
শয়তানের চোখ থেকে খরগোশের পা, যুগে যুগেই বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ‘লাকি চার্ম’, নানা দেশে নানা ধরন
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ফাজ়ি ডাইস। অনেকে বলেন ফ্লাপি ডাইস। একটু বড় ও ফোলা ফোলা দেখতে ছক্কা। শুনতে আজব লাগলেও একসময় এই ছক্কাই ছিল সৌভাগ্যের প্রতীক। আজও আছে কোনও কোনও জায়গায়। একে কেন্দ্র করে এমন বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার যুদ্ধবিমানের পাইলটরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জামের উপরে এই ফাজ়ি ডাইস ঝুলিয়ে রাখত। ফাইটার জেটেও রাখা হত এই ডাইস। এমন ছক্কা সঙ্গে থাকলে সহজে মৃত্যু হবে না, এমনই একটা শক্তপোক্ত বিশ্বাসের ভিত গড়ে উঠেছিল সেই সময়। ফাজ়ি ডাইস হয়ে ওঠেছিল ‘লাকি চার্ম’। মানুষের বিশ্বাসে বা ভাবনায় যাকে সৌভাগ্যের চিহ্ন বা প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
কথায় বলে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। এই বিশ্বাসটাই হল লাকি চার্মের মূল ভিত বা শিকড় বলা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লৌকিক বিশ্বাসটাই জড়িয়ে রয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট, ইসলাম সব ধর্মেই হয় কোনও বস্তু বা কোনও প্রাণী বা সংখ্যাকে সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তাহলে কি এটা কুসংস্কার? সেটা হয়তো বলা যায় না, কারণ অনেক শুভ প্রতীক বা লাকি চার্মের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। বাস্তুশাস্ত্র মতে কিছু চিহ্নকে আবার স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। এই লাকি চার্ম নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন গোটাটাই অবান্তর, আবার কারও দাবি যেহেতু অধিকাংশ লাকি চার্মের সঙ্গেই ইতিহাস বা পৌরাণিক ঘটনা জড়িয়ে আছে তাই সবই যে অবৈজ্ঞানিক বা তাৎক্ষণিক ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে তেমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
তর্ক-বিতর্ক, দাবি-পাল্টা দাবি যাই হোক না কেন, সৌভাগ্যের প্রতীক নিয়ে বিশ্বাসের বুনিয়াদটা কিন্তু খুব একটা কমজোরি নয়। সে ধনী হোক বা গরিব, অভিনেতা থেকে খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ থেকে সাহিত্যিক, শিল্পী—লাকি চার্ম নিয়ে দুর্বলতা কমবেশি সবারই আছে। ব্রিটেনে যেমন ক্রিসমাসের সময় রূপোর কয়েনকে লাকি চার্ম ধরে নিয়ে পুডিংয়ের ভেতরে ভরে দেওয়া হয়। কয়েন সমেত আস্ত পুডিং যার ভাগে পড়বে তার ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বেই, অন্তত বিশ্বাস এমনটাই। সেই পুডিং খেলে নাকি প্রতি বছরই সৌভাগ্য একেবারে বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়বে।
আবার যেমন ধরা যাক, চার পাতার ক্লোভার গাছ। সাধারণত তিন পাতার ক্লোভার বেশি পাওয়া যায়, এই চার পাতার ক্লোভার নাকি দশ হাজারে একটি মেলে। ছোট গুল্ম জাতীয় গাছ। আয়ারল্যান্ডে সৌভাগ্যের প্রতীক। আইরিশরা মনে করেন, চারটি পাতা বিশ্বাস, আশা, ভাগ্য এবং ভালবাসার প্রতীক। খ্রিষ্টান ধর্মেও এই চার পাতার ক্লোভারকে শুভ প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। বিশ্বাস যে ইভকে যখন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, সে সঙ্গে করে ওই চার পাতার ক্লোভার নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। এই গাছ স্বর্গের সৌভাগ্যের প্রতীক।
পোলিশরা আবার কার্প জাতীয় মাছের আঁশকে শুভ প্রতীক হিসেবে মেনে চলে। এই কার্প মাছের আঁশ আবার শুধু পোলান্ড নয় প্রতিবেশী দেশ স্লোভাকিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রেও লাকি চার্ম। পোলিশরা মনে করে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশেষত বড়দিনের সময় ডিনারের পরে কার্প মাছের আঁশ খেলে নাকি ভাগ্য ফিরে যায়। শুধু খাওয়া নয়, অনেকে আবার কয়েকটা আঁশ ওয়ালেটেও ভরে রাখেন। বিশ্বাস সারা বছর ওয়ালেট ফুলেফেঁপেই থাকবে, টাকাপয়সার কমতি হবে না।
