Latest News

অতীত ইতিহাসের হিজলি

রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য

যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, যাঁরা দেখতে চান বাংলার মুখ, তাঁদের কথা মনে রেখেই এই ধারাবাহিক। খুঁজে নিন আপনার পছন্দের জায়গা, গুছিয়ে ফেলুন ব্যাগ, হুস করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষে। আপনার সঙ্গে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে বাংলা’।

হিজলি শব্দের মধ্যেই একটা মাদকতা আছে। ভূগোল, ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অটুট বন্ধনে গ্রথিত হিজলি। হিজলিকে জানতে গেলে একটু ইতিহাস, একটু ভূগোল না জানলে পরিক্রমা কেবল নীরস পরিক্রমায় পর্যবসিত হবে।
রসুলপুর নদী গঙ্গার শেষ উপনদী। এই সেই বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’-র রসুলপুর নদী। রসুলপুর নদী যেখানে গঙ্গায় মিশেছে সেই সংযোগস্থলের উত্তর তীরে হিজলি এবং দক্ষিণ তীরে দরিয়াপুর।

চতুর্দশ শতাব্দী ছিল তাম্রলিপ্ত বন্দরের অন্তিমকাল। তারপর নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশার পিপলি বন্দর থেকে হিজলিতে কিছু পর্তুগিজ বণিক আসে। হিজলি অঞ্চল তখন ঘন জঙ্গলে ঢাকা, বসবাসের কোনও সুযোগ-সুবিধাই নেই। খুব দ্রুত তাম্রলিপ্ত বন্দরের বিকল্প হিসাবে ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে হিজলি বন্দরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া এবং ইউরোপে। চাল, কার্পাস ও পাটের কাপড় যা রেশমি বস্ত্রের মতো, তার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই বন্দর। নাগাপট্টাম, সুমাত্রা, মালাক্কা ও অন্যান্য স্থান থেকে জাহাজ আসত। তারা প্রচুর চাল, কার্পাস ও রেশমবস্ত্র ছাড়াও মাখন, লঙ্কা, চিনি ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে যেত। পর্তুগিজ ছাড়া ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজ বণিকরাও বাণিজ্য করতে আসত এখানে। আস্তে আস্তে হিজলি প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যকেন্দ্র ও শ্রেষ্ঠ বন্দরের খ্যাতি অর্জন করে।

১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে হিজলির যুদ্ধ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মাত্র দুই শত সৈন্য নিয়ে জব চার্নক চাতুরি করে মোগল সেনাধ্যক্ষ আবদুস সামাদের ১২ হাজার সৈন্যের দলকে পরাজিত করেন। ভারতের মাটিতে, হিজলিতে ইংরেজ রাজত্বের গোড়াপত্তন হয় ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন। হিজলি তখন বিশাল দুর্গ সমন্বিত রাজধানী শহর। অতীতের গৌরবের সাক্ষী কিছু নেই, বর্তমানে মাথা তুলে আছে শুধু মসনদ-ই-আলা।

এই মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যরীতির এক অতি প্রাচীন নিদর্শন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই মসজিদের নির্মাণ শুরু হয় শাহজাহানের শাসনকালে আর শেষ হয় ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু এই মসজিদ নির্মাণ করলেন কে?
সে ইতিহাস জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই সুদূর অতীতে। এই অঞ্চলে হিজলি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন মোগল সুবেদারের অধীনস্থ ক্ষমতাশালী জমিদার মনসুর ভুঁইঞার ছোটছেলে রহমত ভুঁইঞা। রহমত বড়ভাই জামালের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে এখানে পালিয়ে আসেন এবং হিন্দু কর্মচারীদের নিয়ে রাজ্যপাট চালাতে থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র দাউদ খাঁ অল্প দিন রাজত্ব করে মারা যান। তাঁর পুত্র তাজ খাঁ স্বীয় প্রতিভাবলে হিজলি রাজ্যকে সুশাসিত করেন। হিন্দু ও মুসলমানদের নিকট তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি উপাধি নেন মসনদ-ই-আলা। অর্থ, যাঁর আসন উচ্চ। রাজকর্মচারীদের ষড়যন্ত্রে তাঁর প্রিয় ভাই সিকন্দরের মৃত্যু ঘটলে তাঁর মনে বৈরাগ্য জন্মায় এবং বর্তমান পটাশপুরের অমর্ষি নামক স্থানের ফকির হজরত মখদুম-শেখ-উল-মশারেখ-শাহ-আবদুল-হক উদ্দীন চিশতির কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নেন এবং ঈশ্বরের চিন্তায় বাকি জীবন কাটান। ঈশ্বরভজনার গুণে তিনি সকলের কাছে হয়ে ওঠেন ঈশ্বরের অবতার। তাঁর সাধনক্ষেত্র হিজলিতে গড়ে তোলেন বিরাট মসজিদ।

মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। পূর্ব দিকে তিনটি দরজা। তিনটি সুগোল প্রকাণ্ড গম্বুজ ও মিনার দ্বারা ছাদটি নির্মিত। অতীতে সুউচ্চ মিনারগুলি সাগর থেকে মোহনায় প্রবেশকালে বা বঙ্গোপসাগরের যাত্রাকালে নৌ-পোতগুলির বণিক, নাবিকদের পথ দেখানোয় সাহায্য করত।
মসজিদের মাঝের দরজার খিলানের একটু ওপরে দেওয়ালের গায়ে আরবি অক্ষরের প্রস্তরলিপি রয়েছে। মসজিদের সামনে তাজ খাঁয়ের সমাধি মঞ্চ বা মাজার। লোকে বলে বাবাসাহেবের মাজার। চলতি কথায়, মসনদ-ই-আলার স্থানীয় নাম ‘বাবাসাহেবের কোর্টগড়া’।

মাজারের সামনে রয়েছে একটি বড় কুয়ো। কথিত আছে, তাজ খাঁ সুদূর মক্কা থেকে পবিত্র জল এনে এর মধ্যে রেখেছিলেন। মসজিদের পাশে একটি প্রাচীন গুলঞ্চ গাছের পাশে রয়েছে তাজ খাঁয়ের ছোটভাই সিকন্দরের লোহার লাঠি। এটিকে ‘আশাবাড়ি’ বলে ডাকা হয়। জনশ্রুতি, কোনও কামনা নিয়ে এক বারের চেষ্টায় এই আশাবাড়িকে মাটি থেকে ওঠাতে পারলেই তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। বছর দশেক হল মসজিদটি সংস্কার হয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
খেজুরি থানার হিজলিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে মসনদ-ই-আলা সমান শ্রদ্ধাভাজন। এ অঞ্চলের লোকেরা মানত করে, ইচ্ছাপূরণ হলে পূজা দেয়, শিরনি চড়ায়। শিরনি তৈরি হয় চালের গুঁড়ো, ময়দা এবং চিনি দিয়ে।
প্রতিবছর চৈত্র মাসের প্রথম শনিবার সারারাত ধরে মেলা বসে সন্ধে থেকে। পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি থেকে হাজার হাজার মুসলমান জলপথে ও স্থলপথে আসেন এখানে। কেবল মুসলমানরাই নন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষের ঢল নামে মেলায়। পশ্চিমবঙ্গে এরকম সম্প্রীতির মেলা কমই আছে।
ঝাউয়ের জঙ্গল, রসুলপুরের বিস্তীর্ণ মোহনা, পিছনের বালিয়াড়ি মসনদ-ই-আলাকে এক সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।

খেজুরি

আঠারো শতকের প্রথম দিকে খেজুরি জাহাজ নোঙরের উপযুক্ত স্থান বিবেচিত হওয়ায় বন্দর হিসাবে খেজুরির খ্যাতি বাড়তে থাকে। ফলে সেখানে নাবিক ও যাত্রীদের জন্য হোটেল, ডাকঘর, দোকান ও ঘরবাড়ি তৈরি হওয়ায় খেজুরি একটি শহরের রূপ নেয়। উল্লেখ্য, রাজা রামমোহন রায় এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এখান থেকে বিদেশ যাত্রা করেছিলেন। এখান থেকে সংবাদ দ্রুত কলকাতায় পাঠাতে সিমাফোর-টেলিগ্রাফের জন্য কলকাতা-খেজুরি পথে সুউচ্চ ইটের স্তম্ভ বানানো হয়। বিদেশি নাবিক ও যাত্রীদের চিঠিপত্র আদানপ্রদানের জন্য এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাক বিভাগ চালু করে। এটি ভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ডাকঘর।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে এখানে একটি স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে ওঠে। বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় ইংরেজ নাগরিকরা এখানে আসতে শুরু করে। যাদের মৃত্যু এখানে হয়েছিল তাদের জন্য একটি সমাধিক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। ক্ষেত্রটির মধ্যে তেত্রিশটি সমাধি আছে। তার মধ্যে একুশটিতে মার্বেল পাথরের নানাবিধ ভাষ্যে লেখা। মার্বেল পাথরগুলি থেকে কিছু জানার উপায় আজ আর নেই কারণ একুশটি পাথর অপহৃত।

