শেষ আপডেট: 4th May 2024 11:16
অমল সরকার
কৃষ্ণনগর
‘দুটি বুথ পিছু একজন পালক। তাঁদের উপরে দশটি করে বুথের দায়িত্বে আছেন আর একজন পালক। অর্থাৎ তাঁর কাছে রিপোর্ট করেন পাঁচজন পালক। এইভাবে লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার জন্য আছেন একজন করে সাত পালক। সকলের উপরে আছেন লোকসভা পালক। সব স্তরেই পালকদের কাজ সব কিছু ঠিকঠাক চলছে কিনা দলীয় নেতৃত্বকে জানানো।’
বছর চল্লিশের যুবক এবার শক্তি কেন্দ্রর প্রসঙ্গ পাড়লেন। বললেন, ‘এবার প্রচারের প্রসঙ্গে আসি। পাঁচটি বুথ নিয়ে আছে একটি করে শক্তি কেন্দ্র। প্রতিদিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঁচ বুথ এলাকায় প্রার্থীর সমর্থনে পথসভা, মিছিল ইত্যাদি হচ্ছে। এগুলি সংঘঠিত করার দায়িত্ব এলাকার নেতৃত্বের। কৃষ্ণনগর লোকসভা এলাকায় আমাদের এমন ৩৯২টি শক্তি কেন্দ্র আছে।’
বক্তা প্রদীপ ঘোষ নদীয়া বিজেপির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল কৃষ্ণনগরে বিজেপির নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে। বেলা দেড়টা-দুটো বাজে। দুপুরের খাবার খেতে একে একে নেতা-কর্মীরা ফিরছেন। তার মাঝে কথা থামিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মিডিয়া কনভেনর সন্দীপ মজুমদার বললেন, ‘শরীর আর দিচ্ছে না। দিনে চাঁদিফাটা রোদ মাথায় ছুটতে হচ্ছে। তার উপর রোজ রোজ রাত জাগা। গতকালও রাত তিনটেয় বাড়ি ঢুকেছি।’ জানতে চাইলাম, কৃষ্ণনগরের ভোট তো দেরি আছে। এখন থেকেই রাত জাগছেন! জবাব এল, ‘বুঝতেই পারছেন, আমরা কোমর বেঁধে নেমেছি, রাজমাতাকে দিল্লি পাঠাব বলে। বুথ ধরে ধরে সব কাজ বুঝে নিতে রাত গড়িয়ে যাচ্ছে।’ জেলা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক নেতা এসেছিলেন পার্টি দফতরে। তিনি যোগ করেন, ‘জুলুবাবুর পর এবার রানিমার হাত ধরে আবার কৃষ্ণনগর বিজেপির দখলে আসবে।
জুলুবাবু মানে বিশিষ্ট আইনজীবী প্রয়াত সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় দু’বার কৃষ্ণনগর থেকে জিতে অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য হন। স্বল্পসময় বিজেপির রাজ্য সভাপতিও ছিলেন।
অন্যদিকে, কৃষ্ণনগরের এবারের বিজেপি প্রার্থী রানিমা অর্থাৎ অমৃতা রায়ের পরিচয় ইতিমধ্যে সকলে জেনে গিয়েছেন তাই শুধু নয়, বিতর্কও বাঁধিয়েছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পরিবারের পুত্রবধূ। একে তো কৃষ্ণনগরবাসীর একাংশের তাঁকে রানিমা সম্মোধন করা নিয়ে আপত্তি। তার উপর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সুরে সিরাজদৌল্লার চরিত্রহনন করে বিতর্ক বাঁধিয়েছেন। রীতিমতো গর্ব করে তিনি বলে বেড়াচ্ছেন, হিন্দুধর্মকে রক্ষা করতে পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে অন্তত সিরাজকে নিয়ে রানিমার কথায় গলা মেলাচ্ছেন না। এক নেতার বক্তব্য, ‘বাস্তবটা বোঝা দরকার। সত্য-মিথ্যা যাই থাক, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ সিরাজকে শ্রদ্ধা করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরায়।’ তপ্ত দুপুরে নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে কাজ করছিলেন বিজেপির নদীয়া জেলার প্রাক্তন সভাপতি প্রবীন কল্যাণকুমার নন্দী। তিনি বর্তমানে দলের জাতীয় পরিষদের সদস্য। রাজবাড়ি লাগোয়া তাঁর বাড়ি। অমৃতা রায় তাই প্রতিবেশী। তাঁর কথায়, ‘সিরাজ বৃতান্তে আমরা নেই। সিরাজদৌল্লা, লর্ড ক্লাইভ কিংবা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কেউই নির্বাচনে প্রার্থী নন।’ জেলা পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ ঘোষও বলেন, ‘সিরাজ প্রসঙ্গ আমরা প্রচারে বলছি না। কৃষ্ণনগরে দাদা কীর্তির পর দিদির কীর্তি শুনতেই মানুষের আগ্রহ বেশি। আর বলছি জুলুবাবুর কাজের কথা। ওঁর পর কৃষ্ণনগরের জন্য আর কেউ কাজ করেননি।
