দেশের প্রথম ভোটে ২৮ লক্ষ নাম বাদ দিয়েছিল কমিশন, তখনও কি ভুয়ো ভোটার ছিল? - দ্য ওয়াল ফাইল ।
শেষ আপডেট: 17 April 2024 19:47
অমল সরকার
ভোট এলেই ভুয়ো ভোটারের কথা আলোচনায় আসে। নির্বাচন কমিশন ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের দিন যে সব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে তার অন্যতম হল ভুয়ো ভোটার শূন্য ভোটার তালিকা তৈরি এবং রামের ভোট যাতে শ্যাম দিতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের দিন বর্তমান মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারের মুখেও একই সতর্কতার কথা শোনা গিয়েছে।
প্রশ্ন হল, ভুয়ো ভোটার কাদের বলা হয়। কমিশন একাধিক ক্ষেত্রে ভুয়ো ভোটার শব্দটি ব্যবহার করে। সাধারণভাবে ধরা হয় একজন বৈধ ভোটারের নাম করে আর একজনের ভোটদান। এছাড়া, কেউ নাম-পরিচয় গোপন করে ভোটার তালিকায় নাম তুললে তাকেও ভুয়ো ভোটার বলে ধরা হবে। আবার কেউ মৃত ব্যক্তির ভোট দিলে তাও ভুয়ো ভোট বলে বিবেচিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ কিছু রাজ্যে ভুয়ো ভোটার একটা সময় নির্বাচন কমিশনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। ২০০০ সাল থেকে কমিশন ভোটার তালিকা নিয়ে ‘ক্লিন লিস্ট’ অপারেশন চালু করে। অর্থাৎ মৃত এবং ভুয়ো ভোটার মুক্ত তালিকা। এরজন্য দুই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এক. কমিশন একটি বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার দিয়ে ভোটার তালিকায় একই নাম-ঠিকানা-ছবির ভোটারদের চিহ্নিত করে তাদের বাড়ি গিয়ে বৈধতা যাচাই করে। এরফলে একই ব্যক্তির একাধিক জায়গায় নাম তোলার প্রবণতা অনেকটাই দূর হয়েছে।
দুই. কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় শ্মশান ঘাট ও কবরস্থান থেকে আগের এক বছরে মৃত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। সেই নামগুলিও তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া চলমান।
এক সময় ছিল, বিরোধী দলগুলি ভোটে রিগিং, ছাপ্পার পাশাপাশি ভুয়ো ভোটার নিয়ে সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতো। যদিও এ ক্ষেত্রেও যে জোর যার মুলুক তার ব্যবস্থা কায়েম ছিল তা ভাল বোঝা গিয়েছিল যখন ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটের আগে তখনকার বিরোধী দল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির লাগাতার অভিযোগের মুখে সেই প্রথম নির্বাচন কমিশন ইলেক্টোরাল অবজারভার নিয়োগ করে। কমিশনের একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে এই কাজে বাংলায় পাঠায়। তিনি জেলায় জেলায় ঘুরে দিল্লি ফিরে গিয়ে বাংলার তালিকা থেকে নয় লাখ ভোটারের নাম বাতিল করে দেন।
বিরোধীরা দাবি করে, নয় লাখই সিপিএমের ভুয়ো ভোটার যারা এতদিন কাস্তে-হাতুড়ি তারা চিহ্নের প্রার্থীদের জিতিয়ে এসেছে। এবার ভোট দিতে পারবে না। অতএব সিপিএমের গদি উল্টাবেই। কেউ বাঁচাতে পারবে না। ভোটের ফল প্রকাশের পর যদিও দেখা যায় সিপিএম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং বামফ্রন্ট নিরঙ্কুশ।
আগেই বলেছি, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ যাওয়া নতুন কিছু নয়। এমনকী ১৯৫১-’৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আগেও ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে সংসদে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন পাশ করিয়ে গঠন করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশন। প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হন আইসিএস বা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অফিসার সুকুমার সেন। ওই পদে যাওয়ার আগে তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব।
কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর প্রথম কাজ ছিল ভোটার তালিকা তৈরি করা। সেদিনের ভারতের কথা বিবেচনায় রাখলে বলা চলে কাজটি ছিল এভারেস্ট বিজয়ের থেকেও কঠিন। ভোটারের সংখ্যা যদিও ছিল সতেরো কোটি; সেই ভারতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তালিকা তৈরি করা ছিল এক কথায় অসাধ্য।
সুকুমারবাবু কমিশনের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে সারা দেশে ষোলো হাজার পাঁচশো জন ক্লার্কের তালিকা তৈরি করালেন। সেই ভারতে সরকারি অফিস, কর্মচারী ছিল হাতে গোনা। কমিশন সরকারি করণিকদের নির্দেশ দেয় গ্রামে গঞ্জে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে ভোটার তালিকা তৈরি করতে। এ জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তিন লাখ আশি হাজার রিম কাগজ খরচ করে ছাপানো হয় ভোটার তালিকা। সব রাজ্য থেকে তালিকা দিল্লিতে কমিশনের দফতরে পৌঁছালে কিছুদিন পর জানা যায়, তালিকা থেকে ২৮ লাখ নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাতিল নামগুলি কি ভুয়ো ভোটারের? না, মোটেও তা নয়। আসলে এই পরিসংখ্যান থেকে তৎকালীন ভারতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি খানিকটা উপলব্ধি করা যায়। বাতিল নামের নব্বই ভাগই ছিল মহিলাদের। কারণ অনেক বিবাহিত মহিলাই ভোটার তালিকায় নাম তুলতে অপরিচিত লোকজনের সামনে স্বামীর নাম মুখে আনতে চাননি। অনেক অবিবাহিত মহিলা এমনকী বাবার নামও বলতে চাননি। আবার পুরুষদের একাংশ পরিবারের অভিভাবকের নাম বললেও নিজের নাম বলতে আপত্তি করেন। তাদের কাছে দাদু, জেঠু, বাবা, বড় ভাই-য়ের নামই যথেষ্ট। ওই সব ভোটারদের অভিভাবকদের নাম না থাকায় আইন বাঁচাতে কমিশন সেগুলি বাদ দিয়ে দিতে বাধ্য হয়।