Latest News

খোসবাগ ও তার আশপাশে

রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য

যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, যাঁরা দেখতে চান বাংলার মুখ, তাঁদের কথা মনে রেখেই এই ধারাবাহিক। খুঁজে নিন আপনার পছন্দের জায়গা, গুছিয়ে ফেলুন ব্যাগ, হুস করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষে। আপনার সঙ্গে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে বাংলা’।

নবাবি মুর্শিদাবাদের কিছু নিদর্শন রয়ে গেছে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরেও। প্রচারের অভাবে স্থানগুলি অবহেলিতই রয়ে গেছে। স্থানগুলি হল যথাক্রমে খোসবাগ, ফারহাবাগ, রোশনিবাগ ইত্যাদি।

খোসবাগ

লালবাগ থেকে সদর খেয়াঘাট পার হয়ে দক্ষিণ দিকে দুই কিলোমিটার মতো গেলেই পাওয়া যাবে খোসবাগ। আলিবর্দী খাঁ জীবিত অবস্থাতেই নিজের সমাধির জন্য এই উদ্যানটি তৈরি করান। স্থানটি উঁচু প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। খোসবাগ অর্থাৎ আনন্দ উদ্যান। খোসবাগ শব্দটি এসেছে খুসবুবাগ থেকে। কারণ সমাধিস্থলটি আগে সুগন্ধী ফুলের গাছ দিয়ে সজ্জিত ছিল। নামটি সার্থক। সবুজ লন ও ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা ৪০ একর জমির উদ্যানটি এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। আলিবর্দী খাঁ তাঁর মাকে সমাধিস্থ করার জন্য এই মনোরম উদ্যানটি বানান। আলিবর্দীর ইচ্ছানুসারে তাঁকেও এখানেই সমাহিত করা হয়।

একটি সুন্দর দ্বিতল তোরণদ্বার পেরিয়ে সমাধিক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হয়। খোসবাগে একটি সমাধিভবনে নবাব আলিবর্দী, সিরাজ, লুৎফা ও সিরাজের পরিবারবর্গের সমাধি রয়েছে। তাছাড়া দানশা ফকির নামে এক ফকিরের সমাধিও রয়েছে। পলাশির যুদ্ধে হেরে গিয়ে সিরাজ যখন সপরিবারে পালিয়ে যান তখন এই দানশা ফকিরই তাঁকে চিনতে পেরে ধরিয়ে দিয়েছিল।

আলিবর্দীর কবরটি সাদা ও কালো পাথরে তৈরি সুদৃশ্য কিন্তু সিরাজের কবরটি অতি সাধারণ। একদা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব এমনভাবে শায়িত আছেন যে দেখে মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। সিরাজের পাদদেশে তাঁর পত্নী লুৎফুন্নেসার সমাধি রয়েছে। সিরাজের সমাধির পাশে পূর্ব দিকে রয়েছে সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদির সমাধি। মিরণের নেতৃত্বে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া আরও কিছু সমাধি রয়েছে।

কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর সিরাজের বেগম লুৎফাকে ঢাকায় নির্বাসিত করা হয়। অনেকদিন পর তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে এলে খোসবাগের তত্ত্বাবধানের ভার তাঁকেই দেওয়া হয়। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন কন্যা উম্মৎ জাহুরাকে নিয়ে অতি যত্নের সঙ্গে খোসবাগের রক্ষণাবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁর মাসিক বৃত্তির ১ হাজার টাকা এবং ভাণ্ডারদহ ও নবাবগঞ্জের রাজস্বের ৩০৫ টাকার সমস্তই খোসবাগ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করতেন। তখন নানারকম ফুলগাছে বাগানটি ভরে থাকত। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে লুৎফার মৃত্যুর পর সিরাজের দক্ষিণপদতলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। বস্তুতপক্ষে সিরাজউদৌল্লার পরাজয়ের পর তাঁর পরিবারের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল সেই নৃশংসতার কথা জানলে মন ভার হয়ে আসে। এত বড় উদ্যানে দাঁড়িয়ে নতশিরে কেবল ইতিহাসকে স্মরণ করতে হয়।

ডাহাপাড়া ধাম

খোসবাগ থেকে কাছেই ডাহাপাড়া ধাম। ডাহাপাড়ার মুখ্য আকর্ষণ হল জগদ্বন্ধু ধাম মন্দির। যদি রেলপথে আসা যায় তাহলে ডাহাপাড়া হল্ট স্টেশনে নেমে গ্রামীণ পরিবেশে কয়েক পা হাঁটলেই এই মন্দিরে পৌঁছনো যাবে। মন্দিরটি অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। দুধসাদা মন্দিরের বিশেষত্ব হল এত বড় আর এত উঁচু মন্দির কেবল মুর্শিদাবাদ জেলা কেন, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আর নেই। সুপরিকল্পিতভাবে নানারকমের রঙিন ফুল, বাহারি গাছ, ফলের গাছ দিয়ে মন্দিরটি সাজানো। দেখলেই বোঝা যায় যে এটা বৈষ্ণবদের মন্দির। মন্দিরটির একদম ওপরে সিমেন্টের তৈরি শাঁখ, খোল, করতাল দিয়ে সাজানো রয়েছে। মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে আশ্রম।

