
অর্শ্বে নাজেহাল, কোষ্ঠকাঠিন্যে আকুলিবিকুলি, সমাধান কিন্তু সহজ
দ্য ওয়াল ব্যুরো: গোড়ায় গণ্ডগোল কিন্তু সেই পেট। দিনের শুরুটা যদি পেট বাবাজির মুখ ভার থাকে, তাহলে সারাদিনই মেঘ জমবে। গুড়গুড়, ফুরফুর নানা আওয়াজ। আর পেট খোলসা করতে গেলে কথাই নেই। কেউ যেন সজোরে চাবুক কষাবে মলদ্বারে। তীব্র যন্ত্রণা। একেবারে যেন আছাড়িপিছাড়ি করবে শরীর। সে এখ ভয়ঙ্কর কষ্ট। যার আছে সেই বোঝে।
কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে নাকাল মানুষদের সংখ্যা বড় কম নয়। প্রতিদিন বাথরুমে গিয়ে সিংহনাদ করাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে অধিকাংশ বাঙালিরই। পেট সাফ না হওয়ার যন্ত্রণার সঙ্গে কীভাবে যেন জুড়ে যায় নিত্যদিনের যাবতীয় সঙ্কটগুলো। রাস্তায়-বাসে-ট্রেনে-অটোতে চর্চার বিষয় ঘুরেফিরে সেই একটিতেই এসে থামে–পেট। তার ওপর যদি অর্শ বা পাইলসের সমস্যা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। একে কোষ্ঠকাঠিন্য, তায় পাইলস দুয়ে মিলে একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলে। বাথরুমে যাওয়াটাই বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়।
বাঙালির ঘরে ঘরে থুরি বাথরুমে কান পাতলেই কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত উফ! আফ! শব্দ ভেসে আসতে বাধ্য। পাইলস নিয়ে ভুগছেন এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। মলদ্বার দিয়ে রক্ত পড়া, মাংসপিণ্ড বেরিয়ে ঝুলে থাকা এমন সমস্যা বেশিরভাগেরই। কেউ বলেন, কেউ চেপে যান। হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আরও গোলমাল বাঁধিয়ে বসেন। ছোট বাচ্চাদের মধ্যেও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা ইদানীং বেশিই দেখা যাচ্ছে। যার কারণ তাদের খাওয়ার অভ্যাস। ফাইবারের বদলে জাঙ্ক ফুডে আসক্তি বেশি। তা সে যাই হোক, অনেক সময়েই বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। চাপ দিয়ে মলত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীর তার নিয়ম মেনেই কাজ করবে। মলদ্বারে বেশি চাপ পড়া মানেই পাইলসের মতো উটকো রোগ এসে হানা দেবে।
দিনের শুরুতেই আতঙ্ক, দুরুদুরু মন, বাথরম যেন বিভীষিকা
পেটের নানান বিটকেল রোগ, হজমের গণ্ডগোল, পেট গুড়গুড়, বমি বমি ভাব এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্যও হানা দিচ্ছে স্কুলবেলা থেকেই। আর সেগুলো মোটেই ওই পেট খারাপের মতো ওষুধ খেলেই সেরে যাবে ধরনের সমস্যা নয়। শুরুটা হয় পেটের রোগ দিয়ে। তারপর হানা দেয় কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনস্টিপেশন। ঘ্যানঘ্যানে এই রোগ ছেড়ে যেতেই চায় না। বরং অর্শকে নিমন্ত্রণ করে আনে। অনেক সময় অবশ্য ক্রনিক ডায়ারিয়া থেকেও অর্শ হতে পারে। হজমের সমস্যাকেও হেলাফেলা করলে চলবে না। তাহলে কী দাঁড়াল? গোড়ায় গণ্ডগোল কিন্তু সেই পেট। যাই হোক, পায়ুপথ বা মলদ্বারের রোগ কিন্তু একটা নয়। এর ধরন অনেক। ফিসার, পাইলস, ফিসটুলা পায়ুপথের এই রোগগুলির উপসর্গ অনেকটাই এক। অর্শ মানে মলদ্বারের কাছে ফুলে গিয়ে মাংসপিণ্ড বেরিয়ে পড়ে অনেকের। জোর করে মলত্যাগ করতে গেলে চাপ পড়ে রক্ত বের হয়। ফিসার মানে হল পায়ুপথে ছিঁড়ে যাওয়া। এতেও রক্ত বের হয়। ফিসটুলা মানে হল ঘা হয়ে হয়ে যাওয়া। অনেকেই সঠিক সময় বুঝতে পারেন না, ঠিক কী রোগ বাঁধিয়ে বসে আছেন। তাই সময় মতো ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বিপত্তি বাড়িয়ে তোলেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য বড় বালাই
তিন ধরনের কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়–নরম্যাল ট্রানজিট একদিন-দু’দিনের মতো সমস্যা। তবে সচেতন না হলে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। স্লো ট্রানজিট– একটু একটু করে মাথাচাড়া দেয় কোষ্ঠকাঠিন্য। পেট সাফ না হওয়ার সমস্যা লুকিয়ে গেলে শিকড় গেড়ে বসে পাকাপাকিভাবে। ধীরে ধীরে মলের সঙ্গে রক্ত বেরোতে দেখা যায়। ক্রনিক-ছ’মাসের বেশি লাগাতার এই সমস্যা চললে তাকে বলা হয় Outlet defecation syndrome (ODS)। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে থাকলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। প্রথম থেকে সতর্ক না হলে এই রোগ খিদে কমিয়ে দেয়। খাবারে অনীহার দরুন ঘাটতি পড়ে পুষ্টিতে। সেই সঙ্গে পেটের যন্ত্রণা হয়ে উঠতে পারে নিত্যসঙ্গী। হতে পারে অর্শ, আলসারও। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, চায়ের মধ্যে থাকা রাসায়নিক থিওফাইলিন পরিপাকের সময় শরীর ডিহাইড্রেট করে দেয়। ফলে বেশি চা খেলেও কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগার সমস্যা দেখা যায়।
