শেষ আপডেট: 27th April 2024 18:19
চৈতালী চক্রবর্তী
হার্টের সমস্যা শুধু বড়দের নয়, ছোটদেরও হতে পারে। এমন অনেকসময় দেখা যায় জন্মের পরেই শিশুর হার্টে ছিদ্র রয়েছে বা কোনও জটিল হার্টের অসুখ (congenital heart disease) নিয়েই জন্মেছে শিশু। সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যেও হার্টের বড় রকম সমস্যা দেখা যায়। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এখন এই সমস্যার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এখনকার সময় হার্টের সার্জারি ও ডায়াগনসিস এতটাই উন্নত যে গর্ভস্থ ভ্রূণের হার্টে (fetal echocardiography) কোনও সমস্যা আছে কিনা তা আগে থেকেই বুঝতে পারেন ডাক্তারবাবুরা। জন্মের পরে যদি বাচ্চার হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে, তাহলে তারও চিকিৎসা আছে।
বিপাশা বসুর মেয়ে দেবী হার্টে দুটো ছিদ্র নিয়ে জন্মেছিল। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট। ৬ ঘণ্টার অপারেশনের পরে ছোট্ট দেবী এখন সুস্থ।
শিশুদের ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের সমস্যা (congenital heart disease) দুই প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথমটি হল জন্মগত। আর দ্বিতীয়তটি জন্মের পরে হওয়া সমস্যা। হার্টের গঠনগত কিছু সমস্যা হতে পারে যা জন্মগত, যেমন হার্টে ফুটো বা হার্টের গঠন অসম্পূর্ণ। এর ফলে হৃদপিণ্ড দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা হয় (fetal echocardiography)। অনেক সময়েই জন্মের পরে বাচ্চার হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে, অথবা গর্ভে থাকাকালীন হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকেরা বুঝতে পারেন না কী করা উচিত। বাচ্চার হার্টে সমস্যা আছে কিনা জানতে জন্মের পরেই সদ্যোজাতের হার্টের পরীক্ষা করা উচিত কিনা, সে নিয়েও জানতে চান অনেকে। এই বিষয়ে সহজ করে বুঝিয়ে বললেন কলকাতার বিএম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টারের (BM Birla Heart Research Centre) পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. শুভেন্দু মণ্ডল।
হৃদপিণ্ড একটি পেশিবহুল অঙ্গ। দু’টি অলিন্দ এবং দু’টি নিলয়— সব মিলিয়ে হৃদপিণ্ডের চারটি ভাগ। অনেক সময়ে জন্ম নেওয়া শিশুর হৃদপিণ্ডের অনেক রকম গঠনমূলক সমস্যা (congenital heart disease) থেকে যায়। হৃদপিণ্ডের মধ্যে ফুটো থাকা, হৃদপিণ্ডের গঠন ঠিকঠাক না হওয়ার মতো নানা সমস্যা থাকে। এই সমস্যাকে বলা হয়, জন্মগত সমস্যা। এর ফলে হৃদপিণ্ড দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা হয়। জন্মের সময়ে শিশুর হৃদপিণ্ডে হওয়া সমস্যাকে টিজিএ বলা হয়। যার পুরো অর্থ ‘ট্রান্স পজিশন অব দ্য গ্রেট’।
শিশুর হার্টের সমস্যাকে (congenital heart disease) প্রধানত দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটিকে বলা হয় সায়ানোটিক। আর দ্বিতীয়টি হল, নন সায়ানোটিক।
সায়ানোটিক সমস্যায় জন্মের পরেই শিশুর গায়ের রং নীল হতে থাকে (congenital heart disease)। শিশু মায়ের দুধও পর্যন্ত খেতে পারে না। শিশুর এই অবস্থাকে বলা হয় ‘ব্লু বেবি’। নন সায়ানোটিক শিশুদের ক্ষেত্রে গায়ের রং পরিবর্তন হয় না। ফলে খুব দ্রুত এই রোগ ধরা পড়ে না। দেড় বা দুই মাস পরে থেকে দেখা যায় শিশুর ওজন বাড়ছে না। খাওয়া কমে যাচ্ছে। তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ ধরা পড়ে।
শিশুর জন্মের পরেই কি হার্টের পরীক্ষা করানো উচিত?
