
মাথার চোটকে হেলাফেলা নয়, কনকাশন হলে কি ঘুমোনো উচিত, জরুরি পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মস্তিষ্কে ভারী কিছুর আঘাত বা পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে যাওয়া অথবা যে কোনও কারণে মস্তিষ্কে গুরুতর চোট লাগলে কী করা উচিত সে ব্যাপারে সঠিক ধারণা থাকে না অনেকেরই। প্রথমত আঘাত গুরুতর হলে, রক্তপাত শুরু হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই জরুরি। কিন্তু রক্তপাত হল না, তবে মাথার কোনও একটা দিক ফুলে গেল বা রক্ত জমাট বেঁধে রইল, এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই নানারকম পরামর্শ দেন। যেমন ধারণা আছে মাথায় চোট লাগলে নাকি ঘুমোনো উচিত নয়। বিশেষত কনকাশন হলে নাকি একেবারেই ঘুমনো ঠিক নয়, এতে রোগীর কোমায় চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথার কোথায় চোট লেগেছে, আঘাত গুরুতর কিনা, ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে কিনা, কী কী উপসর্গ দেখা যাচ্ছে রোগীর, এই সবকিছু দেখেই চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক করা হয়। আর কনকাশন হলে ঘুমোনো ঠিক কিনা সেটাও মাথায় আঘাত কতটা গুরুতর পরীক্ষা করে দেখার পরেই জানানো হয়।
কনকাশনকে (Concussion) ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি (Traumatic Brain Injury) । অনেক সময়েই কনকাশন সাময়িকভাবে হয়। মাথায় ভারী কিছুর আঘাতে বা জোরে মাথা ঝাঁকালে, মাথা ঠুকে গেলে কনকাশন হতে দেখা যায়। রোগী জ্ঞান হারাতে পারে, চোখে অন্ধকার দেখে, প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয় মাথায়। অনেকের ক্ষেত্রে রক্তপাত শুরু হয়। বাড়াবাড়ি হলে মস্তিষ্কের ভেতরেও রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তখন হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়। খেলাধূলার সঙ্গে জড়িতদের কনকাশন হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ক্রিকেট বা ফুটবল খেলোয়াড়দের মাথায় বল লেগে কনকাশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই রোগ সাময়িকও হতে পারে আবার আঘাত বেশি লাগলে রোগী সঙ্কটজনক অবস্থাতেও পৌঁছে যেতে পারে।
কনকাশনে ঘুম কি বিপজ্জনক?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেবারেই নয়। একটা ভুল ধারণা আছে, যে কনকাশনের পরে ঘুমোলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে অথবা জটিল মস্তিষ্কের রোগ দেখা দিতে পারে। তেমনটা হয় না। কনকাশন হলে চট করে ঘুমিয়ে পড়তে বা ঝিমোতে বারণ করা হয়। কারণ মাথা সামনের দিকে হেলে গেলে বিপদ হতে পারে। এই সময় ঘাড় ও মাথা যতটা সম্ভব সোজা ও শক্ত রাখলে ভাল হয়। হাল্কা টাওয়েল ঘাড়ের নিচে রেখে মাথা সামান্য পিছনের দিকে হেলিয়ে রাখা বরং ভাল।
কনকাশন হলে চোটের গুরুত্ব বুঝে ডাক্তার দেখানো উচিত। রোগীর উপসর্গ দেখে অভিজ্ঞ ডাক্তারই সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। যদি দেখা যায় আঘাত ততটা গুরুতর নয়, কিন্তু রোগীর মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা, বমিভাব রয়েছে তাহলে চিকিৎসার পরে ডাক্তাররা টানা ঘুমোতেই বলেন। ৬-৮ ঘণ্টা টানা ঘুম হলে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনকাশন মানেই রোগীর মাথা ধরে ঝাঁকুনি দেওয়া, বারে বারে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
কী কী উপসর্গ দেখে বোঝা যাবে কনকাশন হয়েছে
মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের পরে যদি একটানা মাথা যন্ত্রণা হতে থাকে, বমিভাব, ঝিমুনি থাকে তাহলে বুঝতে হবে কনকাশন শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক রোগীরই দৃষ্টি ঝাপসা হতে থাকে, কেউ ক্রমাগত বমি করতে থাকেন। জ্ঞান হারান অনেকেই। আরও কয়েকটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হয়, যেমন রোগী ভুল বকা শুরু করেছে কিনা। চোখের মণির অস্বাভাবিকতা, মাথার দু’পাশের তীব্র ব্যথা, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বা তরল বের হচ্ছে কিনা সেটাও দেখা জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনকাশন হলে অনেকেরই ঘাড়-মাথা শক্ত হয়ে যায়, পেশীর খিঁচুনি শুরু হয়, কথা বলতে ও কথা বুঝতে সমস্যা হয়, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি কমে যায়, অনেকের আবার দমবন্ধভাব বা শ্বাসকষ্টও শুরু হয়। যদি এইসব উপসর্গ একটানা হতে থাকে তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কনকাশনে দরকার নিশ্চিন্ত ঘুম, কীভাবে টিপস দিলেন বিশেষজ্ঞ
মাথায় আঘাতের সঙ্গে যদি মেরুদণ্ডেও চোট লাগে তাহলে বিষয়টা গুরুতর জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেকের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তখন আইসিইউতে ভর্তি করার দরকার পড়ে। চোট সামান্য হলেও, অবহেলা করা উচিত নয়। মাথা ব্যথা, দমবন্ধভাব, ক্রমাগত মাথা ঘোড়া, বমিভাব ইত্যাদি উপসর্গেও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনকাশন জটিল হলেও চিকিৎসায় যদি রোগী সেরে উঠতে থাকে তাহলে তার নিশ্চিন্তের ঘুম দরকার হয়। তাতেই মস্তিষ্কের আরাম হয়।
কনকাশন হলে ঘুমের জটিলতা তৈরি হয়। মাথায় আঘাত থেকে অনেকের স্লিপিং ডিসঅর্ডারও হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব চিন্তা-ভাবনা, উদ্বেগ সরিয়ে রেখে দিনে ৬ ঘণ্টা ঘুম মস্তিষ্কের জন্য ভাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময় শক্ত বালিশ মাথায় দেওয়া ঠিক নয়। ঘাড় সামনের দিকে হেলিয়ে রাখা বা চিত হয়ে শোওয়ার বদলে পাশ ফিরে শুলে বেশি ভাল। মোবাইল বা কোনওরকম ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করা ঠিক নয়। বিশেষত ঘুমের আগে মোবাইলের নীল আলো চোখে গেলে সেটা রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর। কানে হেডফোন না লাগিয়ে ঘরে হাল্কা মিউজিক চালিয়ে রাখা যেতে পারে। তাতে ঘুমের সুবিধা হয়। খেয়াল রাখতে হবে, ঘুমোনোর সময় বেডরুম যেন অন্ধকার থাকে, কোনও জোরালো আলো বা টিভি-ল্যাপটপ-কম্পিউটারের আলো চোখে না পরাই ভাল।
শিশুদের বেশি সতর্কতা দরকার
বাচ্চারা খেলাধূলার সময় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়। চোট অনেকসময়েই গুরুতর হয় না, তবে অভিভাবকদের বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। যদি দেখা যায়, মাথায় কোনও কারণে চোট পেয়ে জ্ঞান হারাল এবং টানা ৩০ সেকেন্ড ধরে অচৈতন্য হয়ে আছে তাহলে সতর্ক হতে হবে। তাছাড়া, মাথায় আঘাত লাগার পরে বারে বারেই বমি হওয়া, রাতে ঘুমোতে গেলে মাথায় ব্যথা, সবসময় ঝিমুনিভাব এই উপসর্গগুলো দেখা গেলে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, মাথায় চোট পেলে বাচ্চাদের আচরণে আদল আসছে। ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, হাত-পায়ের পেশীতে ব্যথা হচ্ছে, হঠাৎ করেই কাওকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে, এই সিম্পটম্পগুলো দেখা গেলে সাবধান হতে হবে। বিশেষত ১২ বছর বা তার থেকে কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা দরকার।