এবার মন্দিরের স্রষ্টা সম্বন্ধে আলোকপাত করা যাক। জগদ্বন্ধু সুন্দর ছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের অধিবাসী। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। তিনি ডাহাপাড়ায় এসে একটি কুঁড়েঘর বানিয়ে সাধন-ভজন শুরু করেন। শীঘ্রই ভক্তদের আনাগোনা বাড়তে থাকে এবং তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে আশ্রম। তাঁদের আর্থিক সাহায্যে গড়ে ওঠে এই বিশাল মন্দির। আয়তন ১৮০ বর্গ মিটার আর উচ্চতা ৩৪ মিটার। নির্মাণ শুরু হয় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে, শেষ হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকা প্রবাসী বাস্তুকার সুহাস চৌধুরীর পরিকল্পনা অনুসারে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়। পুরো সাদা মার্বেলে তৈরি মন্দির। অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে খোলামেলা বিশাল নাটমন্দির। সেখানে নাম সংকীর্তন হয়। তার পরে গর্ভগৃহ বা মূল মন্দির। ভেতরে প্রভু জগদ্বন্ধুর মূর্তি স্থাপিত আছে। এই মন্দিরটিকে ভক্তরা বড় ধাম বলেন। কিছু দূরে রয়েছে ছোট ধাম যেখানে মস্তক মুণ্ডন হয়। থাকার জন্য আশ্রমে অনেক ঘর আছে। পেছনের বাগানে সাধুদের সমাধিমন্দির রয়েছে। বাগানের সবুজ সজীব চালতা গাছগুলি নজর কেড়ে নেয়। প্রচুর চালতা ফলে গাছগুলিতে। প্রভু জগদ্বন্ধু নাকি চালতা গাছগুলিকে যোগমায়ারূপে সাধনা করতেন। ভক্তরা এই গাছগুলিকে ভক্তি করেন ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের আশায়। দুপুরে ভোগের ব্যবস্থা আছে। প্রচুর ভক্ত প্রতিদিন ভোগপ্রসাদ পান।

প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীশ্রীজগদ্বন্ধু সুন্দরের আবির্ভাব উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী উৎসব হয়। ভক্তজনের সমাবেশ ঘটে ডাহাপাড়ায়।

ভট্টবাটি

সদরঘাট পার হয়ে লালবাগ-নবগ্রাম পাকা সড়কে কিছুটা গিয়ে পশ্চিমে ভট্টবাটি গ্রাম। জনশ্রুতি যে, মুর্শিদকুলির আমলে এখানে বারোশো ঘর কর্ণাটকী ভট্ট ব্রাহ্মণ থাকতেন। বর্তমানে অবশ্য তাঁদের কেউ বাস করেন না। তবে ভট্টদের থেকেই গ্রামটির নাম ভট্টবাটি বা ভট্টমাটি। কাল সব কিছু গ্রাস করে নিলেও এখনও টিকে আছে পঞ্চরত্ন রত্নেশ্বর মন্দির। মন্দিরে অবস্থান করছেন রত্নেশ্বর শিব। দেবতা নিত্য পূজা পান। দক্ষিণদুয়ারী মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় আট মিটার। চার কোণে চারটি চূড়া ও মূল চূড়াটি গঠনবৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। মন্দিরের প্রবেশদ্বার কার্নিশযুক্ত। চারদিকে গাছপালায় ছাওয়া এক শান্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশে হঠাৎ করে মন্দিরটি চোখে পড়লে ভাল লাগার আবেশ সৃষ্টি হয়। মনে হয় যেন কোনও গৃহস্থের গৃহদেবতার মন্দির।

অত্যন্ত উঁচুদরের পোড়ামাটির অলংকরণে অলংকৃত মন্দিরটি। মন্দিরের সারা গায়ে ও চূড়ায় বিচিত্র ঘটনাসমৃদ্ধ পোড়ামাটির অপূর্ব শৈলী, সামনের খিলানে সামাজিক দৃশ্য এবং মন্দিরগাত্রের ছোট ছোট কুলুঙ্গির মধ্যে দেবদেবীগণ বিরাজিত। পোড়ামাটির কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মৎস্যকন্যা, পাতাল ভৈরবী, রাসমণ্ডল, মা দুর্গার মূর্তি ইত্যাদি। সম্প্রতি মন্দিরটি সংস্কার হয়েছে। মন্দিরের কাছে কালীসাগর নামে বড় দিঘি আছে।

কাছেপিঠে আরও নানা জায়গায় বেরিয়ে পড়তে ক্লিক করুন নীচের লাইনে।

পায়ে পায়ে বাংলা

You might also like