শেষ আপডেট: 8th September 2023 15:14
আট দশক ধরে একের পর এক রেকর্ড ভেঙে অবিশ্বাস্য কেরিয়ার গড়েছেন তিনি। আট দশকে যাঁর কণ্ঠ, যাঁর ব্যক্তিত্বকে স্পর্শ করতে ভয় পায় জরা। তিনি কুহকময়ী আশা ভোঁসলে (Asha Bhonsle)। পারফরমেন্স কাকে বলে তা তিনি শাড়ি পরেও বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেখানে লাগেনি কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সার, অযথা ব্যান্ড-সম কোরাস বা অতি আলোর মিউজিক্যাল ঝলকানি। কণ্ঠতেই তাঁর জাদু।
আশা ভোঁসলে জড়িয়ে আছেন নয়ের দশকের পুজোর গন্ধ ঘিরে। পুজোর প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসত তাঁর গান 'চোখে চোখে কথা বলো', 'ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে', 'মাছের কাঁটা খোপার কাঁটা'। তাঁর কণ্ঠেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে কত নবীন প্রজন্ম হারমোনিয়াম টেনে গান শিখতে বসেছেন। আশা কিন্তু মারাঠি, বাঙালি নন। কিন্তু আশা বাঙালি বাড়ির বউ হয়েছিলেন। তবে তারও আগে থেকেই কলকাতাকে আপন করে নেন আশা। সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষের হাত ধরে বাংলা গানে আশার প্রবেশ। 'মনের নাম মধুমতী', 'আমি খাতার পাতায়', 'জীবন গান', 'নাচ ময়ূরী নাচ রে'। আশার ক্যাবারে গান অনেক পরে এসেছে।
আবার যে আশা বাঙালি নন, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুরুগম্ভীর রাবীন্দ্রিকতা খুব সহজে আপন করে নিয়ে তাঁর কণ্ঠে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে কারণে আশার কণ্ঠে আজও জনপ্রিয় 'জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ', 'বড় আশা করে এসেছি গো', কিংবা 'এসো শ্যামল সুন্দর'।
বলিউডে আশার কেরিয়ার গড়ে উঠেছিল তিন জন পুরুষের হাত ধরে। আশার নিজের প্রতিভা ছিল অবশ্যই কিন্তু এই তিন ব্যতীত আজকের আশা ভোঁসলেকে হয়তো আমরা পেতাম না। আশার জীবন-যৌবনে এই তিন জন যেমন দিয়েছেন অনেক কিছু, তেমন কেড়েও নিয়েছেন অনেক কিছুই। আবার এই তিন পুরুষের জন্যই হয়তো দিদি লতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন আশা।
আশার জন্ম ১৯৩৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন নাট্য-সঙ্গীত জগতের একজন খ্যাতনামা শিল্পী। তাঁর নিজস্ব যাত্রা ও নাটকের দল ছিল। মায়ের নাম সেবন্তী। সেবন্তী ছিলেন দীননাথের দ্বিতীয় স্ত্রী। বড় বোন লতা মঙ্গেশকরের, সেজ বোন হলেন আশা। মেজো বোন মীনা। আশার পরের বোন ঊষা আর ছোট ভাই হৃদয়নাথ।
[caption id="attachment_257630" align="aligncenter" width="581"]দীননাথদের আসল পদবি ছিল হার্ডিকর। কিন্তু তাঁদের আদি ভিটে ছিল গোয়ার মঙ্গেশী গ্রামে। মঙ্গেশকর কথাটা এসেছে এই মঙ্গেশীর বাসিন্দা হিসেবে। ঐ অঞ্চলের লোকরা নামের পাশে পদবীতে গ্রামের নাম ব্যবহার করতেন। দীননাথ যদিও চলে আসেন মহারাষ্ট্রের সাংলি রাজ্যে কিন্তু তিনি নামের পাশে গ্রামের নাম হিসেবে মঙ্গেশকর লিখতে শুরু করেন। বাবার কাছেই ছেলেমেয়ের সঙ্গীত শিক্ষা। গ্রামের মুক্ত বাতাসের সঙ্গে কণ্ঠের সা রে গা মা আত্মস্থ হত হৃদয়তন্ত্রীতে।
