
অল্প চেনা বেলিয়াবেড়া
রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য
যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, যাঁরা দেখতে চান বাংলার মুখ, তাঁদের কথা মনে রেখেই এই ধারাবাহিক ‘পায়ে পায়ে বাংলা’। খুঁজে নিন আপনার পছন্দের জায়গা, গুছিয়ে ফেলুন ব্যাগ, হুস করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষে। আপনার সঙ্গে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে বাংলা’।
ঝাড়গ্রাম থেকে লোধাশুলি খারবান্ধি, গোয়ালমারা, মহাপাল, জাহানপুর হয়ে বেলিয়াবেড়া পৌঁছনো যায়। বেলেবেড়্যা রাজবাড়ি নির্মাণের পেছনেও রয়েছে এক গল্প। কেবল রাজবাড়ি নয়, পাচক থেকে রাজা হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক মজাদার কাহিনি।
ঝাড়গ্রাম রাজার খাস পাচক ছিলেন উৎকলবাসী। নাম তাঁর নিমাইচাঁদ দাস মহাপাত্র। একদিন রাজা খেতে বসে শাক ভাজা খেয়ে তৃপ্ত হয়ে নিমাইচাঁদকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী শাক ভাজা করেছে? ভয়ে ভয়ে নিমাইচাঁদ উত্তর দিলেন যে, তিনি দূর্বাঘাস ভেজেছেন। এ কথা শুনে রাজা যেমন বিস্মিত হলেন তেমন মুগ্ধও হলেন তাঁর পাচকের কৃতিত্বে। তিনি তাঁকে বললেন, অশ্বশালার সবচেয়ে তেজী একটি ঘোড়া নিয়ে রাত্রি এক প্রহরের মধ্যে নিমাইচাঁদ যতটা ঘুরে আসবেন ততটা রাজ্য তিনি তাঁকে দেবেন। নিমাইচাঁদ ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। নদী, নালা, খাল-বিল পেরিয়ে ছুটে চললেন তিনি।
তারপর নিমাইচাঁদ রাজা হলেন আর এক প্রহরের মধ্যে রাজা হলেন বলে তাঁর পদবি বদলে গিয়ে নতুন পদবি হল প্রহরাজ। তিনি ডুলুং নদীর ধারে রাজবাড়ি নির্মাণ করলেন। পরবর্তীকালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ তৈরি করলেন রাজপ্রাসাদ। বর্তমানে রয়েছেন ২৪তম পুরুষ।
রাজবাড়ির প্রবেশপথের দরজায় প্রতিষ্ঠালিপি রয়েছে। মাথার ওপর রয়েছে ঘড়ি। মাঝখানে গণেশের মূর্তি। খুব সুন্দর কারুকাজ করা। রাজবাড়ির অন্দরে রয়েছে গাছগাছালি। ভেতর দিকে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। মাঝে রয়েছে দুর্গাদালান।
মহাশ্মশান : ডুলুং নদীর তীরে রয়েছে ব্যাঘ্রেশ্বর মহাশ্মশান। ব্যাঘ্রেশ্বর শিবের নামে শ্মশানের নাম। ব্যাঘ্রেশ্বর শিব বেলেবেড়্যা রাজাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। নদীর তীরে সুন্দর শিব মন্দির-সহ আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির। এক সাধু মহারাজের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সাধন কুটির নামে একটি ভজন কুটির রয়েছে, তিনি পাশেই প্রতিষ্ঠা করেছেন এক কালী মন্দির। গ্রামের মধ্যে এরকম সাজানো-গোছানো শ্মশানভূমি দেখতে দেখতে পাওয়া বিরল। পরিবেশটি চমৎকার। রাসপূর্ণিমাতে মেলা বসে, সাত দিন মেলা চলে।
জাহানপুর পির থান : বেলিয়াবেড়ার রাস্তায় মহাপালের কাছে ডান দিকে জাহানপুর পির থান। অদূরেই সুবর্ণরেখা বয়ে চলেছে। চারিদিকে গাছপালায় ছাওয়া জায়গাটি মনোরম। সুবর্ণরেখা রেখে গেছে মাজারে তার আঘাত চিহ্ন। তাই নতুন করে তৈরি হচ্ছে। এটি হিন্দু-মুসলমানের মিলনস্থলও বটে। মাজারটি সুফি দরবেশ সৈয়দ কাশিম রহমতুল্লা আলির। তার পাশেই আছে প্রথম খাদিম বাবার সমাধি। সৈয়দ কাশিম এই অঞ্চলে আসেন ধর্মপ্রচার করতে। এই অঞ্চল অধিকার করার জন্য স্থানীয় রাজার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে