শেষ আপডেট: 18th September 2021 10:03
কোভিড সারার পরেও শ্বাসকষ্ট, সিঁড়ি ভাঙলেই হাঁফ ধরছে? কখন সতর্ক হবেন
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কোভিড সেরে গেলেও নানা রকম রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। শ্বাসের সমস্যা দেখা দিচ্ছে অনেক রোগীর। পোস্ট-কোভিড (Post Covid) বা কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হচ্ছেন অনেকেই। করোনা সম্পূর্ণ সেরে যাওয়ার পরেও যদি শ্বাসকষ্ট বা দম নিতে সমস্যা হয় তাহলে একেবারেই হেলাফেলা করা উচিত নয়। সে ক্ষেত্রে কী করণীয়, কীভাবে নিজের খেয়াল রাখবেন সে বিষয়ে দ্য ওয়ালের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ আলোচনায় নারায়ণ মেমোরিয়াল হসপিটালের রেসপিরেটারি মেডিসিনের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ রঞ্জন কুমার দাস।
কলকাতায় সামগ্রিক করোনা চিত্রটা এখন কেমন?
আমরা যদি শুরুর দিক থেকে ধরি, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে কোভিড পর্ব যেভাবে শুরু হয়েছে এবং সারা পৃথিবীতে ছেয়ে গিয়েছিল, এখন সেখানে পরিস্থিতি অনেকটাই ভালর দিকে। কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হওয়ার পরে মে মাসের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গেই দৈনিক সংক্রমণ ২০ হাজার উঠে গিয়েছিল। এখন সেখানে দৈনিক সংক্রমণ ৭০-৮০ জনের মধ্যে থাকছে, এটা নিঃসন্দেহে ভাল খবর। বিশেষ করে কলকাতায় করোনা কার্ভ অনেকটাই কমেছে। কোভিড গাইডলাইন যদি অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় তাহলে আগামী দিনে সংক্রমণ আরও কমবে বলেই আশা করা যায়। সতর্ক থাকতে গেলে তিনটি মূল বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে—ফেস-মাস্ক, স্যানিটাইজার, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং। এবং অবশ্যই ভিড় ও জমায়েত এড়িয়ে চলা। এই দিকগুলো যদি মেনে চলা যায়, তাহলে করোনা অনেকটাই কমবে।
কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে?
পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যাকিউট কোভিড ইনফেকশনের একমাস পরে যদি উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে তখন তাকে পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম বলা যেতে পারে। কী কী উপসর্গ দেখা দিতে পারে তাকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করি। যেমন, করোনা সেরে যাওয়ার প্রথম এক মাস থেকে তিন মাস অবধি যদি উপসর্গ থাকে তাহলে একে ‘অনগোয়িং কোভিড সিনড্রোম’ বলা হবে আর যদি ১২ সপ্তাহ পরেও রোগের লক্ষণ থাকে তখন তাকে ‘ক্রনিক কোভিড সিনড্রোম’ বলা হবে। অর্থাৎ কোভিড সেরে যাওয়ার পরে প্রথম চার সপ্তাহ বা একমাস হাল্কা রোগের লক্ষণ থাকতেই পারে, একে সাব-অ্যাকিউট ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়, কিন্তু এর পরেও যদি উপসর্গ থাকে তখন সেটা ক্রনিক পর্যায়ে চলে যায়।
শ্বাসযন্ত্রের যে সমস্যাগুলো মূলত দেখা দিচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর হল কাশি। দিনের বেলায় কাশির বেগ অতটা থাকছে না, কিন্তু রাত হলেই কাশির দমক বাড়ছে। রোগীদের সবসময় যে কফ বেরচ্ছে তা নয়, তবে শুকনো কাশি মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। রোগীরা বলছেন, একজায়গায় বসে থাকলে শ্বাসের সমস্যা তেমন হচ্ছে না, কিন্তু হাঁটাচলা করলে বা সিঁড়ি ভাঙলে তখন দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। আরও একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে—তা হল পেশির দুর্বলতা। এটা শ্বাসযন্ত্রের ওপরেও প্রভাব ফেলছে।
ক্রমাগত কাশি হচ্ছে, হাঁফ ধরছে, কখন ডাক্তারের কাছে যাব?
করোনা সেরে যাওয়ার পরেও একমাস অবধি যদি শুকনো কাশি ভোগায় তাহলে সাবধান হতে হবে। কাশির সঙ্গে শ্বাস নিতে সমস্যা, শ্বাসকষ্ট এগুলোও হতে পারে। তখন দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভাল। কিছু পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। কোভিড প্রধানত ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়ায়। করোনা হলে ফুসফুসে নানাভাবে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, হয় নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা দিতে পারে, না হলে সিরোসিসের ভয় থাকতে পারে। তাই রোগীর শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে কেন বা ক্রমাগত কাশি হচ্ছে কেন, ফুসফুসে কী ধরনের রোগ হচ্ছে তা পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া জরুরি।.jpg)
করোনার কারণে ফুসফুসে সিরোসিস হতেও দেখা গেছে। সিরোসিস হওয়া মানে ফুসফুসের নানা অংশ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। প্রধানত মাইক্রো-ভাস্কুলার কোয়াগুলেশন হয়। ছোট ছোট শিরাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন বেড়ে যায়। প্রচুর পরিমাণে সাইটোকাইন প্রোটিন ক্ষরণ হতে থাকে যা ফুসফুসে সিরোসিসের জন্য দায়ী। গোড়ার দিকে ধরা না পড়লে বিপদ বাড়তে পারে। তাই রোগীদের সতর্ক হতে হবে। ক্রমাগত কাশি এবং হাঁটাচলার সময়ে শ্বাসকষ্ট হলে দেরি করা ঠিক হবে না।
পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম হচ্ছে বুঝব কী করে?