চিনেরা আবার ব্যাঙকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে খুব মেনে চলে। ‘জিন চান’ লাল লাল চোখ আর তিন পায়ের সোনালি রঙের ব্যাঙ ঘরে বা দোকানে রাখলে নাকি অঢেল টাকার মালিক হওয়া যায়। এই ব্যাঙকে আবার চিনেরা বলে ‘মানি টোড’ । জিভ উল্টে পোকা টেনে আনার মতো পয়সাকড়িও নাকি টেনে আনতে পারে এই মানি টোড।
শয়তান বা ডেভিলকে ব্ল্যাকস্মিথ কীভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিল সেই গল্প আইরিশদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। ঘোড়ার খুরের নাল ছুঁড়ে ব্ল্যাকস্মিথ নাকি শয়তানকে কাবু করেছিল। সেই থেকে লোহার নাল আয়ারল্যান্ডে সৌভাগ্যের প্রতীক। ইউরোপিয়রাও বিশ্বাস করে লোহার নাকি জাদুশক্তি আছে, বাড়ির সদর দরজায় রাখলে নাকি কুনজর এড়িয়ে চলা যায়। ভারতীয়দের মধ্যে এই বিশ্বাস আছে ষোলোআনা। বাস্তুশাস্ত্র মতে অনেকের বাড়িতেই সদর দরজায় উপরে ঘোড়ার খুরের নাল ঝোলানো থাকে।
খরগোশের পা থেকে শুয়োর, লাকি চার্মের তালিকায় আছে অনেক আজব জিনিসই। উত্তর আমেরিকার নানা জায়গায় খরগোশের পাকে শুভ প্রতীক বলে ধরা হয়। অনেকে আবার একে হুডু বলে, বিশ্বাস এর নাকি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। জার্মানরা শুয়োরকে সুখ-সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে মানে। ‘ডালা হর্স’লাকি চার্ম সুইডেনে। কাঠের ঘোড়ার গায়ে নানারকম কারুকার্য। সুইডিশরা মনে করে কাঠের আসবাবের মধ্যে এই নানারকম কার্যুকার্য করা রঙিন ঘোড়া রাখলে ভাগ্যটাই বদলে যাবে। সাদা, লাল বা সবুজ রঙের ঘোড়ার দামও কম নয়। গায়ের নকশা যত বাড়বে তার দামও তত বাড়বে। হয়ত ভাগ্যটাও আরও একটু খুলবে। অন্তত সুইডিশরা তাই মনে করে।
শুভ-অশুভ, প্রাকৃত-অপ্রাকৃত শক্তি নিয়ে যুগে যুগেই চর্চা। তার হাজারো বিশ্বাস, ধারণা, ইতিহাস। শয়তান বা খারাপ শক্তির তেকে বাঁচতে শয়তানের চোখ বা ইভিল আই-কেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল পাঁচ হাজার বছর আগে, মেটোপটেমিয়ায়। আজও ইভিল আই লাকি চার্ম অনেক দেশেই। চোখের রঙেরও একটা বিশিষ্ট্য আছে। ব্লু ইভিল আই মানে সত্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। নীল মানে আকাশের রঙ, তাই নীল চোখ হল ভাল কর্ম, উদার মন আর শুভ শক্তির প্রতীক। তুরস্কে এই নীল চোখকে বলে ‘নজর বোনচু’, খারাপ নজর কাটাতে লাকি চার্ম হিসেবে সঙ্গে রাখে সে দেশের মানুষরা। গ্রিস, মিশর, লেবানন, ইরান, মরক্কো, দক্ষিণ ইতালি, আফগানিস্তানেও ইভিল আই সৌভাগ্যের চিহ্ন।
নরওয়েতে আবার ওক গাছের ফল অ্যাকর্নকে লাকি চার্ম ধরা হয়। দরজা-জানলার ওপরে এই ফল রাখলে নাকি অশুভ শক্তি ঘরে ঢুকতে পারে না। জাপানি রীতিতে লাকি চার্ম অনেক রকম। কোনও রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গেলে দেখা যাবে প্রবেশ পথেই রাখা ‘মানেকি-নেকো’, সেরামিক বা প্লাস্টিকের তৈরি মিষ্টি দেখতে একটা বিড়াল। একটা থাবা তুলে যেন কাছে ডাকছে। সাধারণত সাদা রঙের হয় তবে এখন ফেং শুই মেনে এর রঙে নানা বদল এসেছে। জাপানের বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে গেলে‘ওমামোরি’-র দেখা মিলবেই। সিল্কের কাপড়ের তৈরি ছোট্ট বটুয়া যার সারা গায়ে প্রার্থনা লেখা থাকে। জাপানিদের খুব প্রিয় লাকি চার্ম। এর সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসও জড়িত।
এক দেশের সৌভাগ্যের চিহ্ন অন্য দেশের দুর্ভাগ্যও হতে পারে। লাকি চার্ম নিয়েও টানাটানির শেষ নেই। যেমন আয়না। গ্রিকরা মনে করে আয়না ব্যবহার করত ডাইনি বা উইচরা। রোমানদের আবার বিশ্বাস আয়তা নাকি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখাতে পারে। চিনেরা ভাবে স্বর্গের শক্তি বেঁধে রাখা যায় আয়নায়, সে দেশে লাকি চার্ম বটেই। জার্মানরা বিশ্বাস করে আয়না সত্যিটাই দেখায়, কাজেই সৌভাগ্যের প্রতীক।
যুক্তি-তর্ক দিয়ে বিচার করা যাবে না। লৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে যে সংস্কার চলে আসছে তা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, তাদের রীতি-রেওয়াজ, ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।