এখন ঘরের বাইরে বেরোতেও মানা। বেড়াতে যাওয়ার চ্যাপ্টার আপাতত ক্লোজ। লকডাউন চলছে। বাসা-বন্দি বাঙালির প্রাণপাখি ছটফট করছে। শুয়ে, বসে, গার্হস্থ্যকর্ম সেরেও সময় যেন কাটছে না। তবুও ‘পায়ে পায়ে বাংলা’ যথারীতি প্রকাশিত হল। আপাতত ভ্রমণকাহিনি পাঠেই হোক আপামর বাঙালির মানসভ্রমণ।
পুরুলিয়ার উত্তরে গিরি পঞ্চকোট, দক্ষিণে অযোধ্যা পাহাড় আর মাঝখানে ইতিহাস প্রসিদ্ধ জয়চণ্ডী পাহাড়। চারপাশে অনাবিল সমুদ্রের মাঝে হঠাৎ যেন এক পাথুরে বিস্ময়। ঝকঝকে মৃত্তিকাহীন নিরেট পাথর। মনে হয় গন্ধমাদন হাতে যখন হনুমান উড়ে যাচ্ছিল, হাত ফসকে বিশাল বিশাল সব পাথর পড়ে গিয়েছিল রঘুনাথপুরের কাছাকাছি এই মাঠে। তাই এমন হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়। ভারি অদ্ভুত তার সৌন্দর্য।
জয়চণ্ডী পাহাড়ের পরিচিতি বা খ্যাতি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের অন্যতম হল শৈলারোহণ। জয়চণ্ডী পাহাড় হল এই শৈলারোহণের একেবারে আদর্শ স্থান। এখানে প্রতিবছর নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বহু পর্বতারোহণ সংস্থা শৈলারোহণ শিক্ষা শিবির বা প্রকৃতি বীক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে। এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা ছিল না, বর্তমানে সে অভাব মিটেছে। যাঁরা এখানে রক ক্লাইম্বিং বা নেচার স্টাডি ক্যাম্পে আসেন তাঁরা বেশিরভাগ তাঁবু সঙ্গে আনেন। তবে সরাসরি এখানে থাকা না গেলেও দুই কিলোমিটার দূরে রঘুনাথপুরে অবশ্যই থাকা যেতে পারে।
জয়চণ্ডী পাহাড় কয়েকটি বড় বড় পাহাড়ের সমষ্টি। চারটি পাহাড়ের নাম যথাক্রমে যোগীঢাল, জয়চণ্ডী, ঘোরী ও সিজনী। ২০০ থেকে ২৬১ মিটারের মধ্যে উচ্চতা। ঘোরী এবং সিজনীকে সীতাপাহাড় ও কালীপাহাড় বলেও ডাকা হয়। সবচেয়ে উঁচু, খাড়া ও মসৃণ পাহাড় হল যোগীঢাল। যোগীঢাল একেবারে ন্যাড়া, রুক্ষ ও গাছপালাহীন। চূড়াটি যেন বর্শার ফলা। কিংবদন্তিতে বলে, অতীতে নাকি পঞ্চকোট রাজারা দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে যোগীঢাল পাহাড়ের চূড়া থেকে ছুড়ে ফেলে দিতেন। এই পাহাড়টি এত উঁচু খাড়াই যে রক ক্লাইম্বিং পদ্ধতির সাহায্যে উঠতে হয়। ওঠার পথে ডান দিকের গুহাতেই বিখ্যাত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার পাঠশালার শিক্ষকমশাইয়ের আত্মগোপন করার দৃশ্যটির শ্যুটিং হয়। এই পাহাড়ের পূর্ব দিকে পাঞ্চেত পাহাড়, পূর্ব-দক্ষিণে বেরো পাহাড়। আসলে পূর্বে বেরো থেকে পশ্চিমে পাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে এক বিশাল গ্রানাইট পাথর। এই গ্রানাইটের শরীরের একটি জেগে থাকা অংশ হল জয়চণ্ডী পাহাড়। এই পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে গ্রামের ঘরবাড়ি, দূরে রঘুনাথপুর শহর, জয়চণ্ডী স্টেশন দেখতে দেখতে মনটা ভাল লাগায় ভরে ওঠে।
