
রসুলপুর ও প্রাচীন ভৈটা পালসিট
রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এখন ঘরের বাইরে বেরোতেও মানা। বেড়াতে যাওয়ার চ্যাপ্টার আপাতত ক্লোজ। লকডাউন চলছে। বাসা-বন্দি বাঙালির প্রাণপাখি ছটফট করছে। শুয়ে, বসে, গার্হস্থ্যকর্ম সেরেও সময় যেন কাটছে না। তবুও ‘পায়ে পায়ে বাংলা’ যথারীতি প্রকাশিত হল। আপাতত ভ্রমণকাহিনি পাঠেই হোক আপামর বাঙালির মানসভ্রমণ।
রসুলপুর স্টেশন থেকে এক মিনিটের হাঁটাপথে চাকনাড়া গ্রাম। সেখানে এক লক্ষ গাছ, সাতটি বড় জলাশয় নিয়ে ৭২ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে মালঞ্চ নেচার পার্ক।
এখানে এলে প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করা যায়। লেক, পিকনিকের আলাদা জায়গা, থাকার জন্য কটেজ, ফুডফোর্ট, শিশুদের মজার জন্য পার্ক ও হরেক বিনোদনের এক সবপেয়েছির দেশ। ৫টি কটেজ, একতলায় ৬টি সুপিরিয়র রুম ও দ্বিতলে ৬টি ডিলাক্স রুম রয়েছে। রয়েছে সুস্বাদু খাবার, পুকুরে ধরা টাটকা মাছের স্বাদ নিয়ে নিজস্ব খাবার ঘর। থাকতে চাইলে শহরের কোলাহল থেকে দূরে দু’দিন জুড়িয়ে নেওয়া যায়। পার্কে সাধারণের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। সময় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। বনভোজনের জন্য রয়েছে বহু শেড। কলকাতা থেকে দূরত্ব মাত্র ৮৬ কিলোমিটার। বর্ধমান থেকে ট্রেনে বা বাসে আসা যায়। সারা বছরের জন্য রাত্রিবাসের বিশেষ সিলভার কার্ড ও গোল্ড কার্ড চালু আছে।
যোগাযোগের জন্য দূরভাষ : ৯৮৩৬৭৩১১৮৩, ৯৩৩১৮৬০৪৭৬। ওয়েবসাইট : www.malanchanaturepark.net
বড়শুল
শক্তিগড় স্টেশন থেকে বাসে বা টোটোয় তিন কিলোমিটারের মধ্যেই প্রাচীন গ্রাম বড়শুল। পাশ দিয়ে দামোদর নদ বয়ে গেছে। নদীর ধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম। কলতলা বাসস্টপ থেকে একটু ভেতরে সাত বিঘা জমির ওপর অতিকায় দে পরিবারের জমিদার বাড়ি।জমিদার বাড়িতেই রয়েছেন কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর জিউ, শিবমন্দির, দোলমঞ্চ প্রভৃতি। কুলদেবতার নিত্যপূজা, রাস, দোল, দুর্গা পূজা, গাজন এখনও হয়। গ্রিক ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির অনুকরণে দুর্গামণ্ডপটি দেখার মতো। পরিবারের উত্তরসূরি হিমাদ্রীশঙ্কর দে এই বাড়িতে ‘শুভেন্দ্রমোহন দে ঐতিহাসিক সংগ্রহালয়’ তৈরি করেছেন। জমিদারির জিনিস ছাড়াও অনেক সংগ্রহ রয়েছে। গিয়ে যোগাযোগ করলে তিনিই ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেন। এছাড়া এই গ্রামে পিরের থান, জোড়া শিবমন্দির, ধর্মরাজের মন্দির রয়েছে। ধর্মরাজের গাজন ও শিবের গাজন, শ্মশানকালীর পূজা এখানে বিখ্যাত। এখানে এসে শক্তিগড়ের ল্যাংচার স্বাদ অবশ্যই নিতে হবে।
পালসিট-ভৈটা
শক্তিগড় থেকে অনতিদূরে বাঁকা নদীর তীরে পালসিট গ্রামটি খুবই প্রাচীন। বর্ধমান-হাওড়া মেন লাইনে পালসিট স্টেশনে নেমে হেঁটে, রিকশায় বা টোটো করে উত্তরে দুই কিলোমিটার মতো এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে পালসিট-ভৈটা গ্রামকে। গ্রামটি শান্ত, মনোরম। এ গ্রামের বিশেষ দ্রষ্টব্য হল গোস্বামীপাড়ায় মদনগোপাল জিউয়ের মন্দির। মন্দিরটি সুউচ্চ এবং আটচালা। বর্তমানে সংস্কারের কাজ চলছে। তাই পাশেই একটি ছোট ঘরে মদনগোপালকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। নিমকাঠের তৈরি মদনগোপালের মূর্তিটি শ্রীকৃষ্ণের বালগোপালের ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। এত অপরূপ মূর্তি যে চোখ ফেরানো মুশকিল। এরকম মূর্তি এখানে পূজিত হবার অন্তরালের ইতিহাস আছে।
