
চৈতালী চক্রবর্তী
“মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনের এক গূঢ় তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন খুব সহজ কয়েকটা কথায়। মনকে বোঝানোই আসল। এত সহজে সব কিছু শেষ হয় না, মনকে বোঝাতে হয় ‘চলো বাঁচি একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের জীবন। একদম অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত।’ (Suicide)
আজ শুক্রবার ১০ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড সুইসাইড প্রিভেনশন ডে’ World Suicide Prevention Day 2021)। এ বছরের থিম ‘ক্রিয়েটিং হোপ থ্রু অ্যাকশন’। অর্থাৎ আশা জাগাও, বিশ্বাস তৈরি করো, অবসাদের আঁধারে তলিয়ে যেতে বসা মনগুলোকে টেনে তুলে বোঝাও, কোনও অপূর্ণতাই বিকল্পহীন নয়। জীবনের মূল্য কোনও বিশেষ প্রাপ্তির মধ্যে লুকিয়ে নেই। আত্মহত্যার প্রবণতা আমাদের দেশে তো বটেই পশ্চিমবঙ্গেও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। কমবয়সীদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা মারাত্মক।
মনে পড়ে দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রী কৃত্তিকা পালের আত্মহত্যার ঘটনা। সুন্দর হাতের লেখায় তিন পাতার সুইসাইড নোট লিখেছিল কৃত্তিকা। সেখানে সে কাউকে দায়ী করে যায়নি। কিন্তু চিঠিতে তাঁর মনের ক্ষোভ, অভিমান, অসন্তোষ ঝরে পড়েছিল প্রতিটি ছত্রে ছত্রে…আর বিস্ময় তৈরি করেছিল কৃত্তিকারই লেখা একটা লাইন..‘…আই লভ ইউ কে (K), ডোন্ট ফরগেট মি…’। কে এই ‘কে’, কোন অপূর্ণতায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল ফুটফুটে মেয়েটি তা ধরতেই পারেননি তদন্তকারীরা।
গত কয়েক বছরে শহর ও শহরতলির আরও কয়েকটি স্কুলে এমন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ২০১৭ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলছে বছর সতেরোর এক কিশোর। খাট থেকে কয়েক হাত দূরে টেবিলের ওপর রসায়নের বই খোলা। তার ভেতরে ভাঁজ করে রাখা চশমা। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র সৃজন চৌধুরীর আত্মহত্যা নাড়িয়ে দিয়েছিল সমাজকে। তদন্তকারীরাও সেবারও বলেছিলেন, চরম মানসিক অবসাদ থেকে আত্মঘাতী হয়েছিল কিশোর। হাসিখুশি, পড়ুয়া ছেলেটা কবে যে অবসাদের স্বাদ পেয়েছিল তা বুঝতেই পারেননি বাবা-মা।
ঘটনা আরও আছে। পর্ণশ্রীতে একই সঙ্গে আত্মঘাতী হয়েছিলেন মা ও ছেলে। মায়ের মৃত্যু মানতে না পেরে চার মাসের মাথায় ১৪ বছরের এক কিশোরীও আত্মহত্যা করে।
করোনা পরিস্থিতিতে গত দু’বছরে শহরের বুকে ঘটে গিয়েছে একের পর এক এমনই আত্মহত্যার ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, করোনা-পর্বে শুধু নয়, সুইসাইডাল ডেটা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রতি বছরই এমন ঘটনা কয়েকটা করে ঘটে। করোনা কালে শুধু সংখ্যাটা এক ধাক্কায় কিছুটা বেড়েছে। আসলে কিছু মৃত্যুর খবর তৈরি হয়, বাকিগুলো হারিয়ে যায়। সার্বিক সচেতনতা তৈরির পথটাও থেমে যায় কোথাও একটা গিয়ে।
চারদিকে শুধু নৈরাশ্য
কলকাতার বিশিষ্ট সাইকোথেরাপিস্ট ও মেন্টাল হেলথ ট্রেনার চন্দনা বক্সী বললেন, আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল মানুষ কোথাও গিয়ে একাকীত্বে ভুগছে। চারদিকে শুধুই নৈরাশ্য, হতাশা। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা। মনের কথা খুলে বলার কেউ নেই, ভাবনা বোঝানোর কেউ নেই। আগে মানুষ অনেক বেঁধে বেঁধে থাকত। হাসি-আড্ডা, দেখা-সাক্ষাৎ, গল্প-গুজবে হতাশার কথা মনেই থাকত না। এখন সেই সংযোগটাই নেই। আর করোনার সময় গত দুবছরে মানুষ একে অপরের থেকে আরও বেশি ‘ডিসকানেক্ট’ হয়ে গেছে, সে শারীরিক উপস্থিতিতে হোক বা মানসিকভাবে। মানুষের জীবন-যাপনে একটা বড়সড় পরিবর্তন হয়ে গেছে গত কয়েক বছরের মধ্যে। অনেকেই দ্রুত পাল্টে যাওয়া সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিজীবনে।