জয়চণ্ডী পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ওয়াচ টাওয়ারটি খুবই আকর্ষণীয়। ১৮৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে মুম্বই পর্যন্ত প্রতি আট মাইল অন্তর ‘সীমাফোর স্তম্ভ’ নির্মাণ করে মিলিটারি হেড কোয়ার্টারের খবর পাঠানোর জন্য। এক স্তম্ভ থেকে আর এক স্তম্ভে পতাকা উড়িয়ে ‘কোড’ এর সাহায্যে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করা হত। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে টেলিগ্রাম আবিষ্কৃত হওয়ায় ‘সীমাফোর স্তম্ভ’ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতা, হুগলি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার পর ঝাড়খণ্ডের সতনপুর গ্রামের দু’দিকে দু’টি স্তম্ভ নির্মাণের পর প্রকল্পটি চিরকালের জন্য পরিত্যক্ত হয়। পুরুলিয়া জেলায় এই ধরনের তিনটি স্তম্ভ বা মিনার আছে। সাঁওতালডি থানার গৈরাব পাহাড়ে, কাশীপুর থানার ধনারডি পাহাড়ে এবং রঘুনাথপুর থানার জয়চণ্ডী পাহাড়ে।
জয়চণ্ডী পাহাড়ের মাথায় প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো চণ্ডীমন্দির অবস্থিত ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পে মূল মন্দিরটি ভেঙে যায়। কেউ কেউ বলেন, মন্দিরটি পঞ্চকোট রাজের তৈরি; আবার কারও মতে, ডাকাতের হাতে তৈরি। এই চণ্ডীর নামেই পাহাড় ও স্টেশনের নাম। পুরনো স্থাপত্যের কিছুটা ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন মন্দির। ২০০৩ সালে শ্বেতপাথরের একটি চণ্ডীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেবী বাঘের ওপর উপবিষ্ট। তার আগে শিলায় পূজা হত। বর্তমানে সিমেন্টের বাঁধানো রাস্তা তৈরি হয়েছে। অতএব মন্দিরে ওঠার কোনও সমস্যাই নেই। সকাল ন’টা থেকে দুপুর একটা আর বিকেল চারটে থেকে ছ’টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। ১ মাঘ ও ২০ মাঘ মূল উৎসব। ১ মাঘের উৎসবে ক্ষীর, খিচুড়ি ও তিলের পিঠে দেবীকে নিবেদন করা হয়। বর্তমান সেবাইত নবকুমার দেওঘরিয়ার কাছ থেকে জানা গেল যে, ২০ মাঘ প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিবছর বিশেষ উৎসব হয়। একশোরও বেশি স্থানীয় মেয়ে ঘটে জল নিয়ে মাথায় করে শহর ঘুরে মন্দিরে উপস্থিত হন। সেই জল দিয়ে দেবীকে স্নান করানো হয়। সারাদিন ধরে পুজোপাঠ চলে। অন্য কারও পুজো সেদিন নেওয়া হয় না।
এটি একটি খুব সুন্দর পিকনিক স্পট বলেও বিবেচিত হয়। বহু দূর থেকে মানুষজনেরা শীতকালে বনভোজনের জন্য এখানে আসেন। জয়চণ্ডী পাহাড়ের অতিরিক্ত আকর্ষণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা জয়চণ্ডী মেলা বা জয়চণ্ডী পাহাড় পর্যটন উৎসব যা ডিসেম্বরের শেষে অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলায় প্রচুর পর্যটক আসেন।