এখন যাদের কোভিড হচ্ছে বেশিরভাগেরই মাইল্ড। সপ্তাহ তিনেক সংক্রমণ থাকছে, কাশি বা হাল্কা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, এরপরে সম্পূর্ণ সেরে যাচ্ছে। কিন্তু যদি দেখা যায় এই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির ১২ সপ্তাহ পরে বা মাস ছয়েক পরে ফের কাশি ফিরে এল বা রোগের অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিল, তখন সতর্ক হতে হবে। বুঝতে হবে ক্রনিক পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। সিভিয়ার কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এমন রোগী যাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে বা ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম অনেক বেশি।
কোভিড সারিয়ে ওঠার পরেও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারছেন না কমবয়সীদের অনেকেই, এটা কেন?
কমবয়সী বলতে ২০ বছর থেকে ৩০-৪০ বছরের এই গ্রুপে দেখা যাচ্ছে হয়ত তাঁরা খুব অ্যাকটিভ ছিলেন, নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন, তাও পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম নানা পর্যায়ে ধরা পড়ছে। হয়ত দেখা গেল, করোনা সারিয়ে ওঠার সপ্তাহ দুয়েক তাঁরা একেবারেই সুস্থ-সবল ছিলেন, কিন্তু মাস কয়েক পর থেকেই সমস্যা শুরু হচ্ছে। এর কারণ হল, সুস্থ হয়েই হয়ত প্রচণ্ড শরীরচর্চা শুরু করে দিচ্ছেন তাঁরা, আগের মতো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন, বিপদ ঘনাচ্ছে এভাবেই। কারণ, কোভিড শুধু ফুসফুস নয় গোটা শরীরকেই প্রভাবিত করে। হার্ট, কিডনি, ব্রেনে এর প্রভাব পড়ে। হৃদপেশিতে এমন কিছু বদল হতে পারে যা সাধারণভাবে ধরা পড়ে না। তাই এই ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাঁরা প্রি-কোভিড পর্যায়ে যাঁরা নিয়মিত শরীরচর্চা বা জিম করতেন, তাঁরা যদি কোভিড সারিয়ে ওঠার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই সেই লেভেলের শরীরচর্চায় ফিরে যান, তাহলে হার্টের সমস্যা বাড়তে পারে। আচমকা হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর হতেই পারে। তাই সাবধান থাকতে হবে। পোস্ট-কোভিড পর্যায়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই যে কোনও কাজ করা ভাল।
বাচ্চাদের চিন্তার কারণ কতটা?
কোভিডের ফার্স্ট ওয়েভে বাচ্চাদের সংক্রমণ অতটা ধরা পড়েনি। সেকেন্ড ওয়েভে বাচ্চাদের মাইল্ড সিম্পটমই বেশি দেখা গেছে। সাধারণত বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে। মাল্টি-সিনড্রোম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোমও দেখা দিয়েছে বাচ্চাদের, তবে তা খুব কম। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাদের সঠিক গাইডলাইনে রাখতে হবে। ডাক্তারের চেক আপে রাখা জরুরি।
বয়স্করা পোস্ট-কোভিডের ধাক্কা নিতে পারছেন না অনেক সময়েই, কী করা উচিত?
এখানে অনেকগুলো ব্যাপার আছে। বয়স্কদের যদি কোমর্বিডিটি থাকে যেমন—হার্টের রোগ, কিডনির অসুখ, ডায়াবেটিস বা আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি থাকলে, পোস্ট-কোভিড পর্যায়ে নানারকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ কোমর্বিডিটি পোস্ট-কোভিড সিনড্রোম অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। তাই বয়স্কদের ক্ষেত্রে কোভিডের পাশাপাশি অন্য রোগগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে। ডায়াবেটিস রয়েছে যাঁদের, তাঁদের নিয়মিত চেক আপে থাকতে হবে। কোভিডের কারণে এই রোগগুলো আরও বেশি করে মাথাচাড়া দিতে পারে।হাঁপানির রোগীরা কী করবেন?
হাঁপানি বা অ্যাজমা আগে থেকেই ছিল যে রোগীদের তাঁদের যদি কোভিড হয়, তাহলে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। অ্যাজমা যদি আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে অতটা ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু যদি কোভিড হওয়ার আগে থেকেই হাঁপানির সমস্যা বেশি হয়, তাহলে রোগ সিভিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তাই ওষুধপত্র ঠিকমতো খেতে হবে, ডাক্তার দেখিয়ে রাখতে হবে।কোভিড সারার পরে এই বিষয়গুলো খেয়াল করুন
ধরুন কোভিড হয়েছে এক মাস বা দু’মাস হয়ে গেছে কিন্তু এখনও কাশি থামেনি। চার-পাঁচটা সিঁড়ি ভাঙলেই হাঁফ ধরছে, তখন সতর্ক হতে হবে। ফুসফুসের কিছু পরীক্ষা করানো জরুরি—চেস্ট এক্স রে, চেস্টের সিটি স্ক্যান, লাঙ ফাংশন ঠিক আছে কিনা তার পরীক্ষা জরুরি। ৬ মিনিটের হাঁটা পরীক্ষা করালে ভাল। এই পরীক্ষা থেকে বোঝা যায় হার্ট ও ফুসফুস কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কোভিড সারিয়ে ওঠার পরে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতেই হবে। সঠিক সময় ডাক্তারের পরামর্শ নিলে আর কোনও ভয়ের কারণ থাকবে না। পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকা 'সুখপাঠ'