[caption id="attachment_257634" align="aligncenter" width="278"]কিন্তু আমকা বিপর্যয় আনল প্লুরিসি রোগে দীননাথের অকালমৃত্যু। অকুল পাথারে পড়ে যায় মঙ্গেশকর পরিবার। এমনই সময় বড় বোন লতা তাঁর ছোট ছোট ভাইবোনদের মুখ চেয়ে সংসারের হাল ধরেন। দীননাথের বন্ধু মাস্টার বিনায়কের সৌজন্যে লতা মঙ্গেশকর প্রবেশ করেন প্রথম প্লে ব্যাক গানের দুনিয়াতে। প্রথম গান 'কিতি হাসল' (১৯৪২) ছবিতে। কিন্তু গানটি এডিটিংয়ে বাদ পড়ে।
এর পরে মাস্টার বিনায়ক লতাকে 'পহেলি মঙ্গল গৌড়' ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। এই ছবিতে প্লেব্যাকও করেন লতা। এর এক বছরের মধ্যেই মারাঠি ছবি 'গজাভাউ'-এ একক গানে প্লেব্যাক করার সুযোগ পেয়ে যান লতা। দিদির গান রেকর্ডের এক বছর পরেই আশা প্রথম গান প্লেব্যাক করেন 'মাঝা বাই' মারাঠি ছবিতে, ১৯৪৩ সালে। গানটি ছিল 'চলা চলা নব বালা।'
মাষ্টার বিনায়ক এর পরে বম্বে চলে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন বন্ধুর মঙ্গেশকর পরিবারকেও। ১২ বছরের আশাও (Asha Bhonsle) তখন বড়দি লতাকে অনুসরণ করে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে গান গাইবেন বলে ভাবলেন। পিতার মৃত্যুর ছ'বছরের মাথায় মাস্টার বিনায়কের মৃত্যু লতা ও আশার জীবনে নিয়ে এল আবার বড় ঝড়। কিন্তু লতা ততদিনে বলিউডে নিজের জায়গা বেশ কিছুটা পাকা করে ফেলেছেন। বম্বেতে ফ্ল্যাটও কিনে ফেলেছেন লতা।
দিদিকে অনুসরণ করে বোন আশাও ইতিমধ্যে গানের জগতে ঢুকে পড়েছেন। আশা প্রথম দিকে লতার থেকে আলাদা কিছু গায়কী অনুসরণ করতেন। গীতা দত্তর ছাপ ছিল তাঁর গানে। সে সময়ে গীতা দত্ত, সুরাইয়া, সমসাদ বেগমরা বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে রাজ করছেন এবং তাতে বড় ভূমিকায় যোগ দিয়েছেন লতাও।
আশার পায়ের মাটি শক্ত করা এসময় খুবই কঠিন ছিল। লতার অনুরাগীদের মতে, এ সময়ে আশা সি গ্রেড ছবিতে গান গেয়ে বম্বেতে মাটি শক্ত করেন। তবে এমনটা সর্বতো ভাবে সত্যি নয় মোটেই। প্রথম দিকে কিছু এই ধরনের সিনেমায় গান করলেও, চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই আশা ভাল সংগীত পরিচালকদের নেকনজরে পড়েন।
লতা-আশা দুই বোনের প্রথম সংঘাত লাগে যেদিন লতার অজান্তেই লতার সেক্রেটারি গণপত রাও ভোঁসলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন আশা (Asha Bhonsle)। এই বিয়েকে প্রতিটি সিনে ম্যাগাজিন বিতর্কিত বিয়ে বলে বর্ণনা দিয়েছিল। স্ক্যান্ডেল হয়েছিল অনেক। লেখা হয়েছিল, মঙ্গেশকর পরিবারের কর্মচারীর সঙ্গে পালিয়েছিলেন আশা।
আদতে অবশ্য তা নয়। গণপত ছিলেন উচ্চবংশীয়, লতা মঙ্গেশকরের থেকেও বেশি সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। গণপত রাও ভোঁসলে লতার সেক্রেটারি হওয়ার আগে সরকারি চাকরি করতেন রেশন ইনস্পেক্টর পদে। সম্পত্তির অনুপাত অনেক বেশি ছিল লতার তুলনায় গণপতের। নাগপুরে গণপতরা যে বাড়িতে থাকতেন তা ছিল দশ হাজার বর্গফুট, যার ধারে-কাছেও যায় না লতার বম্বের ফ্ল্যাট।
