শেষ আপডেট: 13th June 2023 12:01
ফ্যাটি লিভার ডিজিস অর্থাৎ লিভারের উপরে ফ্যাটের আস্তরণ পড়া, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে ফ্যাটি ইনফিলট্রেশন অফ লিভার-- এটা আজকাল খুব সাধারণ ও পরিচিত একটা টার্ম। আগে কেবল একটা বয়সের পরে এই অসুখ হলেও, বর্তমানে সব বয়সি মানুষের মধ্যেই এই অসুখ হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে এবং অনেকেই ফ্যাটি লিভারের সমস্যায় ভুগছেন। আপাতদৃষ্টিতে শরীরে কোনও অসুবিধা সৃষ্টি না করলেও আপনি যদি এটা নিয়ে সচেতন না হন, তাহলে লিভারের মারাত্মক অসুখ এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই ফ্যাটি লিভার অসুখটির সঙ্গে মদ্যপানের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকলেও, আজকাল নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা কিন্তু অনেক বাড়ছে।
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার সারানোর জন্য কোনও টোটকা বা ম্যাজিক নেই। নেই নির্দিষ্ট কোনও উপায়। যে মেটাবলিক ইমব্যালেন্স তৈরির কারণে লিভারে ফ্যাট জমেছে, সেটাকেই সারিয়ে আগের অবস্থায় ফেরাতে হয়, এটাই এই রোগের চিকিৎসা। যে যে কারণে লিভারে ফ্যাট জমছে, তা শরীরে প্রবেশ করানো বন্ধ করতে পারলেই ৮০ শতাংশ কিওর হয়ে যাবে রোগ, বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঠিক হবে লাইফস্টাইল মডিফিকেশন ও ওষুধ দিয়ে।
ফ্যাটি লিভারের প্রথম ও প্রধান কারণ হল ওবেসিটি বা ওভারওয়েট হওয়া। তবে এ বিষয়ে প্রথমেই যা বুঝতে হবে, ওবেসিটি বা ওভারওয়েট হলে অর্থাৎ ওজন বেশি থাকলেই যে তাঁর মেটাবলিজম অস্বাস্থ্যকর হবে, তা নয়। কিন্তু ওজন বেশি থাকলে তা কমিয়ে ফেলাই ভাল, কারণ তা ভবিষ্যতে নানা সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, যদি আপনার ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা ইনসুলিন রেসিস্টেন্স থাকে, অর্থাৎ সুগার থাকে, তবে তা ফ্যাটি লিভারের সম্ভাবনা বাড়ায়। ইনসুলিন একটি স্টোরেজ হরমোন। রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা যখন বেশি থাকে, তখন শরীরে প্রয়োজন মিটে গেলে লিপিড বা ফ্যাট তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়। ফলে আপনি যদি ভোজন রসিক হন এবং ঘনঘন চিনিযুক্ত খাবার খান, সেক্ষেত্রে বারবার ইনসুলিন স্পাইক হবে এবং শরীরে মেদ তৈরির প্রক্রিয়া চালু হবে।
তৃতীয়ত মেটাবলিক সিনড্রোম থাকলেও তা ফ্যাটি লিভারের জন্য ক্ষতিকর। এটি একটি ডায়গনস্টিক টার্ম, যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং হাই কোলেস্টেরলের কারণ। এটি হাই ট্রাইগ্লিসারাইড, উচ্চ রক্তচাপ-- প্রভৃতি অবস্থাকে একসঙ্গে বোঝায়। লো গ্রেড ক্রনিক ইনফ্লামেশন এই মেটাবলিক সিনড্রোম তৈরি করে লিভারে ফ্যাটি ইনফিলট্রেশন অথবা ফ্যাট জমার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
চতুর্থত, লিভারের উপর তৈরি করা অতিরিক্ত মেটাবলিক লোড। এমন কিছু খাবার আছে, যা কেবলমাত্র লিভারের সেলের দ্বারাই মেটেবলাইজড হতে পারে। যেমন আপনি যখন একটি পাঁউরুটি খেলেন, সেই পাঁউরুটির গ্লুকোজ দেহের যে কোনও অঙ্গ দ্বারাই মেটাবলাইজড হতে পারবে কিন্তু আপনি যখন কোলা জাতীয় পানীয় খাচ্ছেন, তাতে থাকা হাই ফ্রুক্টোজ কন সিরাপ গোত্রের চিনি শুধুমাত্র লিভারের দ্বারাই মেটাবলাইজড হয়। দেহের অন্য কোনও কোষের একে মেটাবলাইজ করার ক্ষমতা নেই। ফলে আমরা যখন নিয়মিত কোলা, কুকি, ক্যান্ডি-- এরকম নানা প্রসেস করা খাবার খেতে থাকি, যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে হাই ফ্রুক্টোজ কন সিরাপ আছে, তা লিভারের ওপরে অতিরিক্ত মেটাবলিক লোড তৈরি করে এবং রক্তেও ইনসুলিন স্পাইক ঘটায়, যা পরবর্তীকালে ফ্যাটি লিভারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পঞ্চমত, লিভারে জমে থাকা টক্সিন ওষুধ বা পেস্টিসাইড, হেভি মেটাল ফুড কেমিক্যাল-- এই সবকিছুই হতে পারে লিভারের জন্য বিষ। অ্যালকোহলের মতোই।
ফ্যাটি লিভারের আরও একটি কারণ হল, যথাযথ পুষ্টি উপাদানের অভাব। দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব থাকলেও লিভার তাড়াতাড়ি ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ে, যা ফ্যাটি লিভার ঘটাতে পারে।
এই অবস্থাকে রিভার্স করতে গেলে অর্থাৎ আগের অবস্থায় লিভারকে ফেরাতে গেলে কী করতে হবে?
