Advertisement
তমলুকে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জোর লড়াইয়ের প্রস্তুতি দেবাংশুর
Advertisement
শেষ আপডেট: 10 May 2024 18:59
এই মুহূর্তে দেশের তরুণতম সাংসদ চন্দ্রাণী মুর্মু। উনিশের ভোটে মাত্র ২৬ বছর বয়সে ওড়িশার কেওনঝড়ে জিতেছিলেন এই তরুণ নেত্রী। লোকসভার ইতিহাসে তাঁর চেয়ে কম বয়সে সাংসদ হয়েছিলেন দুষ্মন্ত চৌতালা। দেবাংশু ভট্টাচার্যের বয়স ২৮। জিততে পারলে অষ্টাদশ লোকসভায় বাংলা থেকে তরুণতম সাংসদ হতে পারেন তিনি।
ব্যাপারটা কি বাড়তি উৎসাহ দিচ্ছে? ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পাঁশকুড়ায় প্রচারে ছিলেন দেবাংশু। বাতাসের আর্দ্রতা চরম। গায়ের পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে সপ সপ করছে। বললেন, "আমার তো খুবই ভাল লাগছে। দল মনে করেছে, দেবাংশু পারবে। তৃণমূলকে যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন, তাঁদেরকে এটা সপাট উত্তর। আমার তিন কূলে কেউ রাজনীতিতে নেই, তারপরেও শুধুমাত্র দলের কর্মী হিসেবে যে লোকসভার মত সর্বোচ্চ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া যায়, এটা তো আমার দল বলেই সম্ভব হয়েছে।"
বাংলার রাজনীতি এতদিনে বিলক্ষণ জানে তমলুকে দেবাংশুকেই কেন ভোটে লড়ার জন্য পাঠিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিয়োগ মামলায় চোখা-চোখা পর্যবেক্ষণ জানিয়ে একদা সাধুবাদ কুড়িয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কেউ কেউ তাঁকে ভগবান জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন। অথচ তিনি যে বিচারপতির আসনে থাকাকালীন তলে তলে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন কে জানত! মমতা-অভিষেক সেই সুযোগটাই নিয়েছেন। আদালতের রায়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি বাতিল হওয়ার পরিস্থিতিতে অভিজিতের সামনে এগিয়ে দিয়েছেন এক তরুণ মুখকে। যিনি নবীন প্রজন্মেরই প্রতিনিধিত্ব করেন।
দেবাংশুও যেন প্রস্তুত ছিলেন। দিদির কথার সূত্র ধরেই বললেন, “একজন ৬১ বছরের ব্যক্তি যিনি গতকাল অবধি ঠাণ্ডা ঘরে বসে রায় লিখেছেন এবং পেনের কালির খোঁচায় লোকের চাকরি খেয়েছেন, সেই ব্যক্তি রাজনীতির ময়দানে এসে কতটা কাজের কাজ করতে পারবেন?” বিচারপতির পদে থেকেও বিজেপির সঙ্গে তলে তলে আঁতাত নিয়েও অভিজিতের বিরুদ্ধে চোখা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন দেবাংশু।
এমনিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই তরুণদের এগিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তাঁর নিজের সংসদীয় জীবনের শুরুটাও হয়েছিল খুব কম বয়সে। তমলুকের 'খেলা হবে'-তে দেবাংশুর দিকে বল বাড়িয়ে দেওয়ার আগে তাই দুবার ভাবেননি তিনি। দেবাংশুর প্রচারের কৌশলও এটাই। দ্য ওয়ালকে যেমন বললেন, “আঠাশ বছরের তরতাজা যুবক, ময়না থেকে মহিষাদল ছুটে বেড়াতে পারব। মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারব, মানুষের জন্য কাজ ছিনিয়ে আনতে পারব। চিৎকার চেঁচামেচি যেভাবে হোক, সেটা ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা রাখি।” দেবাংশু যখন এ কথা বলছেন, তাঁকে ঘিরে থাকা কর্মীরা হই হই করে উঠলেন। ওঁদের বয়সও কম। ১৮ থেকে ৩৪-এর মধ্যেই বেশি। দিব্য বোঝা গেল, এ সব কথায় উন্মাদনা খেলে যাচ্ছে তাঁদের মধ্যে।
দলে যোগ দেওয়ার আগে দীর্ঘদিন সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের সমর্থনে লেখালেখি করেছেন দেবাংশু। মা তনুজা ভট্টাচার্যর কথায়, “খুব অল্পবয়স থেকে ছেলের রাজনীতিতে আগ্রহ। তখন স্কুলে পড়ে, হয়ত কিছু বোঝার মত বয়স হয়নি, কিন্তু ভাল লাগত রাজনীতি।”