আশা যখন ১৬ বছরের, তখনই একত্রিশ বছরের গণপতকে বিয়ে করেন তিনি। অসম বয়সের বিবাহ নিয়ে রটনা রটলেও এই বয়সের ফারাক তখনকার দিনে খুব অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু মঙ্গেশকর পরিবারের সঙ্গে আশার মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। লতা সবরকম সম্পর্ক শেষ করে দেন আশার সঙ্গে।
এদিকে আশা (Asha Bhonsle) ছিলেন গণপতের দ্বিতীয় স্ত্রী। কিশোরী-তরুণীর সন্ধিস্থলে থাকা আশার সৌন্দর্যে আকর্ষিত হয়ে তাকে বিয়ে করেন গণপত। আশা এ কথা জানতেন, কিন্তু এও জানতেন যে তাঁর স্বামী রাজবংশী। তাই শ্বশুরবাড়িতে তাঁর খাওয়ার অভাব কখনও হবে না। আশার শাশুড়িও তাঁকে খুব যত্নে রাখতেন।
গণপত ভোঁসলে ছিলেন লতার সেক্রেটারি, ফলে তিনি লতার সব অফার, পেমেন্ট, পাবলিক রিলেশন দেখতেন। এ সময়ে গণপতই লতার কাজের কিছু সুযোগ নিজের বউ আশাকে দিয়ে দেন। লতা যে কাজগুলি করতে চাইতেন না, গণপত সেই সব গানের অফার আশাকে দিয়ে দিতেন। এইভাবে বহু ছবিতেই আশাকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন গণপত।
এ সময়ে আশার গানের সংখ্যা ছিল পাঁচ বছরে তিনশো। একজন কিশোরী গায়িকার এত গান তা কিছু কম সাফল্য নয়।
বলাই বাহুল্য, এসব গানের সুযোগ হয়তো লতা কোনও দিন আশাকে ডেকে দিতেন না, কিন্তু গণপত আশার বলিউড প্লেব্যাকের পথ প্রশস্ত করে দেন। পাশাপাশি সম্পত্তির দিক থেকেও লাভবান হন আশা। অনেক বাড়ির মধ্যে সান্তাক্রুজের একটি এলাহি বাড়ি ছিল গণপতের, যেটির একটি তলা একসময় অভিনেত্রী সাধনাকে ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। সেই সম্পূর্ণ বাড়ি দ্বিতীয় স্ত্রী আশা ভোঁসলের নামে লিখে দেন গণপত।
বিয়ের সাত বছরের মধ্যেই থমকে গেল আশার (Asha Bhonsle) কেরিয়ার। আশা গণপতের তিন সন্তানের জননী হয়ে গেলেন তিনি। আশার কাছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভদ্রলোকের আইডল। হেমন্তর গলা রেডিওতে শুনেই আশার অবসর সময় কাটত। তাই আশা বড় ছেলের নাম রাখলেন হেমন্ত। পরে এ কথা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বলেনও আশা।
কিন্তু ছেলে হেমন্ত হওয়ার পরে মঙ্গেশকর পরিবারের সঙ্গে আশার আবার মিল হচ্ছিল, কিন্তু এসময়ে গণপত-আশার সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। কারণ গণপত চাইতেন না, আশা তাঁর দিদি লতার সঙ্গে মেলামেশা করুক। দু'বছর পর এল গণপত-আশার মেয়ে বর্ষা এবং তার দু'বছর পরে ছোট ছেলে আনন্দ।
এসবের পরে আশা যখন সংসারে ব্যস্ত, তখন লতা তাঁর কেরিয়ারে সবচেয়ে সফল সময় উপভোগ করছেন। এটা আবার সহ্য হত না গণপতের। অথচ তিন বাচ্চা নিয়ে আশার উপায় নেই কিছু ভাবার বা করার। এই সময়ে গণপত ও আশার অশান্তি চরমে ওঠে। তবে এ অশান্তির পেছনে এক তৃতীয় পুরুষও ছিলেন। এখন অশান্তির কারণেই সেই তৃতীয় পুরুষ সুযোগ পান নাকি সেই তৃতীয় জনের জন্যই অশান্তি বাড়ে, তা বলা যায় না।
