শেষ আপডেট: 4th June 2024 17:00
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের সভানেত্রী। জোড়াফুল দলটাই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত। শুধু তা নয়, বাংলার বর্তমান রাজনীতিতে তাঁর মতো রাজনৈতিক উচ্চতা ও জনপ্রিয়তা কারও নেই। তবু হয়তো তাঁর মধ্যেও উদ্বেগ ছিল। আগামী দিনে তৃণমূলের সংগঠনকে মজবুত রাখবে কে? নতুন প্রজন্ম কি পারবে জনভিত্তি ধরে রাখতে?
চব্বিশের জনাদেশ জানিয়ে দিল, মমতাকে চিন্তামুক্ত করে নতুন প্রজন্মের হাতে নিরাপদ তৃণমূল। এই সাধারণ নির্বাচন বহুবিষয়ে মাইলফলক হয়ে রইল বাংলার শাসক দলের কাছে। একে তো নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহর আধিপত্যবাদকে চরম শিক্ষা দিয়ে বাংলায় স্যুইপ করল তৃণমূল। আর সেই জয় অনেক বড় করে দিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
অভিষেক বয়সে নবীন। কিন্তু এই জয় প্রমাণ করে দিল, অভিষেক অনেক বেশি কৌশলী, রাজনৈতিক ভাবে পরিণত ও স্থিতধী। মোদী-শাহদের প্রবল আগ্রাসনের মুখেও নার্ভ ধরে রাখার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে আত্মবিশ্বাসী এই অভিষেক এখন আর শুধু বাংলার রাজনীতিক নন, এই ভোট সর্বভারতীয় স্তরের রাজনীতিতেও যথাযথ জায়গা করে দিল তাঁকে। তার কারণ পরিষ্কার। সংসদে তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে চল্লিশ ছাপিয়ে যেতে চলেছে। ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেস ও সপার পর তৃতীয় শক্তিধর দল হয়ে উঠেছে তৃণমূল। সেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মুখ জাতীয় রাজনীতির নজরে থাকাটাই স্বাভাবিক।
অথচ লড়াইটা কোনওমতেই সহজ ছিল না। তা শুধু দলের বাইরে নয়, বাধা ছিল ভিতরেও। মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার, একনাথ শিণ্ডেদের ডিগবাজি দেখে এক সময়ে এই বাংলার অনেকেই আন্দাজ করতে শুরু করেছিলেন, অভিষেকও বুঝি তেমনই সামারসল্ট দেখাবেন। কতটা জল্পনা, কল্পনা ডানা মেলেছিল এই বাংলাতেই। দ্বিতীয়ত, শুধু ইডি, সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে হেনস্থা হওয়া নয়, বিচারব্যবস্থার একাংশও এজলাসের বাইরে সরাসরি সমালোচনা শুরু করেছিলেন অভিষেকের। যার নেতৃত্বে ছিলেন সদ্য প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সর্বোপরি ছিল রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। যা অতিক্রম করা সহজসাধ্য ছিল না।
এহেন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে ক্রিজে টিকে থাকাই ছিল চ্যালেঞ্জের বিষয়। কিন্তু গত এক দেড় বছরে অভিষেকের কোনও সভা, কোনও সাংবাদিক বৈঠকে একবারের জন্যও মনে হয়নি, তিনি নুয়ে পড়ছেন। কোনও ব়্যাপিড ফায়ার রাউন্ডেও তাঁকে ক্লান্ত দেখায়নি। বরং যে ভাবে গলার স্বর চড়িয়ে তিনি কথা বলে গিয়েছেন, তাও অবাক করেছিল অনেককেই। বহু লোককে বলতে শোনা গেছিল, এত আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে কোথা থেকে? তাহলে কি সেটিং আছে?
বহিরঙ্গে সেই মেজাজ ধরে রাখার পাশাপাশিই দিদির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কৌশলে এগিয়েছিলেন অভিষেক। বিজেপির ধারণা ছিল, একশ দিনের কাজ, আবাস যোজনার মতো প্রকল্পের টাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দিলেই বুঝি তৃণমূলের ঘর ভেঙে পড়বে। সেই খেলাটাই ঘুরিয়ে দেন মমতা ও অভিষেক। বাংলার প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন দিল্লিতে ও কলকাতায়। মাঝে দিদির সঙ্গে কিছুটা মত পার্থক্যও হয় তাঁর। কারণ, অভিষেক চেয়েছিলেন এ ব্যাপারে পুজোর সময়েও ধর্না চালিয়ে যেতে। পরে সেই মনোমালিন্য কাটাতে কিছুটা সময়ও কেটে যায়। শেষমেশ বঞ্চনার অস্ত্রে শান দিয়েই প্রচারের মন্ত্র রচনা করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। মোদী-শাহকে দিল্লির জমিদার তথা সামন্তপ্রভু আখ্যা দেন। আর দিদি বাড়িয়ে দেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতার টাকা।
এই লোকসভা ভোটে এও দেখিয়ে দিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেকের মধ্যে তালমিলটাও এখন অসামান্য। দিদি যে ভরসা করে অভিষেকের হাতে অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন, তা স্পষ্ট হয়ে গেছিল ব্রিগেডের মঞ্চেই। দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছিলেন অভিষেক। তার পর গোটা নির্বাচনে দু’জনে সমন্বয় করে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন। প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রে দু’বার করে প্রচারে গিয়েছেন মমতা। অভিষেক গিয়েছেন দু’বার। ব্যতিক্রম বলতে ছিল হাতেগোণা কয়েকটি আসন।
পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, এই অভিষেক এখনও আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। তৃণমূলে সাংগঠনিক সংস্কারের জন্য তাঁকে দু’বছর আগেও দলের মধ্যে বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। এবার তাঁকে বাধা দেওয়া মুশকিল শুধু নয়, না মুমকিন।