অর্শচরিত ভয়ঙ্কর
পায়ুপথে যেন পিন ফুটিয়ে দিচ্ছে কেউ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্শ হল অ্যানাল ক্যানালের রোগ। পায়ুপথের শিরা ছিঁড়ে গিয়ে এই রোগ হতে পারে। অর্শের ডাক্তারি নাম হেমারয়েড। এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ কোষ্ঠকাঠিন্য। মলত্যাগে বাধা এলে, পায়ুপথের শিরায় রক্ত চলাচল বাধা পায়। অনেক সময় চাপ পড়ে শিরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অনেকের ক্ষেত্রে শিরা ছিঁড়ে গিয়ে বেশি রক্তপাতও হয়, তখন অস্ত্রোপচার করাতে হয়। ক্রনিক ডায়ারিয়া, বেশি ওজন বা ওবেসিটি, জল কম খাওয়া, ডিহাইড্রেশন, লিভারের রোগ বা লিভার সিরোসিস, অর্শের কারণ অনেক। অনেক সময় পেটে টিউমার থাকলেও অর্শের সমস্যা দেখা দেয়।
গ্রেড ১ থেকে গ্রেড ৪—চার রকমের অর্শ হতে পারে। মাংসপিণ্ড যদি মলদ্বারের রাস্তায় থাকে তাহলে সেটা ফার্স্ট ডিগ্রি হেমারয়েড, যদি কখনও বাইরে আবার কখনও ভেতরে থাকে তাহলে সেকেন্ড ডিগ্রি। যদি সমস্যা আরও বড় হয়, যেমন পায়ুপথের শিরার ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে গেল তাহলে তীব্র যন্ত্রণা হয়, তখন তাকে বলে থ্রম্বোসড হেমারয়েড। আর চতুর্থ ডিগ্রি মানেই মাংসপিণ্ড একেবারে বাইরে বেরিয়ে ঝুলে পড়া, তখন রক্তপাত বন্ধ হয় না অনেকেরই। এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করাতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে কারও অর্শ থাকলেও এই রোগ হানা দিতে পারে। তবে আগে মনে করা হত শুধু বয়স্কদেরই এই রোগ হয়, এখন দেখা যাচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য ও অর্শের সমস্যায় জেরবার তরুণ প্রজন্মও। এর বড় কারণ সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে খাদ্যাভ্যাস। সবুজ সবজি, ফল, ফাইবার যুক্ত খাবার কম খাওয়া। তেল-মশলাদার খাবার, জাঙ্কা ফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার বেশি খাওয়ার প্রবণতা।
পেটের রোগ সারবে, যন্ত্রণার দিন শেষ হবে, সমাধান কিন্তু কঠিন নয়
মেদবৃদ্ধির কারণেও কিন্তু হেমারয়েডসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ওজন বশে রাখা দরকার। করোনা কালে এই ওয়ার্ক ফ্রম হোম কালচারে শরীর নাড়াচাড়াই হয় না। সারাদিনের খাবার পরতে পরতে জমছে। লিভারের দফারফা হচ্ছে। সঠিক ডায়েট আর নিয়মিত শরীরচর্চা, যে কোনও রোগেরই সহজ সমাধান।
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড বা কোলেস্টেরলের সমস্যা থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলস বেশি নাজেহাল করে। সে ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারই রুখে দিতে পারে এই সমস্যা। ওটস, ব্রাউন রাইস, তাল, আলুবোখরা এগুলিতে এমন ফাইবার থাকে। ব্রাউন রাইস, ব্রাউন ব্রেড বেশি করে খেতে পারেন। এগুলো ঘরে না থাকলে চেষ্টা করুন প্রতিদিনের পাতে আটার রুটি রাখার। ভাতেও প্রচুর ফাইবার থাকে। তবে মেদ বৃদ্ধির কারণে যাঁরা ভাতে লাগাম টেনেছেন, তাঁদের জন্য রুটিই শ্রেয়।
প্রোটিন ডায়েট শরীরের পক্ষে উপকারী। কিন্তু বেশি প্রোটিন খেতে হলে সঙ্গে ফাইবারের মাত্রা বাড়ান। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েকটা আমন্ড ও অঙ্কুরিত ছোলা খান। মুগের দানাও খেতে পারেন। কালো বা সবুজ মুগের দানা তেল ছাড়া কড়ায় টেলে নিয়ে রেখে দিন। এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে।
প্রতিদিনের ডায়েটে পেঁপে, ব্রকোলি, গাজর, বিট, বিনস্ রাখুন।
রাতে ৩-৫ গ্রাম ত্রিফলা চূর্ণ ভিজিয়ে সকালে খালি পেটে খান। দীর্ঘ দিন অম্বলের সমস্যাতেও ভাল ফল পাবেন। মুখের দুর্গন্ধ দূর হবে। প্রতিদিন একটা করে ফল খান। কোষ্ঠকাঠিন্যের অসুখ থাকলে বেদানা এড়িয়ে চলুন। তার বদলে আপেল, পেয়ারা, কলা খান।
পৌষ্টিকনালী থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে মুসাম্বির রস। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতেও এই রস কাজে দেয়। আনারসের মধ্যে থাকা উৎসেচক ব্রোমেলিন হজমে সাহায্য করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। লেবুতে থাকা ভিটামিন সি হজমে ও পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।