সংসারের অশান্তিতে আশা মুক্তির স্বাদ খুঁজে পেলেন ওঙ্কারপ্রসাদ নায়ারের মধ্যে। আশাকে প্রথম সারির গায়িকার সম্মান দিতে এগিয়ে এলেন তিনি, সেসময়ে গোটা দেশের বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টর ওপি নায়ার। ওপি তখন বেশ কেতাদুরস্ত সাজগোজ করে আশার কাছে আসতেন। গণপতের সঙ্গে আশার ছিল বেশ বয়সের তফাত, ফলে গণপত তখন প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগোচ্ছিলেন। সেখানে ওপি যেন মুক্ত যৌবনের হাওয়া নিয়ে এল আশার মনে।
ওপি-র অসাধারণ সুর আর আশার (Asha Bhonsle) কণ্ঠ মিলে এক নতুন গানের ঝর্নাধারার যুগ শুরু হল বলিউডে। আর এই সময় থেকেই লতার পাশাপাশি উঠে আসতে লাগল আশার নাম।
ওপি প্রথম 'সিআইডি' ছবিতে আশাকে (Asha Bhonsle) দিয়ে একটি গান গাওয়ান। সে গান হিট হওয়ার পরেই আর আশাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ওপি নায়ারের তৎকালীন কাছের মানুষ ও এক্সক্লুসিভ গায়িকা হয়ে গেলেন আশা। এর পরে 'নয়া দৌড়' ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন আশা। মোট পঞ্চাশটি ছবিতে আশাকে লিড গায়িকা করেন গান গাওয়ালেন ওপি।
এই ওঙ্কারপ্রসাদ নায়ারের জন্যই আশা হয়তো লতার সমকক্ষ বা তারও বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারলেন। আশার গানের আলাদা একটা ফ্যানবেস তৈরি হল এ সময় থেকেই। তুমসা নেহি দেখা, কাশ্মীরকি কলি, হাওড়া ব্রিজ, মেরে সনম-এর মতো সব ছবিতে আশা সুপারহিট।
লতা কখনও ওপি-র সুরে গান গাইতে চাননি। কারণ লতা একদমই পছন্দ করতেন না তাঁকে। ওপি-র একটা মনোমোহিনী লুক ছিল। গায়ে সুগন্ধী দিয়ে, স্যুটেড-বুটেড সাজে ওপি মন জয় করতে পেরেছিলেন আশার (Asha Bhonsle)। আশার কেরিয়ারের অনেকটাও গড়ে উঠেছিল তাঁরই জন্য। কিন্তু লতা এসব দিকে হাঁটেননি।
গণপতের মতোই ওপি-ও কিন্তু বিবাহিত ছিলেন। ওপির স্ত্রী সরোজ মোহিনী ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। কিন্তু আশার প্রতি আকর্ষণে পতঙ্গের মতোই ছুটে গেলেন ওপি। আশাও দেখেছিলেন, তাঁর সফল কেরিয়ার, পরপর হিট ছবি এবং গণপতের বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হওয়া থেকে মুক্তির চাবিকাঠি এই মানুষটিই।
তাই ওপির ভরা সংসার দেখেও পরকীয়াতেই ডুব দিলেন আশা (Asha Bhonsle)। ১৯৫৮ সালে 'ফাগুন' ছবির সময় থেকে আশা-ওপির প্রেম নিয়ে কানাকানি শুরু হয়ে গেল। ওপি প্রকাশ্যে আশাকে নিজের বাগদত্তা বলে পরিচয় দিতেন। অন্যদিকে আশাও ওপির ছবি দেওয়া লকেট শাড়ির ওপর দিয়ে পরে ঘুরে বেড়াতেন। গণপত দেখলেন, যে কিশোরী মেয়েটিকে তিনি নিজে হাতে গড়ে তুললেন, সে এখন ওপির প্রেমে মশগুল।