প্রথমেই, লিভারকে ভাল রাখে এই সমস্ত পুষ্টি উপাদানগুলি খাবারের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। মেথিওনিন ও সিস্টিন নামের দুটি অ্যামাইনো অ্যাসিড গ্লুটাথাইওন নামক প্রাইমারি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট তৈরিতে সাহায্য করে, যা ইনফ্লামেশন কমায়। কাবলি ছোলা বা যে কোনও রকমের ডাল, বরবটি, মটরশুঁটি, বিনস-- ইত্যাদিতে এই দুই অ্যামাইনো অ্যাসিড ভাল পরিমাণে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, কলিন নামক উপাদানটি ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা কার্যত ফ্যাটি লিভারের ফ্যাট গলাতে সাহায্য করে। চিকেন, ডিম ইত্যাদিতে উপযুক্ত অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলিও ভাল পরিমাণে পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, সবুজ শাকসবজি, বিশেষ করে ক্রুসিফেরা গোত্রের শাকসবজি লিভারের জন্য উপকারী।
চতুর্থত, মিডিয়াম চেন ফ্রাই গ্লিসারাইড লিভারের জন্য ভাল। নারকোল তেল এই গ্লিসারাইডের ভাল উৎস।
পঞ্চমত, লিভার তার টক্সিনগুলিকে গলব্লাডারে জমিয়ে রাখে, যা পিত্তরসের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। যখন আমরা লো ফ্যাট খাবার খাই, তখন পিত্তরস কম বের হয় এবং এর ফলে লিভারের টক্সিনের বহিষ্করণ ঠিকমতো হতে পারে না। তাই জিরো ফ্যাট ডায়েট কখনওই হেলদি নয়। খাবারে গুড কোয়ালিটি ফ্যাট হেলদি রেশিওতে অ্যাড করতে হবে এবং গুড ফ্যাট আছে, এরকম খাবারও খেতে হবে।
শেষতম কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হল, আমাদের শরীর যখন স্ট্রেসে থাকে, তখন ভাইটাল অর্গানে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। কারণ হার্ট ও মাসলে রক্ত বেড়ে যায় নিয়মিত স্টেসে থাকলে। এর ফলে লিভারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া স্ট্রেস বাড়লে কর্সল নামক হরমোনটিও রক্তে বেড়ে যায়, এর ফলে ইনফ্লামেশনও বেড়ে যায়। ক্রনিক ইনফ্লামেশন থেকেই ফ্যাটি লিভার হয়। নিয়মিত মেডিটেশন, ওয়াকিং বা অন্যান্য এক্সারসাইজ, রাতের গভীর ঘুম, ভাল ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যে কোনও একটি ভাল লাগার কাজের সঙ্গে দিনে এক ঘণ্টা সময় কাটানো-- এই সব কিছুই আমাদের স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
নিয়মিত এক্সারসাইজ ও ভাল ঘুম, সেই সঙ্গে আপনার বিশেষ প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করা একটি খাদ্য তালিকা বদলে দিতে পারে আপনার জীবন, আপনার সামনে এনে দিতে পারে আপনারই একটি হেলদি ভার্শন, যার ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেসার, হাই কোলেস্টেরল, অবসাদ, ফ্যাটি লিভার-- ইত্যাদি সমস্যা থাকবে না। সকলকে নিজের এ রকমই একটি ভার্সনের স্বপ্ন দেখার জন্য অনুরোধ রাখছি, সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
মোদীর স্বাস্থ্যমন্ত্রী রোজ বিকেল ৫টায় চারটে করে ডিম খান, তাও লিভারে ফ্যাট জিরো!