
চৈতালী চক্রবর্তী
‘বন্দি প্রাণ মন হোক উধাও, শুকনো গাঙে আসুক জীবনের বন্যার উদ্দাম’
বন্দিদশা ঘুচছে ধীরে ধীরে। করোনা আতঙ্ক সইয়ে নিয়ে স্বাভাবিক হচ্ছে জীবন। লকডাউনের রাশ আলগা হয়ছে। মানুষ বাইরের জগতে আবার স্বচ্ছন্দ্য হচ্ছে। আগামী দিনে নিউ-নর্মালের সঙ্গে আরও বেশি খাপ খাইয়ে নেবে মানুষ। কিন্তু এই দীর্ঘ দু’বছর ধরে করোনা অতিমহামারী মানসিক স্বাস্থ্যকে যেভাবে ছিন্নভিন্ন করেছে সেখান থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসা কতটা সম্ভব সে নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষের মনেই এখন ট্রমা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, প্রবল মানসিক চাপ, সেই থেকে চরম অবসাদ দানা বেঁধেছে। করোনা শরীরকে যতটা তছনছ করেছে তার থেকেও বেশি ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে মনকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি নিয়ে এখন উঠেপড়ে লেগেছে চিকিৎসক মহল।
এবছরের কেন্দ্রীয় বাজেটেও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেট পেশের সময় ঘোষণা করেছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে দেশজুড়ে ২৩টি ন্যাশনাল টেলি মেন্টাল হেল্প সেন্টার খোলা হবে। মানসিক যে কোনও সমস্যার চিকিৎসায় টেলি পরিষেবার সুবিধা পাবেন রোগীরা। ডাক্তারের চেম্বারে ছুটে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ অনেকেরই হয় না। তাছাড়া কোথায় কাউন্সেলিং করাবেন, কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন ইত্যাদি নিয়েও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। চিকিৎসা শুরু হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এই সমস্য সমাধানের জন্যই জেলা জেলায় খোলা হবে টেলি মেন্টাল হেল্প সেন্টার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে করোনা কতটা ক্ষতি করেছে মানসিক স্বাস্থ্যের। কোন কোন দিকে মেন্টাল হেলথ চরম বিপর্যয়ের মুখে।
প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় বলছেন, করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য ভাঙছে। এর নানা দিক রয়েছে। সংক্রমণের জন্য উদ্বেগ, লকডাউনে গৃহবন্দি দশায় মানসিক অবসাদ, গার্হস্থ্য হিংসার বাড়বাড়ন্ত, সম্পর্কে টানাপড়েন, শিশুদের সামাজিক ক্ষেত্রে মেলামেশায় বাধা, বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যুর আতঙ্ক ইত্যাদি।
রোগের অনিশ্চয়তার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে মানুষের মনে। আমারও কি সংক্রমণ হবে? রোগ না সারলে কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে? আপনজনের ক্ষতি হবে না? ইত্যাদি চিন্তাভাবনা থেকে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের শঙ্কা বেড়েছে।
আসলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই পর্যায়ে শারীরিক জটিলতা যতটা না তৈরি হচ্ছে, মানসিক অস্থিরতা তার থেকে অনেক বেশি। ভয় আর আতঙ্ক থেকে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে যা বড় আকার নিচ্ছে। এই মানসিক সমস্যা একজন বা দু’জনের নয়। উদ্বেগে ভুগছে সমাজের একটা বড় অংশই। সেখানে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি সরকারি অধিকর্তারাও রয়েছেন। তাই সমস্যাটা সকলেরই।
এটা গেল একটা দিক, তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অনেকে। বেকারত্ব বেড়েছে, সেই সঙ্গেই বেড়েছে মানসিক চাপ। প্রচণ্ড স্ট্রেস গ্রাস করেছে মন ও মস্তিষ্ককে। আর্থিক মন্দা, অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে এমন এক ট্রমায় নিয়ে গেছে যে সেখান থেকে ফিরে আসার পথটা খুব কঠিন।
দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকা, সামাজিক মেলামেশা না করতে, কোথাও ঘুরতে যেতে না পারা ইত্যাদি থেকে হতাশা তৈরি হচ্ছে মনে। সবক্ষেত্রে যে মানসিক রোগ হচ্ছে তা নয়, তবে হতাশা থেকে অবসাদ বাড়ছে। এই অবসাদই একসময় বড় আকার নিচ্ছে।
সেকেন্ড ওয়েভের সময় প্যানিক অ্যাটাক মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের মনে সবসময় ভয় কাজ করত। সংক্রমণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাবে কিনা, হাসপাতালে বেড পাব কিনা, অক্সিজেন কমে গেলে কী হবে, শ্বাসকষ্টে যদি মৃত্যু হয়, এইসব ভাবনা থেকে প্যানিক অ্যাটাক হতে দেখা গেছে অনেকের। নানাভাবে মানসিক চাপে ভুগছেন বয়স্করাও। মৃত্যুভয় তৈরি হয়েছে অনেকের মনে। আপনজনদের হারানোর ভয় থেকে ট্রমাও তৈরি হয়েছে।
ভাইরাসের সংক্রমণে তাঁদের তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হবে, সেখান থেকে মৃত্যু হবে এমন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে অনেকের মনেই। হয় তীব্র অবসাদ, না হলে সোশ্যাল ফোবিয়া। তাছাড়া ভুল বকা, ভুলে যাওয়া, স্লিপিং ডিসঅর্ডার তো রয়েছেই। মানসিক চাপ এতটাই যে তার থেকে স্লিপিং ডিসঅর্ডার দেখা দিচ্ছে অনেকের মধ্যেই। অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, ইনসমনিয়ার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
এই ধরনের মানসিক পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার একটাই পথ, তা হল কাউন্সেলিং। সে টেলি পরিষেবায় হোক বা মুখোমুখি চিকিৎসা, কাউন্সেলিং না করালে প্যানিক থেকে বেরিয়ে আসা খুব মুশকিল।
