শেষ আপডেট: 12th February 2023 12:17
মৃত্যু ছিনিয়ে নেওয়া পর্যন্ত প্রিয়তমের হাত ছাড়েনি আতিত্তায়া, বেনজির প্রেমের অনন্য কাহিনি
রূপাঞ্জন গোস্বামী
“এখনকার প্রেম আবার প্রেম নাকি! প্রেম ছিল আমাদের সময়ে। তখন মোবাইলও ছিল না। হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না। সে ছিল চিঠির যুগ। প্রেম ছিল অনাঘ্রাত ফুলের মতোই সুন্দর। কিন্তু এখনকার প্রেম, ছিঃ ছিঃ, ঘেন্না ধরে গেল। রাস্তাঘাটে বার হওয়ার উপায় নেই। জন্মেই প্রেম, আরে বাবা একটু বয়েস হতে দে! কারও যেন তর আর সয় না।"
এ রকম বিদ্রুপ, রাস্তাঘাটে প্রায়ই শুনে থাকেন এ যুগের ছেলেমেয়েরা। কখনও উপেক্ষা করেন, কখনও রুখে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করেন। অনেকে আবার ভাবেন, সত্যিই কি তাঁদের যুগের প্রেম নিখাদ প্রেম নয়! সত্যিই কি এ যুগের ভালোবাসা দেহসর্বস্ব! কিন্তু তাঁরা খবর রাখেন না সর্বকালের সর্বযুগের কষ্টিপাথরে, অমর প্রেমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে আছে, এ যুগেরই এক বিয়োগান্তক প্রেমগাথা (Atittaya and Pooh Lovestory)।
[caption id="attachment_204328" align="aligncenter" width="711"] স্বপ্ন দেখার দিনগুলিতে পুহ আর আতিত্তায়া[/caption]
দেশটার নাম থাইল্যান্ড (Thiland)। সেখানে আছে একটি শহর, নাম সংখালা। সেখানে বাস আজও করেন এক যুবতী আতিত্তায়া (Atittaya) চুমকিউ। আতিত্তায়াকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন ২১ বছর বয়সি প্রেমিক পুহ চোকচাই কায়েউ (Pooh)। শহরের পার্কে আলাপ হয়েছিল দুই তরুণ তরুণীর। সেখান থেকে গভীর প্রেম। স্বপ্নের ডানায় উড়তে উড়তে কেটে গিয়েছিল তিন তিনটে বছর।
কত স্বপ্ন ছিল দু’জনের। বিয়ে করে সংসার পাতবে। চাকরি করবে না। একটা ফার্ম হাউস করবে। ফার্ম হাউসে সব ধরনের সবজি ফলাবে। থাকবে পশু খামার। খামারের মাঝখানে থাকবে একটা জলাশয়। তার মাঝখানে থাকবে একটি ছোট্ট বৌদ্ধ মন্দির। জলাশয়ের পাশেই থাকবে তাদের লাল টালি আর সাদা কাচের জানলা দেওয়া ছোট্ট একতলা একটি বাড়ি।
[caption id="attachment_204330" align="alignnone" width="300"] পুহের চোখে দেখা দিলো ক্যানসার।[/caption]
কিন্তু বেশিরভাগ প্রেমেই নিয়তি আর স্বপ্নের পথ আলাদা। হাসি খুশি প্রেমিক পুহের দু’চোখে দেখা দিয়েছিল রেটিনোব্লাস্টোমা (retinoblastoma)। সেখান থেকে মুখে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যানসার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এই সময় প্রেমিক বা প্রেমিকা তাঁর প্রিয়তম বা প্রিয়তমার থেকে দূরে সরে যান। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রেমিকা আতিত্তায়া আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল প্রেমিক পুহের শীর্ণ হতে থাকা হাত।
একদিন সরাসরি চলে এসেছিল পুহের বাড়িতে। পুহ-এর বাড়িতে থেকেই দিনরাত এক করে পুহের সেবা করতে শুরু করেছিল। পুহের কাঁধে রেখেছিল ভরসার হাত। মনোবল হারায়নি পুহ নিজেও। সে প্রভু বুদ্ধের একনিষ্ঠ সেবক। তার ধারনা ছিল প্রভু বুদ্ধের আশীর্বাদে হয়ত মিরাকল ঘটবে। আবার সুস্থ হয়ে যাবে সে। সংসার পাতবে আতিত্তায়ার সঙ্গে।