এ সময়ে গণপত আশাকে ঘরবন্দি করে ফেলবেন বলে ভাবলেন। তিনি সাহায্য চাইলেন নৌশাদের। নৌশাদ পরামর্শ দিলেন, আশাকে ঘরে আটকে রাখতে এবং ওপির ফোন কেটে দিতে। গণপত তাই করলেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হল। আশা ব্যাগ গুছিয়ে তিন সন্তান নিয়ে তাঁর মায়ের বাড়ি চলে গেলেন এবং গণপতের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করে ডির্ভোস মামলা করেন। অত্যাচার যে ছিল না সেটা বললে ভুল হবে। মানসিক অত্যাচার অবশ্যই ছিল। আশার ভিতরেও উপরে ওঠার অদম্য জেদ ছিল। তাই সেখানে এই বিয়ে ভাঙা ও অন্য সম্পর্কে জড়ানো খুব একটা বড় ব্যাপার ছিল না। সিনেমা জগতে এগুলো চিরকালই জলভাত।
তবে এই সময়ে লতা তাঁর বোন আশা (Asha Bhonsle) এবং তাঁর বাচ্চাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। গণপতের থেকে মুক্ত হওযার পরে আশার জন্য আলাদা ফ্ল্যাট কিনলেন ওপি। তাঁরা দুজনে দশ বছর সেখানে লিভ ইন করেছিলেন। তাঁরা বিয়ে করেছেন গোপনে, এমনটাও গুজব ছড়িয়েছিল। যদিও আশা প্রকাশ্যে এসব কখনও বলেননি। ওপি-সহ সব মিউজিক ডিরেক্টরদের ছবিতে ক্যাবারে গানে আশা একমাত্র মুখ হয়ে উঠলেন।
কিন্তু যখনই ওপি-র নিজের কেরিয়ার পড়ন্ত বেলায় এল, তখনই আশা এবং ওপির অশান্তি শুরু হল। এ যেন ঠিক গণপত-আশা সম্পর্কের সিজন টু।
শোনা যায়, বোনের জীবনে এত সম্পর্কের ভাঙন দেখে লতা নিজেও আর বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। যদিও লতা কিছু বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টরের প্রতি দুর্বল ছিলেন, কিন্তু শেষ অবধি শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজের প্রেম সমর্পণ করেন লতা। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক, যে লতার যৌবনও ফুরিয়ে গেছিল ভাইবোনকে মানুষ করতে গিয়ে, তাঁদের প্রেম-অপ্রেম সামলাতে গিয়ে।
ওপি নায়ার যখন ফুরিয়ে যাচ্ছেন, তখন ময়দানে ঢুকে গেছেন রাহুল দেব বর্মণ। বাবার সহকারী হিসেবে হাত পাকাই ছিল তাঁর। এর পরে 'তিসরি মঞ্জিল' সিনেমায় আশার কণ্ঠে আরডি-র মিউজিক প্রথম সাফল্য পেল। এবার পঞ্চম ওরফে আরডি স্বমহিমায় দারুণ ভাবে রাজত্ব করতে শুরু করলেন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। আশাও (Asha Bhonsle) নতুন জীবনের স্বাদ খুঁজে পেলেন আরডি-র সঙ্গে।
কাজের জগতে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে গেলেও, ওপি কিন্তু চেয়েছিলেন আশাকে ধরে রাখতে। শেষ দিকে পজেসিভনেসে ভুগতেন ওপি। কিন্তু এবারও আশা বেরিয়ে এলেন ওপিকে অভিযুক্ত করে। সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন তিনি। অভিযোগ ছিল, তাঁর মেয়ে বর্ষার উপর ওপি মারধোর করেছে। তাই ওপি-র সংসার ছেড়ে আরডি-তেই মন সমর্পণ করলেন আশা। তখন আশা-আরডি জুটি একের পর এক হিট দিয়ে যাচ্ছে।
ওপি নায়ার আশাকে হারিয়ে বলেছিলেন, "যে আশাকে আমি তুলেছিলাম, সে একটা শো-তেও আর আমার গান গায় না। শুধুই আরডি যেন তাঁর সব।" এদিকে রাহুলের প্রথমা স্ত্রী রীতা প্যাটেলের মিউজিক সেন্স না থাকায় তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে দেন আরডি। অথচ একদিন রীতিমতো ডেটিং করেই আরডি তাঁর ফ্যান রীতাকে প্রেম নিবেদন করে বিয়ে করেছিলেন।