ঘরবন্দি জীবন অবসাদের পাল্লা আরও ভারী করেছে। লিঙ্গ, শ্রেণির ভিন্নতায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলাদা আলাদা রকমের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। কেউ লকডাউনে চাকরি হারিয়েছেন, কেউ প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছেন, কেউ স্বামী-সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত, কেউ ব্যবসায়ে সব খুইয়ে হতাশাগ্রস্থ, কেউ আবার নিজের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়ছেন যে তাঁদের মধ্যে মানসিক অবসাদ দেখা দিচ্ছে। শহরতলিতেও এই উদাহরণ ভুরি ভুরি। তখন মনে হচ্ছে, “ধুর, আর বেঁচে থেকে কী হবে !“ সাইকোথেরাপিস্ট চন্দনা বলছেন, মন খারাপ, ভাল লাগছে না, বাঁচতে ইচ্ছে করছে না..এমন কথা খামখেয়ালে আমরা হামেশাই বলি। কিন্তু এই ভাবনাটা যদি মনের অবচেতনে জটিল হয়ে চেপে বসতে শুরু করে, তখনই আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়। আর এটা তখনই হয় যখন নিজের ভাবনা কাউকে বলার বা বোঝানোর মতো থাকে না।
বিপন্ন কৈশোর, ভুগছে ১৪ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা
কৃত্তিকার মতোই স্কুলের শৌচাগার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিল কলকাতার অন্য একটি নামী স্কুলের এক মেধাবী ছাত্রী। ব্লেড নিয়ে দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী স্কুলের শৌচালয়ে পৌঁছেও গিয়েছিল। এমনকি বাঁ হাতে ক্ষতও করে ফেলেছিল সে। যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় ওই ছাত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। খবরের শিরোনামে বেরোয় বড়সড় বিপদ এড়ানো গেছে। কিন্তু এই বিপদের পটভূমি তৈরি হল কেন, সেটাই হল বড় কথা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দনা বলছেন, বাচ্চাদের মধ্যে ‘সুইসাইডাল থট’ তৈরি হওয়ার নানা কারণ আছে। প্রথমত, মনের ভেতর জমে থাকে ক্ষোভ, অবহেলা, কাউকে বোঝাতে না পারার গ্লানি, দ্বিতীয়ত, প্রচণ্ড মানসিক চাপ সেটা পড়াশোনার কারণে হতে পারে বা বাবা-মায়ের অতিরিক্ত নজরদারির কারণেও হতে পারে, তাছাড়া কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত নির্ভরতা ইত্যাদি নানা কারণ আছে।
এমন অনেক বাচ্চা আছে যারা বলে, “সবাই কাজে ব্যস্ত। আমাকে কেউ ভালবাসে না। আমার জন্য কারও সময় নেই।“ এটাও হল অন্যতম বড় কারণ যেখানে ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর বা কিশোরী নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে মরিয়া। কোথাও গিয়ে এই কচি মনগুলোকে আমরা ‘রিড’ করতে পারছি না। শুধুমাত্র অভাববোধ বা অবসাদ থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয় এমনটা কিন্তু নয়। তাহলে ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’-এর সমাজে স্কুল পড়ুয়া বা কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার ভাবনা তৈরি হত না। খামতিটা যে জায়গায় হচ্ছে তা হল, এই প্রজন্মের মন বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। এদের চাওয়া-পাওয়া, অভিমান, ইচ্ছেগুলো বুঝতে পারছি না, মেলাতেও পারছি না হয়ত। নিজেদের অবস্থান বা অভিমতের গুরুত্বটা বোঝাতে না পেরে এক চরম হতাশায় তলিয়ে যাচ্ছে কৈশোর, বয়ঃসন্ধি। বিপদ ঘটে যাওয়ার পরে খবর হচ্ছে ‘মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা’, এই অবসাদটা তৈরি হল কীভাবে সেটা আর গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। আত্মহত্যাই অন্তিম মুক্তি, এর কোনও বিকল্প নেই, সেই ভাবনাই তৈরি হচ্ছে। আর সে পথেই হাঁটতে শিখছে কৃত্তিকা, সৃজনের মতো কিশোর-কিশোরীরা।
একটা ‘ইমপালস’ তৈরি হচ্ছে মনে