[caption id="attachment_204331" align="aligncenter" width="704"] প্রিয়তমকে ছেড়ে পালায়নি আতিত্তায়া[/caption]
ধীরে ধীরে পুহের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যানসার। বিষিয়ে যাওয়া টিউমারে ঢেকে গিয়েছিল চোখ। চোখে আর দেখতে পেত না পুহ। দৃষ্টি থেকে মুছে গিয়েছিল প্রেমিকা আতিত্তায়ার মুখ। গলা শুনে আতিত্তায়াকে চিনতে পারত পুহ। প্রিয়তমা বুঝত প্রিয়তমের মন। সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকত। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। খাবার আর ওষুধ খাইয়ে দিত। পরম মমতায় ক্যানসারের দগদগে ক্ষতে ব্যান্ডেজ করে দিত।
কিন্তু আতিত্তায়া জানত ফুরিয়ে আসছে তার প্রিয়তমের দিন। তাই সে এক মুহূর্তের জন্যও প্রিয়তমের কাছ ছাড়া হত না। পুহের খাটের পাশেই সারাদিন বসে থাকত আতিত্তায়া। মোবাইল ফোনে একটার পর একটা সেলফি তুলে রাখত পুহের সঙ্গে। পুহের সঙ্গে তার সংক্ষিপ্ত জীবনের শুরু থেকে শেষটা ধরে রাখতে চেয়েছিল সে। এটাই হবে তার বাকি জীবনের বেঁচে থাকার রসদ। প্রভু বুদ্ধের কাছে চলে যাচ্ছে তার প্রিয়তম। প্রভু বুদ্ধের পদতলে তার প্রিয়তম পুহকে পৌঁছে দেওয়ার আগে অবধি প্রিয়তমের অন্তিম যাত্রাপথের সঙ্গী সে। এটাই প্রভু বুদ্ধের আদেশ। বিয়ে করবে না আতিত্তায়া, বৌদ্ধমঠের সন্ন্যাসিনী হবে সে।
[caption id="attachment_204334" align="aligncenter" width="300"] ফুরিয়ে আসছে পুহ, জড়িয়ে থাকে আতিত্তায়া[/caption]
কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি আর কাজ করছিল না। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এন্ড স্টেজ ক্যানসার, তবুও আশা ছাড়েনি একমাত্র পুহ। সে নিরন্তর প্রভু বুদ্ধকে ডেকে চলেছিল। আতিত্তায়াকে বলেছিল, এত সহজে মরবে না সে। হাসি মজায় আদরে বাঁচতে চাওয়া পুহের মন ভরিয়ে রেখেছিল আতিত্তায়া। কিন্তু ক্রমশ বিছানার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল পুহ। আর উঠে বসতে পারত না।
মৃত্যুপথযাত্রী পুহের সঙ্গে একই বিছানায় শুতে শুরু করেছিল আতিত্তায়া। পুহের মলমূত্র নিজের হাতে পরিষ্কার করত। মৃত্যুপথযাত্রী পুহ, তার শেষ অবস্থাতে একটা কথা বলেছিল, “পৃথিবীতে একটাই ভাল কিছু দেখে গেলাম ও একটাই ভাল কিছু রেখে গেলাম। সে হল আমার আতিত্তায়া।”
[caption id="attachment_204336" align="aligncenter" width="300"] চলে গেছে পুহ, রয়ে গেছে আতিত্তায়া[/caption]
একদিন ভোর রাতে প্রিয়তমা আতিত্তায়াকে ছেড়ে পুহ চলে গিয়েছিল প্রভু বুদ্ধের কাছে। সেই মুহূর্তটাতেও আতিত্তায়ার হাতে ধরা ছিল ফুরিয়ে আসা পুহের হাত। আতিত্তায়ার গরম হাতের মধ্যেই পুহের শীর্ণ হাতের আঙুলগুলি ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কাঁদেনি আতিত্তায়া। জ্ঞান হারিয়ে পুহের পাঁজর বের করা বুকে লুটিয়ে পড়েছিল। প্রকৃতিও বুঝি কেঁদে ফেলেছিল সেই ভোরে। তাই বুঝি স্বপ্নভাঙা এক প্রেমকে অমর করে দিয়ে, আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে সেদিন ভেসে গিয়েছিল থাইল্যান্ডের সংখালা শহর।
লিকাইয়ের চোখের জলে আজও রামধনু আঁকে চেরাপুঞ্জির ‘নোহকালিকাই’ ফলস