'দাদার কীর্তি', বলতে প্রদীপবাবু প্রয়াত অভিনেতা তথা কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের কথা বোঝাতে চাইলেন। তাঁর অকথা-কূকথায় একটা সময় দলের লোকের ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। আর দিদির কীর্তি মানে মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ চলে যাওয়া। তবে কথা বলে বোঝা গেল, বিজেপি বেশি ভরসা করছে মহুয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প ও ছবির উপর। প্রদীপ ঘোষের কথায়, 'আমরা সংসদ কাণ্ডের কথা বলছি। আর ওনার জীবনযাত্রা নিয়ে যা বলার মানুষ বলছে। সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটলেই সব জানতে পারবেন।'
বিজেপির জেলা নেতারা যাই বলুন না কেন, রানিমা কিন্তু সুযোগ পেলেই সিরাজের মুণ্ডপাত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। প্রশ্ন লুফে নিয়ে জবাব দিচ্ছেন। সিরাজ সম্পর্কে এমন কথা বলছেন যা অশান্তি বাঁধিয়ে দিতে পারে যে কোনও মুহূর্তে, মনে করছেন দলের একাংশ।
তাতে হিন্দু ভোটের মেরুকরণের সুবিধার দিকটি উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই। কিন্তু জেলা বিজেপি নেতাদেরও অজানা, রানিমাকে সিরাজ নিয়ে সরব হওয়ার পরামর্শ কে জোগাচ্ছে।
যেমন অজানা কে বা কারা তাঁর নাম প্রস্তাব করলেন। জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ ঘোষ, জাতীয় কর্ম পরিষদের সদস্য কল্যাণকুমার নন্দীরও জানা নেই এই প্রশ্নের উত্তর। কল্যাণবাবুর কথায়, ‘২০১৪-তে আমি জেলা সভাপতি থাকাকালে ওঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। উনি রাজি হননি। এবার কার কথায়, কেন রাজি হয়েছেন বলতে পারব না।’ প্রদীপবাবুর কথায়, ‘আমাদের কাছে কোনও নামই চাওয়া হয়নি। আর চাইতেই হবে, এমন কোনও নিয়ম পার্টিতে নেই। লোকসভা মানে সবটাই দিল্লির ব্যাপার।’ কথায় কথায় প্রদীপবাবু আরও বললেন, ‘মাস দুই আগে কৃষ্ণনগরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার সিদ্ধান্তও ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। আমাদের শুধু দিন-তারিখ জানানো হয়েছিল।
প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার না করলেও দলের অন্দরে মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে রানিমা স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর প্রার্থী। সন্দেশখালির রেখা পাত্রকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন করার কারণ বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কৃষ্ণনগরের অমৃতা রায়কে কেন ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী? জেলা বিজেপি নেতাদের কাছে এর জবাব নেই। তবে রাজমাতাকে জিতিয়ে দিল্লি পাঠাতে প্রাণপাত করতে হবে,৷ বুঝে গিয়েছেন পদ্ম শিবিরের নদীয়ার নেতারা।
শুক্রবার মোদী ফের সভা করে গিয়েছেন কৃষ্ণনগরে। শনিবার সভা করবেন যোগী আদিত্যনাথ। আসবেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশিথ প্রামাণিক। বিজেপির অঙ্ক স্পষ্ট, মহুয়া জিতে গেলে নাক কাটা যাবে দলের। আর দু মাসের ব্যবধানে কৃষ্ণনগরে মোদীর দু’বার সভা এবং রানিমাকে ফোন করা থেকে স্পষ্ট মহুয়াকে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে দিয়ে হারাতে চান প্রধানমন্ত্রী। রানিমা হেরে গেলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ পুড়বে। দলের একাংশ মনে করছে দলের পুরো কেন্দ্রীয় ব্রিগেড কৃষ্ণনগরে মোতায়েন করা হবে। ভোট সেখানে ১৩ মে।
প্রশ্ন হল, তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে মোদীর অঙ্কটা কী? বিজেপিতে রাজ পরিবারের সদস্যদের নেতা-সাংসদ-মন্ত্রী করা নতুন কিছু নয়। দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন গোয়ালিয়লের রাজমাতা বিজয় রাজে সিন্ধিয়া। যদিও গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া আর কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বংশের ধার-ভার সমান নয়। অনেকেরই ধারণা, রাজা তথা জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের বধূকে সংসদে পাঠিয়ে বিজেপি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌলার সময়ের ভিন্ন বর্ণনা তুলে ধরতে পারে, যেমনটা বলছেন কৃষ্ণনগরের দলীয় প্রার্থী অমৃতা রায়।