পাঠানদের। যুদ্ধে জয়লাভের জন্য রাজার দুই কন্যা দরবেশের নিকট বর প্রার্থনার জন্য আসেন। শত্রুপক্ষের পাঠান সেনাপতি দুই কন্যাকে বন্দি করে বিবাহের প্রস্তাব দেন। রাজকন্যারা পাঠান সেনাপতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বলেন যে, দরবেশ তাদের কুমারীত্ব হরণ করেছে। সেনাপতি দরবেশকে বন্দি করে আনার নির্দেশ দেন। বন্দি করে নিয়ে আসার পথে সুবর্ণরেখার তীরে জাহানপুরে দরবেশের মৃত্যু হয়। পরে দরবেশ নির্দোষ জানতে পেরে জাহানপুরে দরবেশের মাজার নির্মাণ করে দেন সেনাপতি। কাছাকাছি মস্তানপুকুর, ভেড়াভাঙা, সাতবাহিনীর ঘাট, নোনাটিলা, গন্ধকটিলা প্রভৃতি জায়গাগুলিতে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে। ১৪ ও ১৫ই ফাল্গুনে পিরের উরস উপলক্ষ্যে প্রচুর জনসমাগম হয় ও মেলা বসে। উচু-নিচু টিলা, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুবর্ণরেখার তীর সব মিলিয়ে এটি একটি দুর্দান্ত পিকনিক স্পটও বটে। দুর্গাহুড়ি দেখে গাড়িতে এ পথে আসা যায়।
শাঁকরাইল
রোহিণী : রোহিণী গ্রামের কোদোপালের নাম সংবাদপত্রের দৌলতে আজ আর অপরিচিত নয়। কোদোপালের এই এলাকাটি আসলে ডুলুং ও সুবর্ণরেখার মধ্যবর্তী চর। এখানে ৪০০ একর জমিতে শাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বহুমুখী জৈব কৃষিখামার। এলাকার সাতটি গ্রামের ২৫০টি আদিবাসী পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটেছে খামারে।
প্রশাসন ও স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে যে তথ্য উঠে আসে তা যেমন চমৎকার তেমনই কৌতূহলোদ্দীপক। ডুলুং ও সুবর্ণরেখার মধ্যবর্তী এই চরটি প্রায় একশো বছর আগে পলি জমে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল। ঘন ঝোপঝাড়ে ভর্তি এলাকাটি ছিল শ্বাপদসংকুল। ২০১২ সালে এই এলাকাটিতে বিবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব পাঠান শাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায়। এরপর একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে জমি সমতল করা হয়। বহুমুখী ওই খামারে নানা ধরনের উন্নত প্রজাতির চার হাজার ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। আম, সফেদা, কুল, পাতিলেবু, গন্ধরাজ লেবু, মৌসম্বি, লিচু প্রভৃতি গাছে রয়েছে শাওয়ার ইরিগেশনের ব্যবস্থা। খুবই আনন্দের বিষয় যে, ২০১৫ সালের গ্রীষ্মে ১৩ লক্ষ তরমুজের ফলন হয়েছিল যা কলকাতার বাজারকে মাতিয়ে দিয়েছিল ‘কোদোপাল তরমুজ’ নামে। এর পাশাপাশি ডুয়েল পারপাস-এ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ হচ্ছে। বন দপ্তরের উদ্যোগে কোদোপালের ৫০ হেক্টর সরকারি জমিতে সেগুন, শিশু, মহুল, ঝাউয়ের মতো গাছ লাগানো শুরু হয়েছে।
কেবল কৃষিখামার নয়, এটিকে ঘিরে যে ইকনমিক জোন তৈরি হয়েছে তাতে এলাকার ধিতপুর, হরেকৃষ্ণপুর, কুস্তরিয়া, মাসাড় শালবনির মতো সাতটি গ্রামের ২৫০টি আদিবাসী পরিবার সারাবছর কাজ পাচ্ছে। এখানে প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র চালু হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরও বেশি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে আশা করা যায়। কোদোপালের জমিতে কোনওরকম রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করে কেবল জৈব সার প্রয়োগ করা হচ্ছে।