আত্মহত্যার কারণ জটিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্যের মধ্যে নিহিত থাকে। আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যা যেমন সম্পর্কের জটিলতা, বিচ্ছেদ, যৌন-সংসর্গ, আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় জটিলতা—এসব কারণও থাকে। একটা হয় দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্তি থেকে বাঁচার ইচ্ছা চলে যাওয়া, সেক্ষেত্রে অনেক পরিকল্পনা করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া হয়, দ্বিতীয়টা একটা ইমপালস বা হঠাৎ করেই মনে গজিয়ে ওঠা কোনও ভাবনা, ধাক্কা যা জটিল পর্যায়ে পৌঁছে গেলে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়। মনোবিদ বলছেন, সম্পর্কের জটিলতা থেকে আজকাল অনেক কমবয়সীদের মনে এমন ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
এর একটা বড় কারণ হল সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্ভরতা বেড়েছে। দিনভর ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থাকা, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে নতুন বন্ধু খুঁজে নেওয়া, সেখান থেকে সম্পর্ক তৈরি, ছবি বা তথ্যের আদানপ্রদান এবং শেষঅবধি সম্পর্কে বিচ্ছেদ ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের ভয়। গত দু’বছরে এই কারণে সুইসাইডাল থট বেড়েছে কমবয়সীদের মধ্যে।
এমনও দেখা গেছে, নিজের প্রোফাইল ছবিতে কতগুলো লাইক, কমেন্ট পড়ল সে নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভুগছে এখনকার প্রজন্ম। ফেসবুকের বন্ধু এখন পাত্তা দেয় না, কোনও বন্ধুকে দু’বার ফোনে ব্যস্ত পেলে অস্থির হয়ে ওঠা, এসবও মানসিক চাপ তৈরি করছে। এমনও দেখা গেছে, দিনে খান দশেক ছবি ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করতে না পারলে রাতের ঘুম উড়ে যায় অনেকের, শেয়ার করা ছবিতে ফলোয়ারেরা ‘রিঅ্যাক্ট’ না করলে সিগারেটের সংখ্যাও বাড়ে। ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে বাস্তববোধ বিলুপ্ত হচ্ছে কমবয়সীদের।
মানসিক রোগ নাকি সামাজিক রোগ?
‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ (এনসিআরবি)-র রিপোর্টও জানাচ্ছে, ওই বছর ভারতে আত্মহত্যার মোট সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১২৩। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যাটাই ছিল ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫১৬। আরও স্পষ্ট করে বললে, এ দেশের ১৫-৩০ বছর বয়সিদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সব চেয়ে বেশি বলে নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গও সেখানে পিছিয়ে নেই। মনোবিদ বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতার জন্য ব্যক্তিমানুষের মনকে শুধু দায়ী করলে চলবে না, এর সঙ্গে সামাজিক প্রেক্ষাপটও জড়িয়ে রয়েছে।
সু্প্রিম কোর্ট জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য-নীতি তৈরির ব্যাপারে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে অনেক আগেই। সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্য ছিল, যাঁরা মানসিক রোগে ভুগছেন, তাঁদের জন্য তো বটেই, এমনকী, যাঁরা অবসাদগ্রস্থ তাঁদের জন্যও অভিন্ন জাতীয় নীতি তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘কমিউনিটি কেয়ার’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। ‘কমিউনিটি কেয়ার’-এর মূল কথাই হল, এক জন রোগীকে পারিপার্শ্বিক সমাজের ঘিরে থাকা। তিনি যে সমাজবিচ্ছিন্ন নন, সেই আশ্বাসটা জাগিয়ে তোলা। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ‘কমিউনিকেশন স্কিল’ তৈরি করতে হবে। অভিভাবক তো বটেই, স্কুল কর্তৃপক্ষকেও সচেতন থাকতে হবে। দুই প্রান্তকেই আরও বেঁধে বেঁধে থাকতে হবে, বোঝাতে হবে নিজের নিজের পরিসরে তারা সকলেই সেরা। এক না পাওয়াকে নতুন কোনও অপ্রত্যাশিত পাওয়া ভরিয়ে তুলতে পারে। জীবনের প্রতি সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলাই সচেতনতার মূল লক্ষ্য, না হলেও আরও অনেক জীবন অকালেই ঝরে যাবে ফুলের পাপড়ির মতো।