হাওড়ার বালিতে ছোটবেলা কেটেছে দেবাংশুর, এখনও সেখানেই বাড়ি। ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘বাবা গত পাঁচ দশক ধরে বাইরে কর্মরত। বাড়ি আসেন মাস চারেক ছাড়া ছাড়া। মা গৃহবধু। একান্নবর্তী পরিবার, ২০১৭ সাল অবধি এক কাঠার সামান্য বেশি জায়গায় একতলা বাড়িতে বাড়ির সতেরোজন সদস্য সবাই থাকতেন। পরে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন বাড়ি হয়।’ গর্ব করে দেবাংশু বলেন, আজ অবধি কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একবার জড়িয়ে ধরবেন, স্রেফ এই আশায় পুরীতে মানত করে এসেছেন। সে মানত কাজে দিয়েছে। ২০২১ বিধানসভায় তাঁর তৈরি গান ‘খেলা হবে’-কে দলীয় স্লোগানে পরিণত করেন তৃণমূলনেত্রী। ভাইরাল সেই গানের অভিঘাত ছড়িয়ে যায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। দেবাংশুকে নিয়ে খবর করে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম।
গানটার কপিরাইট নিয়েছেন? শুনে হেসেই ফেলেন দেবাংশু। “রাজনৈতিক স্লোগান নিয়ে কপিরাইট নিলে তো প্রকৃত উদ্দেশ্য পণ্ড হয়ে যাবে। কপিরাইট নিলে কি এতটা জনপ্রিয় হত?"
সমাজমাধ্যমে লেখালেখির সূত্রেই দেবাংশুর উত্থান, রাজনৈতিক পরিচিতি। দেবাংশু ফেসবুকে রাজনৈতিক নানা ইস্যু নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে সরব হতেন। সমাজমাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের যে ক'জন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন বা সরব হতেন, দেবাংশু ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তৃণমূলের আইটি ও সমাজমাধ্যম শাখার রাজ্য সম্পাদক অভিরূপ মাইতি যেমন বললেন, “দেবাংশু একটা ছক-ভাঙা ট্রেন্ড তৈরি করেছে। দিদির একজন সত্যিকারের ভক্ত হিসেবে আমাদের সকলের মন জয় করে নিয়েছিল”। তৃণমূল অপর মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী আবার দ্য ওয়ালকে বললেন, “দেবাংশু কোনও মামা-কাকা কাউকে ধরে রাজনীতিতে আসেনি। যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেটা সবটাই নিজের পরিশ্রম, চেষ্টা ও দায়বদ্ধতা দিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময়েই তরুণ প্রজন্মের কথা বলেন। মমতাদি ও অভিষেক যে চিন্তাধারার পক্ষপাতী, আজ তারই প্রতিফলন ঘটল দেবাংশুর প্রার্থীপদ পাওয়ায়।”
দীর্ঘদিন দেবাংশুর সঙ্গে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বিতর্কসভায় অংশ নিয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। নানা ইস্যুতে প্রায়ই দেবাংশুর সঙ্গে বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু নিজের চেষ্টায় এইভাবে জায়গা তৈরি করাকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারলেন না বিশ্বনাথবাবুও। দ্য ওয়ালকে ফোনে বললেন, ‘দেখুন, দেবাংশুর রাজনৈতিক বোধ কিন্তু ক্ষুরধার। বিতর্কে খুব ভাল অংশ নিতে পারে, খুব ভাল লেখে, লেখনীর কথা আলাদা করে বলতেই হয়৷ আমার সঙ্গে বহুবার নানা বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু আমাকে ও শ্রদ্ধা করে, আমিও ওকে আমার ছোট ভাইয়ের মতই দেখি।” বিশ্বনাথবাবু নিজেই যোগ করেন, ‘মুখপাত্র হিসেবে ওর কাজটাই ও করে। এমনিতে খুবই ভদ্র, বিনয়ী ছেলে দেবাংশু।’
আপাতনজরে অনেকেই মনে করছেন, তমলুকে এহেন দেবাংশুর লড়াইটা কঠিন। কিন্তু তৃণমূল অন্য একটা অঙ্কও দেখাতে চাইছে। বিধানসভা ভোটের নিরিখে এখনও জোড়াফুলই এগিয়ে। সাত আসনের মধ্যে চারটিতেই বিধায়ক তৃণমূলের। ময়না, হলদিয়া ও নন্দীগ্রাম বিজেপির। পঞ্চায়েত ভোটে ফলাফলের নিরিখেও তমলুকে বিস্তর এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।