ডা. শুভেন্দু মণ্ডল বলছেন, কনজেনিটাল কার্ডিয়াক ডিফেক্ট (congenital heart disease) আছে কিনা জানতে বারে বারে টেস্ট করানোর দরকার নেই। তবে প্রসবের পরে ডাক্তার যদি বোঝেন বাচ্চার হার্টে সমস্যা আছে তখন সেই মতো পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু হয়। শিশুর শরীরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল বা অক্সিজেনের মাত্রা মাপা হয় (congenital heart disease)। আর যদি বাবা-মায়ের কারও একজনের হার্টের সমস্যা থাকে বা হার্টের সার্জারি হয়ে থাকে, তাহলে ডেলিভারির সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার ইকোকার্ডিওগ্রাম করিয়ে নেওয়া ভাল।
গর্ভস্থ ভ্রূণের হার্টে কোনও সমস্যা আছে কিনা তা জানা যায় ‘ফিটাল ইকো কার্ডিওগ্রাফি’ করে। জন্মের আগে ‘ফিটাল ইকো কার্ডিওগ্রাফি’ করানো হয়। এ ক্ষেত্রে আগে থেকে বোঝা সম্ভব যে, গর্ভস্থ ভ্রুণের কোনও হার্টের সমস্যা রয়েছে কিনা। যদিও দেখা যায়, গর্ভস্থ ভ্রুণটি বড় কোনও হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্মাচ্ছে, তা হলে ওই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন ডাক্তারবাবুরা (fetal echocardiography)। সেক্ষেত্রে জন্মানোর পরের মুহুর্তেই সেই শিশুর চিকিৎসা শুরু করা হয়। জন্মানোর ২০ সপ্তাহ আগে এই পরীক্ষা করানো হয় (congenital heart disease)।
এই টেস্টে ধরা পড়ে শিশুটি হার্টে কোনও অ্যাবনর্মালিটি নিয়ে জন্মাচ্ছে কিনা। শিশুটির পরিবারে হৃদরোগের কোনও ইতিহাস আছে কিনা, শিশু গর্ভে থাকার সময় মা এমন কোনও ওষুধ খেয়েছিলেন কিনা বা অ্যালকোহলের অধিক নেশা করেছিলেন কিনা যার কারণে হার্টে সমস্যা রয়েছে। ফিটাল ইকো করে আগে থেকেই হার্টের সমস্যা বা ক্ষত ধরা পড়লে তা সারানো সম্ভব।
জিনগত কারণে কি হার্টে ফুটো থাকতে পারে?
শিশু হার্টে ফুটো নিয়ে কেন জন্মাচ্ছে তার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। জিনগত কারণ থাকলেও থাকতে পারেষ দেখা গেছে, ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে বাচ্চার হার্টের গঠন ঠিক হয়নি বা হার্টে জটিলতা রয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলায় গ্যাস-অম্বলের জ্বালা, কেন প্রতি তিনজনের একজনই ভুগছেন অ্যাসিডিটিতে
ডাক্তারবাবু বলছেন, সাধারণত জরায়ুতে ভ্রূণের বিকাশের সময় কোনও ত্রুটি থেকেই জন্মগত হৃদরোগের সমস্যা হয়। এই অস্বাভাবিকত্ব ক্রোমোজোমাল বা জিনগত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মদ্যপান ও ধূমপান করলে তার প্রভাবে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের ভাইরাল ইনফেকশন, ডায়াবেটিস বা এই ধরনের কোনও অসুখ থেকেও সমস্যা হতে পারে। তবে এটি বংশগত সমস্যা নয়।
জন্মের পরেই যদি শিশুর হার্টের রোগ ধরা না পরে, তাহলে পরবর্তীতে কী হবে?
ডা. শুভেন্দু মণ্ডল বলছেন, শিশুর হার্টে জটিল সমস্যা আছে কিনা তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডায়াগনসিস করা ভাল। তাহলে পরবর্তীকালে সমস্যা কম হবে। জন্মগত হৃদরোগ পরবর্তীকালে বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা ডেকে আনতে পারে। যেমন, হৃদযন্ত্রের গঠনগত ত্রুটি থেকে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। হার্ট থেকে ঠিকভাবে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন না হলে কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয় অনেকের। প্রসূতির জন্মগত হৃদরোগ থাকলে অ্যারিদমিয়া, হার্ট ফেলিওর এমনকী স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পালমোনারি হাইপারটেনশন থেকে হার্ট ফেলিওর হতে পারে।বাচ্চার হার্টের সমস্যা যদি সঠিক সময়ে সারানো না হয় তাহলে সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ হতে পারে।