প্রায় ৫০০ বছর আগে এক বৈষ্ণব সাধক শ্যামাদাস আচার্য কালনা থানার মতিসর থেকে এসে এই গ্রামে সাধনভজনের জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেই তিনি মদনগোপালের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায়, শ্যামাদাস আচার্য ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের পুত্র, মতান্তরে শিষ্য। কুলীন গ্রামের কাছে নবগ্রামে তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি শক্তিশালী শ্রীপাট আছে। তাঁর চেষ্টাতেই পরবর্তীকালে ভৈটা, পালসিট, বিজুর ও মাতিসর গ্রামে বৈষ্ণবধর্ম প্রসারলাভ করে।
এই বিগ্রহ আজও এই গ্রামের গোস্বামী বংশের কুলদেবতা। এই বিগ্রহের কথা শুনে বর্ধমানের রাজারা বহু নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি দান করেন। বিগ্রহকে কেন্দ্র করে গ্রামে গড়ে ওঠে এক বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডল। প্রতি বছর রাস ও দোলের সময় উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শ্যামাদাসের তিরোভাবের পর তাঁর সমাধির ওপর রত্নবেদি নির্মাণ করে মদনগোপালকে তার ওপর স্থাপন করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে শ্যামাদাসের শ্রাদ্ধবাসর উপলক্ষ্যে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবে বিভিন্ন স্থান থেকে ৪-৫ হাজার ভক্ত ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ এই গ্রামে হাজির হন। অখণ্ড হরিনাম সংকীর্তন, গীতাপাঠ, কীর্তন গান, ভাগবত পাঠ চলতে থাকে। মন্দিরে প্রতিষ্ঠালিপি নেই, ফলে মন্দির প্রতিষ্ঠার কাল জানা যায় না। গ্রামের মধ্যে নাটমন্দির-সহ এত বড় আটচালা মন্দিরের অবস্থান বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মন্দিরের ভেতরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা আছে। পাশে রয়েছে ভোগের ঘর। এই ঘরের গায়ে একটি লিপি রয়েছে যেটি হুবহু তুলে দেওয়া হল–
‘শ্রীশ্রী ঁমদনগোপাল জীউর পাকশালা
ভৈটাগ্রাম নিবাসী স্বর্গত ঁপ্রাণচন্দ্র পালিত মহাশয়ের
অক্ষয় স্বর্গপ্রার্থী তদীয় ভাগিনেয় বদান্যবর শ্রীমান হরিপদ মিত্র
কর্তৃক ইহা পুননির্মিত হইল। তজ্জন্য আমরা
রামচন্দ্র পাকশালা
ইহার নাম রাখিলাম। ইতি সন, ১৩০৭ সাল মাহ ফাল্গুন।’
এর থেকে বোঝা যায় মদনমোহনের নিত্যভোগের ব্যবস্থা আছে। এই গ্রামটি এতটাই সমৃদ্ধ যে স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং এই গ্রামে এসেছিলেন মদনগোপালকে দর্শনের জন্য। তিনি এসে যে বাড়িতে বসেছিলেন সে বাড়ি আজও আছে। দেখার আগ্রহ থাকলে গ্রামবাসীরা পরমযত্নের সঙ্গে ‘বিবেক কুঠি’ দেখিয়ে দেবেন।
পাল্লা রোড
হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে শক্তিগড়ের পরের স্টেশন পাল্লা রোড। দামোদরের তীরে একেবারে উন্মুক্ত প্রান্তরে পাল্লা অবস্থিত। স্টেশন থেকে রিকশায় ৫ কিলোমিটার পথ পেরোলেই গন্তব্যস্থল। এখানে দামোদর বাঁক নিয়েছে, স্বভাবতই সৌন্দর্যের বৃদ্ধি হয়েছে। কেবল ধূধূ বালুচর নয়, সর্ষে ফুলের খেতে হলুদ ফুলে প্রকৃতি এতটাই মোহময়ী যে ছেড়ে যেতে ইচ্ছেই করবে না। থাকার জন্য রয়েছে সেচ বিভাগের ডাকবাংলো। বুকিং হয় বর্ধমান সেচ বিভাগের অফিস থেকে। শীতের দুপুরে নৌকায় নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানো উপরি পাওনা। পিকনিকের জন্য এটি একটি দারুণ স্পট। এতটাই যে চিত্র পরিচালকরা বেশ কিছু বাংলা ছবির শ্যুটিং করতে দ্বিধা করেননি। শীতের মরসুমে বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে ভিড় উপচে পড়ে। পিকনিকের বাজার কলকাতা থেকে করে নিয়ে যাওয়াই ভাল।
রাত্রিবাসের ঠিকানা– মালঞ্চ নেচার পার্ক, চলভাষ– ৯৩৩১৮৬০৪৭৬।
কাছেপিঠে আরও নানা জায়গায় বেরিয়ে পড়তে ক্লিক করুন নীচের লাইনে।