পর্তুগিজরা সেই সময় দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল থেকে কাজুবাদামের বীজ এনে গোয়ায় প্রথমে চাষ আরম্ভ করেছিল, তারপর গোয়া থেকে বীজ এনে হিজলির সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে চাষ শুরু করে যা হিজলি বাদাম নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বাদামের চাষ হচ্ছে যার পরিমাণ খোসা সমেত প্রায় ১১ হাজার টন। আর খেজুরিতে ইউরোপীয়রা আফ্রিকা থেকে এনেছিল ‘বাওবাব’ গাছ, সুবিশাল এই গাছ ধ্বংসপ্রাপ্ত। আনন্দের কথা, ‘খেজুরি ইতিহাস সংরক্ষণ পর্ষদ’ একটি বাওবাব গাছ আনিয়ে সেটি রোপণ করেছে। বর্তমানে খেজুরিতে গেলে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দেখা যাবে হিজলি নগরী, খেজুরি বন্দরের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন, ভারতের প্রথম প্রাচীন ডাকঘর, টেলিগ্রাফ অফিস, সাহেবদের কবরস্থান, সিগন্যাল দেবার মঞ্চ, সিমাফোর টাওয়ার, নীল কারখানার ভগ্নাবশেষ প্রভৃতি। খণ্ডহরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ইতিহাসের কত পুরনো কথা ভিড় করে আসবে। খেজুরির কাছে কাউখালিতে গেলে দেখা যাবে ১০০ ফুটের একটি পরিত্যক্ত আলোকস্তম্ভ যা ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর হুগলি নদীর ধারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে নদীর ধারের রাস্তা ধরে বহুদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। জলরাশি আর বনানীর মাঝে এমন প্রাকৃতিক দৃশ্যের মনকাড়া অনুভূতি এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। খেজুরির পূর্ব প্রান্তে সৎসঙ্গ আশ্রমটিও দ্রষ্টব্য। এর পরিবেশটিও সুন্দর। ১লা ফাল্গুন বাৎসরিক উৎসবে ভক্তবৃন্দের সমাগমে আশ্রম মুখরিত হয়ে ওঠে। খেজুরি থেকে হিজলি পর্যন্ত নদীর তীর বরাবর ৫ কিলোমিটার পথে শীতকালে ভ্রমণকারী ও বনভোজনের দলের মেলা বসে যায়।

কলকাতা ও হাওড়া থেকে সরাসরি বাস যাচ্ছে বোগা, দূরত্ব ১৬৫ কিলোমিটার। মেচেদা থেকে বাসে নন্দকুমার হেঁড়িয়া-বিদ্যাপীঠ হয়ে বোগা আসা যায়। বোগা থেকে বিদ্যাপীঠ হয়ে খেজুরি ৪ কিলোমিটার। কাঁথি থেকে বাসে রসুলপুর হয়ে নদী পেরোলেই বোগা। আবার দরিয়াপুরের পেটুয়াঘাট পেরিয়েই মসনদ-ই-আলা, সেখান থেকেও খেজুরি আসা যায়। এইসব রাস্তায় বাস থেকে নেমে রিকশা, ইঞ্জিন-ভ্যান পাওয়া যায়।

এত সুন্দর জায়গায় কিন্তু থাকার কোনও সুব্যবস্থা নেই। মসনদ-ই-আলার কাছে ব্যবস্থা আছে, তবে তা খুবই সামান্য। কাঁথি অথবা দীঘাতে রাত্রিবাস করে এগুলি ঘুরে নেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। খেজুরির এই অঞ্চল কিন্তু একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। নদী এখানে ২০ কিলোমিটার চওড়া, নদীর ওপারে গঙ্গাসাগর দ্বীপ, খেজুরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম, ইতিহাসের জমজমাট আসর এখানে, সামনেই নদীর রসুলপুর মিলনস্থল, তার এপারে মসনদ-ই-আলার মতো ধর্মক্ষেত্র, ওপারে দরিয়াপুর কপালকুণ্ডলার স্মৃতিবিজড়িত, লাইট হাউসের ওপরে উঠে নৈসর্গিক শোভা– সব মিলিয়ে খেজুরিতে যদি থাকার সুব্যবস্থা হয় তাহলে ভবিষ্যতে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হবে এটি। পর্যটন দপ্তরেরও ভেবে দেখা দরকার এ নিয়ে। খেজুরি দেখার পর বাসে হেঁড়িয়া গিয়ে খারড়ের দিকে যাওয়া যেতে পারে। কাঁথিতে রাত্রিবাস করে জায়গাগুলি দেখে নেওয়া সুবিধার হবে।

কাছেপিঠে আরও নানা জায়গায় বেরিয়ে পড়তে ক্লিক করুন নীচের লাইনে।

পায়ে পায়ে বাংলা

You might also like