আশি সালে আরডি এবং আশা (Asha Bhonsle) বিয়ে করলেন। তাঁদের ভালবাসার সংসার শুরু হল। রাহুল ছিলেন আশার থেকে ছ'বছরের ছোট। বড় বড় বাচ্চা সমেত বয়সে বড় ছেলের বৌ খুব একটা মেনে নিতে পারেননি শাশুড়ি মীরা দেববর্মণ। শুধু কি তাই, বিয়ের দিনও নিন্দকদের মুখ বন্ধ করা যায়নি, "তিন সন্তানের মাকে বিয়ে করল রাহুল! শেষ পর্যন্ত টিকলে হয়।"
ফুলশয্যায় খুব ভয়ে ভয়ে সেকথা আদরের ‘বাবস’কে জানিয়ে আশার প্রশ্ন ছিল, "সবাই যা বলছে তেমনটা হবে না তো? তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যাবে না তো?" নতুন বউয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে 'বাবস' রাহুল আশ্বস্ত করেছিলেন, "দুনিয়া ছাড়লেও আমি তোমায় কোনও দিন ছেড়ে যাব না...ইয়ে ওয়াদা রহা।"
আশাও বাঙালি বৌমাই হতে চেয়েছিলেন মন থেকে। তাই বাঙালি রান্না থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালই প্রভাব ফেলেছিল পঞ্চম-আশার সংসারে। তবে প্রথম প্রেম বোধহয় মন থেকে মুছে যায় না কখনও। তাই রাহুলকে খাতায়-কলমে বিয়ে করার পরেও আশা ভোঁসলে পদবী পরিবর্তন করেননি। ওই নামে তিনি বিখ্যাত ছিলেন, সেটাও একটা কারণ।
কিন্তু আশা-আরডির এত সুখের সংসারও কিছু বছর পরে সেপারেশনের মুখে দাঁড়ায়। আরডি-র তীব্র মদের নেশা আশা এবং তাঁর সন্তানদের নাজেহাল করে দিত। অন্য বাড়িতে থাকতে শুরু করেন আশা। কেরিয়ারের শেষ দিকটা আরডি-ও ভাল কাজ পেতেন না। শেষ হাল ধরেন বিধু বিনোদ চোপড়া। '১৯৪২ লাভস্টোরি' সিনেমায় জীবনের শেষ এবং সেরা কাজটি করে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন আরডি। চিরবিচ্ছেদ হয়ে গেল আশার সঙ্গে।
শিল্পীর জীবন তো এরকমই। আশাকে অনেকে দোষারোপ করলেও, ভিলেন আসলে সময় ও পরিস্থিতি। আশা নিজের জীবনেও কম কষ্ট পাননি। চিরকাল লতার সঙ্গে তাঁর তুলনা চলেছে। সে জন্যই হয়তো তিনিও জেদ করে ফেলেছিলেন, একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে ছুটে গিয়েছেন সামনে। তাঁর নিজের প্রতিভার জোরের সঙ্গে জড়িয়েছেন ভরসাযোগ্য মানুষদের।
আশার (Asha Bhonsle) বড় ছেলে হেমন্ত পরে পাইলট থেকে মিউজিক ডিরেক্টর হন। তাঁরও বিবাহিত জীবনে প্রবল সমস্যা ছিল। শেষে ক্যানসারে মারা যান হেমন্ত। মেয়ে বর্ষাও অবসাদে তলিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। এখমাত্র আনন্দই মায়ের পাশে ছিল চিরকাল।
কয়েক বছর আগেই আশা বাংলায় পুজোর গান গাইলেন সেই পঞ্চমকে মনে করেই,
"দিনগুলো ভোলা গেল না,
আজও এখনও স্মৃতিগুলো মোছা হল না।
মন রাঙানো... বলেছিলে মনে রেখো
ভুলো না আমায় কখনও ....
তখনও এখনও এমন ভরানো তোমার গানের সুরে,
যখন তখন গেয়ে ওঠে মন থাকো না যতই দূরে।
এসো ওগো ফিরে এসো যদি আমায় ভালোবাসো...
আজও আছি তোমারই যেন।"
আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘কত না ভাগ্যে আমার’ বাংলার মেয়েদের মনের কথা বলে আজও