দেবাংশু জানেন সবটাই। বরং পাল্টা মনে করালেন, "শেষ বিধানসভা নির্বাচনের হিসেব অনুযায়ী, তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের ২১ ভোটের লিড আছে। ভাবতে পারেন? চারটে আসনে আমরা, তিনটেতে ওরা এগিয়ে। কিন্তু ভোট হিসেব করলে, মাত্র ২১ ভোট! কিন্তু সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এরপরেও বলছি, মাঠেময়দানে ঘুরে যেটুকু আমি বুঝেছি, বড় ব্যবধানেই জিতব।"
দেবাংশুর জয়ের ব্যাপারে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও আমল দিচ্ছে না তৃণমূল। বিরোধীদের একহাত নিয়ে মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেন, "দেখুন, হলদিয়ার বিজেপি বিধায়ক তাপসী মণ্ডল সিপিএম থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন। শুভেন্দু নিজেই তো তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন। বিজেপি গোটাটাই তো হয় সিপিএম, নয়ত কংগ্রেস নয়ত তৃণমূল থেকে ভাঙিয়ে নেওয়া জোড়াতাপ্পি দেওয়া দল। নিজস্বতা বলে কিছু আছে? অরূপ মনে করিয়ে দিলেন, "এটাও তো মাথায় রাখতে হবে, ১৯৮৪ সালে যখন যাদবপুরে তৎকালীন যুবনেত্রী মমতাদি নিজে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন উল্টোদিকে ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মত দাপুটে হেভিওয়েট নেতা। সেখানে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একটা অংশের কাছে ধিকৃত। ওঁর প্রতি মানুষের একটা ক্ষোভ রয়েছে। দেবাংশু যদি সেটা ঠিকমত কাজে লাগাতে পারে, ওর জয় নিশ্চিত"।
ইদানীং ভোটের লড়াইতে রাজনৈতিক আক্রমণে নবীন-প্রবীণ রেয়াত করার সংস্কৃতি প্রায় উঠে গেছে। দেবাংশু তরুণ হলেও কম টিপন্নি শুনতে হচ্ছে না তাঁকেও। শুভেন্দু অধিকারী যেমন তাঁকে 'নর্দমা'-ইত্যাদি বলেছেন। লকেট চট্টোপাধ্যায় 'গলা টিপলে দুধ বেরোয়', 'বেশি বেঁড়েপাকা' বলে কটাক্ষ করেছেন। দেবাংশু যদিও মাথা ঠাণ্ডা রেখেই মোকাবিলা করছেন সেসব। "শুভেন্দু অধিকারী কেন, আমাকে তো অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও অনেক ব্যক্তি আক্রমণ করেছেন", দ্য ওয়ালকে বলেন দেবাংশু, "আমি প্রত্যেকবারই তাঁদের প্রণাম জানিয়েছি। তাঁরা আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমি তমলুকের মাটিতে আছি। তমলুকের মাটিতে জাগ্রত মা বর্গভীমা। আমি তাঁর কাছেই সর্বদা প্রার্থনা করি, মা ওঁদের সুবুদ্ধি দিন। আমি তো মানুষের কাছে গালাগালি করে ভোট পেতে আসিনি। আমি কী করতে পারব তাঁদের জন্য, আর আমার বিরোধী দল কোনগুলোতে অক্ষম, সেইটুকুই আমি বলব।"
মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন কথা হচ্ছে? এখনও চিন্তা করেন বাড়িতে? দেবাংশুর গলা এবার নরম। বললেন, "দল যে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাতে মা খুব খুশি। মা-বাবাকে মনোনয়নের দিন এনেছিলাম। তাছাড়া সবটাই ওঁরা বাড়ি থেকেই দেখছেন। মা-বাবা-দিদি খুবই মানসিক সমর্থন দিচ্ছেন।" বাড়ির খাবার কতটা মিস করছেন? "ভোট মিটলেই আগে বাড়ি ফিরে একটু চিকেন খেতে চাইব!" অকপটে বলেন দেবাংশু, "আমি একটু মুরগির মাংসের বেশিই ভক্ত আরকি! এছাড়া বাঁধাকপিটাও মা খুব ভাল বানান। বাঁধাকপি দিয়ে রুটি খাব।"
কিন্তু আগে কি কখনও ভোটে লড়েছেন? কলেজে বা পাড়ায়? হাঁ হাঁ করে ওঠেন দেবাংশু, "ধুর! এটা আমার জীবনের প্রথম নির্বাচন। কোনওদিন ক্লাব নির্বাচনেও দাঁড়াইনি! প্রথম নির্বাচনই লোকসভা, প্রথমটাই জিতছি।"
Advertisement
Advertisement