চারিদিক ফাঁকা, সবুজে সবুজ এই গ্রামেরই বিপরীত দিকে সুবর্ণরেখার ওপারে দেউলবাড় গ্রামের (নয়াগ্রাম) রামেশ্বরনাথের দেউলের উঁচু শিখরটি দেখতে পাওয়া যায়।
রোহিণী গ্রামটি আরও একটি কারণে বিখ্যাত। সুবর্ণরেখা তীরবর্তী এই স্থান বৈষ্ণবাচার্য শ্যামানন্দ প্রভুর শিষ্য রসিকানন্দের জন্মস্থান রূপে সুপরিচিত। তবে গ্রামে একটি ক্ষুদ্রাকৃতি প্রস্তরফলক ছাড়া রসিকানন্দের স্মৃতিরক্ষার আর কোনও ব্যবস্থা নেই।
এখানে আসতে গেলে খড়গপুর থেকে প্রথমে কেশিয়াড়ি রাস্তায় পড়ে কেশিয়াড়ি থেকে একটি পাকারাস্তায় কুলটিকরি হয়ে পৌঁছনো যায়। এছাড়া ঝাড়গ্রাম থেকে বাসেও এ পথে আসা যায়।
লাউদহ : নামটি যেমন সুন্দর, জায়গাটিও তেমন সুন্দর। লাউদহের সুনাম বিশেষত পিকনিক স্পটের জন্য। আর হবে নাই-বা কেন? মিষ্টি ডুলুং এসে মিলেছে সুবর্ণরেখাতে। যে দিকে চোখ যায় কেবল বালির রাশি। বুনো হাঁস, নদীর চরে আখ, অড়দহ খেতে ফিঙে, বুলবুলির নাচানাচি, অস্তগামী সূর্য। সব মিলিয়ে এক মনোরম সৌন্দর্যয়ের ক্যানভাস। ঝাড়গ্রাম থেকে ভায়া গুপ্তমণি ৭০ কিলোমিটার দূরে লাউদহ। আর রোহিণী থেকে খুবই কাছে।
দুর্গাহুড়ি ইকো পার্ক : গুপ্তমণি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে পিচরাস্তার ধারে পুরোদস্তুর শাল জঙ্গলের আটঘাটে এক মনোরম পরিবেশে দুর্গাহুড়ি পর্যটন কেন্দ্র। জঙ্গলের ভেতরে রয়েছে ছোট একটি লেক। বনবিভাগ লেকের ধারে ধারে পিকনিক করার জন্য বা বসার জন্য শেড করে দিয়েছে। জায়গাটি কেবল বনভোজনেরই নয়। এখানে এলে আকাশভরা সূর্যতারার বিস্ময় তো আছেই, আছে ধরার বুকে কান পেতে, প্রকৃতির মুখে চোখ রেখে অফুরান বাতাস গায়ে মাখার সুখ। বনজ গন্ধে বুঁদ হতে গেলে ২৫ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি বাদ দিয়ে আসতে হবে। কারণ, শীতের ওই বিশেষ বিশেষ দিনগুলোয় কয়েক হাজার লোকের সমাগমে ও মাইকের তাণ্ডবে গাছগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বনভোজনের সমস্ত উপকরণ পাওয়া যায় কুলটিকরি ও কেশিয়াপাতা বাজার থেকে। দুর্গাহুড়ির সঙ্গে একাত্ম হতে চাইলে বনভোজনের দিনগুলোকে এড়িয়ে এলেই হবে।
পাথরকাটি/পিতলকাটি : শাঁকরাইল থানার অন্তর্গত এই গ্রামটি গুপ্তমণি থেকে শাঁকরাইল রাস্তায় বখড়া চক থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামটি পাথরকাটি বা পিতলকাটি নামে পরিচিত। এ গ্রামে দেবী জয়চণ্ডীর পাথরের দালান রীতির মন্দিরটি এক বিশেষ পুরাকীর্তির নিদর্শন। ইনি বেলেবেড়্যা রাজবাড়ির দেবী। বিস্তীর্ণ খোলা মাঠের এককোণে মন্দির। মূর্তিটি পাথরের। জয়চণ্ডী দেবী হাতির ওপর উপবিষ্ট। অতীতের পাথরের মন্দিরটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ইটের মন্দির নির্মিত হয়েছে। জনশ্রুতি, দেবী এত জাগ্রত যে, প্রতি মঙ্গল ও শনিবারে মানতের বলি পড়ে। মানসিক হিসেবে মাটির ঘোড়া দিয়ে পুজো দেবার রীতি আছে। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে মন্দির সংলগ্ন প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির ওপর একদিনের জন্য একটি মেলা বসে এবং এটি শতাধিক বৎসরের প্রাচীন মেলা।
ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস করে দেখে নেওয়া সুবিধার হবে।
রাত্রিবাসের ঠিকানা : অরণ্যসুন্দরী গেস্ট হাউস, সাব জেলের কাছে, দূরভাষ : ০৩২২১ ২৫৬৮৭২, ৯৫৪৭৬৬৮৯৬৬।
কাছেপিঠে আরও নানা জায়গায় বেরিয়ে পড়তে ক্লিক করুন নীচের লাইনে।