজ কাজ নয়। এসব সে বড় হতে হতে বুঝে গেছে।
এবার উঠতে হবে। বৃষ্টি ছেড়ে গিয়ে আকাশ ভরে তারা উঠে গেছে।
— এবার যাই রামদা। অনেক দেরি হয়ে গেল।
— যাও বাবা। মা চিন্তা করছেন। বাড়ি যাও। সাবধানে যেও।
সাইকেল নিয়ে একটু এগোতেই প্রকাশের সঙ্গে দেখা। রণোর ইস্কুলের বন্ধু। কলকাতার ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ শেষ করেই কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়ে একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ পেয়েছে। সপ্তাহান্তের ছুটিতে বাড়ি আসে। দেখা হলেই দুই বন্ধুতে জোর গল্প জমে। কিন্তু আজ তার আড্ডা দেওয়ার মুড নেই। প্রকাশকে নিয়ে বরং বাড়ি যাওয়া যাক!
— কী রে! আজই এলি নাকি?
- না রে! জ্বর হয়েছিল। কলকাতার প্যাচপ্যাচে গরম আর সহ্য হচ্ছিল না। একেবারে সোমবার ফিরবো।
- চল, বাড়ি যাই। আড্ডা দেব। অনেকক্ষণ বেড়িয়েছি। একবার বাড়িতে ঢুঁ না মারলেই নয়। মা খুব টেনশন করবে।
- এই রণো, তুই ফেসবুকে কি পোস্ট করেছিস রে?
সে থমকে গেল।
— পড়েছিস?
— হ্যাঁ।
— তবে আবার জিজ্ঞেস করছিস যে বড়?
— তোর ওপর লোকে রেগে যাচ্ছে খুব কিন্তু!
— আমাকে তো সাপোর্টও করছে অনেকে। দেখেছিস কত লাইক?
— তুই পড়েছিস কমেন্টগুলো?
— পড়েছি।
— তাহলে?
— তাহলে আর কী? আমি ভয় পাই না রে! লিখতে আমাকে হবেই।
— যাক গে! তুই সাইকেলে ওঠ। আর হাঁটতে পারছি না।