কলকাতা থেকে এখানে আসা যায় দু’ভাবে। হাওড়া থেকে রাত্রে ছাড়ে ৩১৫ আপ হাওড়া-চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। সেই ট্রেনটি এখানে পৌঁছনোর একটু পরেই ছাড়ে আদ্রা আসানসোল ইএমইউ লোকাল। এটি ধরে আদ্রার পরের স্টেশন জয়চণ্ডী পাহাড়ে নামতে হবে। অন্য দিকে হাওড়া থেকে আসানসোল এসে ট্রেন বদল করে আসানসোল-আদ্রা লোকাল ধরে জয়চণ্ডী পাহাড় স্টেশনে নামতে হবে।
রঘুনাথপুর
পাহাড়ের সামনে পুরুলিয়া জেলার সর্বপ্রাচীন শহর হল রঘুনাথপুর। পুরুলিয়া শহর থেকে এই শহরের দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম জেলারূপে পাঁচেটকে সৃষ্টি করেছিলেন। তার সদর শহর ছিল রঘুনাথপুর। এই শহরটি জেলার ইতিহাসের বহু কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে। পঞ্চকোট রাজপরিবার শাক্তধর্ম থেকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হলে মন্দিরগুলিও নতুনভাবে নির্মিত হতে শুরু করে। পঞ্চকোট পাহাড়ের ওপর বিশাল রঘুনাথ মন্দির নির্মাণ হয়। কেবল তাই নয়, রঘুনাথপুর, আচকোদা, বেরো, আড়রা গ্রামেও পরপর রঘুনাথ মন্দির তৈরি হতে থাকে। রঘুনাথপুরের মালিগলিতে রঘুনাথ মন্দির জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরটি টেরাকোটার। দেবতা অপসৃত হয়েছেন। যদিও এই মন্দিরের দেবতার নামানুসারে রঘুনাথপুরের নামকরণ হয়েছে। রাজার আরাধ্য দেবতা যে রঘুনাথ, তা দেবতার নামে তৈরি হওয়া শহরটি স্মরণ করায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মহাবিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল, জজ কোর্ট সব নিয়ে রঘুনাথপুর এক জমজমাট শহর।
রঘুনাথপুরে রঘুনাথ মন্দির ছাড়াও বেশ কিছু মন্দির আছে যেগুলি পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। যেমন বরাকর রোডের ওপর চেলিয়ামা যাবার মোড়ের কাছে বড় কালী মন্দির। মাকালীর মূর্তিটি বিশাল। জয়চণ্ডী পাহাড় যেতে নন্দুয়াড়া মোড়ে রয়েছে রাম মন্দির। আধুনিককালে নির্মিত মন্দিরটি। রাম, লক্ষণ, সীতার মূর্তিগুলো এককথায় দারুণ। আইটিআই-এর পাশে বিশাল ক্যাম্পাস নিয়ে রায়মাতা মন্দির। মন্দির ও মন্দিরের দেবীমূর্তি নজরকাড়া।
রঘুনাথপুর তসর শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। চেলিয়ামা যাবার রাস্তায় রয়েছে রেশম শিল্প অধীক্ষকের করণ, এখানে পলু চাষ হয়। রঘুনাথপুরের তাঁতিপাড়ায় এখনও ৭০/৮০ ঘর এই তসর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রঘুনাথপুরের সিল্কের প্রসিদ্ধি এমনই যে, শোনা যায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রঘুনাথপুরের তসর খুবই পছন্দ করতেন।
রঘুনাথপুরে বর্তমানে থাকার কোনও অসুবিধা নেই। বেশ কতগুলি লজ রয়েছে, যেমন পঞ্ছবটী লজ, দূরভাষ : ৯৪৭৫১৮৩৪৬৬। রঘুনাথপুর লজ, চলভাষ : ৯৭৩২১১৫৮১১। মানভূম লজ, চলভাষ : ৯৯৩২৪১৫৬৪৮। এছাড়াও অসংখ্য লজ, রিসর্ট, বাংলো রঘুনাথপুরে রয়েছে। এই শহরের সঙ্গে পুরুলিয়ার সব শহরের বাস যোগাযোগ রয়েছে।
কাছেপিঠে আরও নানা জায়গায় বেরিয়ে পড়তে ক্লিক করুন নীচের লাইনে।