
কবি সুকুমার রায় বহুদিন আগেই হয়ত সঙ্কেত দিয়ে গিয়েছিলেন। হাসিখুশি থাকা ভাল। হাসলে শরীর ও মন দুই ভাল থাকে। আহ্লাদী হওয়া ভাল, কিন্তু অতিরিক্ত রকম হলেই বিপদ। এই যে হাসছি কেন, বা কী কারণে সেটাই যদি বুঝতে না পারেন তাহলে কিন্তু লক্ষণ মোটেও ভাল নয়। ধরুন, পাশের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে আর আপনার প্রবল হাসি পাচ্ছে। কেউ বাইক উল্টে পড়ে গিয়ে কাতরাচ্ছেন, আর আপনি ছুটে যাওয়ার পদলে খিলখিল করে হেসে যাচ্ছেন বা হাসি থামাতে পারছেন না। এটাই হল খারাপ লক্ষণ। যদি সারাক্ষণই অকারণে ‘হাসি ভসভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে‘ উঠে আসে, তাহলে সতর্ক হয়ে যান।
ভেবে দেখুন তো, আপনার আত্মীয়, বন্ধু বা প্রতিবেশীদের মধ্যেই কারও সেন্স অব হিউমার হঠাৎ করে বেড়ে গেছে? খুব রাগি, গম্ভীর স্বভাবের মানুষও হঠাৎ করে অকারণে অট্টহাসি হেসে ফেলছেন? যে কথায় পেটে গুঁতো মারলেও এক চিলতে হাসি বের হবে না, তেমন কথাই যদি কেউ হাসেন তাহলে রাগ করবেন না। বরং সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিন। কারণ সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বাড়াবাড়ি রকম সেন্স অব হিউমার ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিনাশের কারণ হতে পারে। অকারণে হাসি, অসংযমী কথাবার্তা ও ব্যবহারে আচমকা বদল—এই তিন লক্ষণ বড় বিপদের আগাম পূর্বাভাস হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বিজ্ঞানীরা ডিমেনশিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। ‘অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ’ নামে একটি সায়েন্স জার্নালে কয়েক বছর আগেই তাঁরা বলেছিলেন, সেন্স অব হিউমারে যদি বদল আসে তাহলে তা পরবর্তীকালে স্মৃতিনাশের কারণ হতে পারে। ৪৮ জন অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে গবেষণা করে তাঁরা জানিয়েছিলেন, রোগ ধরা পড়ার ১৫ বছর আগেই এমন সব বিদঘুটে লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তাঁদের মধ্যে। কেউ অকারণে হাসতেন, কেউ হঠাৎ করেই অপ্রিয় কথা বলে ফেলতেন। অনেকে আবার বলেছিলেন, দমফাটা হাসির শো বা কমেডি দেখে তেমন হাসি পেত না তাঁদের। কিন্তু খারাপ জোকস বা কোনও দুর্ঘটনা দেখলে হাসি পেয়ে যেত। প্রথম প্রথম মনে হত মানসিক বিকৃতির স্বীকার হচ্ছেন তাঁর। পরে জানা যায়, আসলে এসবই ছিল ডিমেনশিয়ার উপসর্গ। স্বাভাবিক আচরণে বদল এসেছিল যাঁদের তাঁরা প্রত্যেকেই ভবিষ্যতে ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ডিমেনশিয়া হল মস্তিষ্কের এমন এক জটিল রোগ যেখানে স্মৃতির বাক্সটাই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্কে সব কাজের জন্যই আলাদা আলাদা কুঠুরি থাকে। স্মৃতি ধরে রাখার বাক্সও থাকে। সেটা যখন নানা কারণে অকেজো হয়ে যায়, তখন মানুষ আর কিছু মনে রাখতে পারে না। শুরুটা হয় রোজকার জীবনের কাজের মধ্যে দিয়ে, শেষে নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা, আত্মীয়-পরিজন সকলকেই ভুলে যেতে শুরু করে রোগী। আগে মনে করা হত ডিমেনশিয়া বুঝি বার্ধক্যেরই রোগ। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, স্মৃতিনাশ যে কোনও বয়সেই হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে বা অন্য কোনও জটিল রোগ থাকলে প্রথমে ডিমেনশিয়া ও তার থেকে পরবর্তীকালে অ্যালঝাইমার্সের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। বুদ্ধিমত্তা বা ‘কগনিটিভ ফাংশন’-এর উপর প্রভাব পড়ে, যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
রাতে কম ঘুম হলে, ইনসমনিয়া বা স্লিপিং ডিসঅর্ডার থাকলে মস্তিষ্কে তার প্রভাব পড়ে। সারাদিন কাজের পরে রাতে মস্তিষ্ক বিশ্রাম করে, নিজের মেরামতির কাজ সারে। সে সময় যদি মস্তিষ্ককে সজাগ করে রাখা হয় তাহলে সেই মেরামতির কাজ বাধা পায়। সারাদিনের টক্সিন পরিষ্কার করার বদলে মস্তিষ্কেই ময়লা জমতে থাকে। অনেকের রাতের দিকে রক্তচাপ বেড়ে যায়, একে ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘রিভার্স ডিপিং’, তেমন হলে মস্তিষ্কে এর প্রভাব পড়ে। তখন স্মৃতিনাশের সমস্যা দেখা দেয়। যার পরিণাম অ্যালঝাইমার্স। গবেষকরা বলছেন, তাই গোড়া থেকি সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবহারে বদল, কথাবার্তা, আচার-আচরণে পরিবর্তন, অতিরিক্ত সেন্স অব হিউমার, এসবই রোগের ইঙ্গিত দিতে পারে।