সম্পর্কের জটিলতা, গার্হস্থ্য হিংসা গভীর মানসিক অবসাদের কারণ
ডা. অনিন্দিতা বলছেন, সম্পর্কের টানাপড়েন বড় আকার নিয়েছে এই লকডাউনে। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যদি কোনও সমস্যা থাকে তা অনেক বেশি প্রকাশ্যে চলে এসেছে এই সময়। এটা যেমন একদিকে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যে ছাপ ফেলেছে, তেমনি পরিবারের লোকজনের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। সম্পর্কের জটিলতা এতটাই বেড়েছে যে তার থেকেও অবসাদে চলে যেতে দেখা গেছে অনেককে। ইদানীংকালে এমন অনেক রোগীই এসেছেন যাঁরা পারিবারিক কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি, পরিবারের অন্য লোকজনদের সঙ্গে বনিবনা নিয়ে সমস্যা, এই দিকগুলো এখন অনেক বেশি সামনে আসছে। আগে পেশাগত কারণে অনেকটা সময় বাইরে থাকতে হত। এখন ‘ওয়ার্ক ফর্ম হোম’ কালচারেই অভ্যস্ত হচ্ছেন সকলে। তাই বেশিটা সময় বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। ঝামেলার সূত্রপাত এখান থেকেই।
গার্হস্থ্য হিংসা থেকেও জটিল মানসিক ব্যধির শিকার হচ্ছেন অনেকে, এমনটাই মত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকারের। তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ একদিকে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে, অন্যদিকে সংক্রমণ থেকে রেহাই পেতে মানুষ তার স্বাধীনতা হারিয়ে অন্দরবাসে থাকতে বাধ্য হয়েছে। চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি জীবনের হাঁসফাঁস আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গার্হস্থ্য হিংসা, নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা। সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন মহিলারা। বাড়িতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্করা, যা গভীর ট্রমায় নিয়ে গেছে অনেককে।
মানুষ চরম আতঙ্ক ও আশঙ্কায় ভুগছে। যার থেকেই বিরক্তিভাব, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। সামাজিক মেলামেশার রাস্তা যেহেতু বন্ধ তাই পরিবারের লোকজনের উপরেই বিরক্তি বা রাগের প্রভাব বেশি পড়ছে। যার কারণেই গার্হস্থ্য হিংসা বাড়ছে। মানসিক স্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে অনেকেরই। মেজাজ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। যার কারণে এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা বেড়ে চলেছে।
ঘরকুনো হয়ে পড়ছে বাচ্চারা, অবাধ্য হচ্ছে
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকার বলছেন, করোনা এবং লকডাউনের কারণে বাচ্চারা সামাজিক মেলামেশা ভুলেছে। ঘরকুনো হয়ে পড়ছে। এখন খেলাধূলার থেকে ডিজিটাল মিডিয়াতেই বেশি সময় কাটে বাচ্চাদের। এক ধরনের ডিজিটাল অ্যাডিকশন তৈরি হচ্ছে যা তাদের ভবিষ্যতের ওপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলবে।
মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে বাচ্চাদের, অবাধ্য হচ্ছে। অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেশা তৈরি হচ্ছে। এমনটাই জানালেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ। তাঁর মত, অনলাইন গেম হোক বা পর্নোগ্রাফি সাইট, বাচ্চারা এখন এমন কিছু দেখছে বা শুনছে যা তাদের বয়সে হওয়া উচিত নয়। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের সমস্যা আরও। দেখা গেছে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে কমবয়সীদের মধ্যে। সাইবার অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছেন অনেকে। আবার ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ চক্রের শিকারও হতে হয়েছে অনেককে। তার থেকেও গভীর মেন্টাল ট্রমার শিকার হয়েছে জেন এক্স-জেন ওয়াই।
বাচ্চারা যেখানে ছোটাছুটি, খেলাধূলা করতেই অভ্যস্ত সেখানে দীর্ঘ সময় অন্দরবাসে থাকাটা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। মনের বিকাশ হচ্ছে না অনেকেরই। এমনকি কথা বলার সমস্যাও দেখা দিচ্ছে শিশুদের মধ্যে। মেলামেশা বন্ধ থাকায় খিটখিটে মেজাজ দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদেরও। সেই সঙ্গে তাদের খাদ্যাভ্যাসেও বদল আসছে। যখন তখন খাওয়া, অপুষ্টিকর খাবার খাওয়ার ঝোঁকে ওজন বাড়ছে বাচ্চাদের। ওবেসিটির শিকার হচ্ছে অনেকেই।
লকডাউনের প্রভাব পড়েছে নানা বয়সের মানুষের উপরে। ‘জেন জেড’ অর্থাৎ ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীরাও নানা কারণে মানসিক চাপ ও অবসাদের শিকার। যার কারণ অনেক। যেমন, মেলামেশা বন্ধ, সারাদিন বাড়িতে ইন্টারনেটে ডুবে থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে অনেকেরই। সামান্য কারণেই বিরক্ত হতে দেখা যাচ্ছে তরুণ, তরণীদের। অভিভাবকদের এই সময় আরও বেশি করে বাচ্চাদের সঙ্গ দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের বোঝানো, মন ভাল রাখতে নানা সৃজনশীল কাজে তাদের উৎসাহ বাড়ানো খুবই দরকার। তা না হলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে যার ফলে নানা জটিল মানসিক রোগও দেখা দিতে পারে।