চৈতালী চক্রবর্তী
হাশিখুশি, মজাদার মানুষ হিসেবে কৌশিকবাবুকে চিনতেন পাড়ার লোকজন। আপদে বিপদে তাঁকে একবার ডাক দিলেই ছুটে যেতেন। ইদানীং মানুষটার মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা গেছে। কিছুই মনে রাখতে পারেন না (Dementia)। বয়স ৭৫ পেরিয়েছে। বাড়ির লোক মজা করে বলতেন, ভুলো মন হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল, চেনা মুখগুলোকেই আর চিনে উঠতে পারছেন না তিনি। নিজের স্ত্রী, সন্তানদেরও অপরিচিত ভাবলেন একদিন, ভুলে গেলেন নিজের নামটাও। নিজের পরিচয়টাও এখন তাঁর কাছে ধোঁয়াশার মতো।
এই ভুলো-রোগ কিন্তু হাসিমজার ব্যাপার নয়। ভীষণ ভয়ঙ্কর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর এক অসুখ, যা নিজের অস্তিত্বকেও ভুলিয়ে দিতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগকে বলা হয় ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিনাশ। অ্যালঝাইমার্সও ডিমেনশিয়ারই একটা ভাগ। স্মৃতির পাতা খালি হতে থাকে ধীরে ধীরে। ডিমেনশিয়া নিয়ে সচেতনতার প্রচার হচ্ছে চারদিকেই, তবে কেরল সেখানে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ডিমেনশিয়া রোগীদের চিহ্নিত করা, তাঁদের দেখাশোনা, সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে সুপরিকল্পিত গাইডলাইন তৈরি করেছে কেরল সরকার। এই প্রকল্পের নাম ‘উদ্বোধ’। কোচিতে এই গাইডলাইন মেনে ডিমেনশিয়া রোগীদের ট্রিটমেন্টও শুরু হয়ে গেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এখনই কোচিকে ‘ডিমেনশিয়া-ফ্রেন্ডলি’ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
[caption id="attachment_2381657" align="alignleft" width="258"]
ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী[/caption]
কোচিতে সরকারি উদ্যোগে যে প্রকল্প শুরু হয়েছে তা এখনও আমাদের রাজ্যে সেভাবে শুরু হয়নি। কলকাতায় অনেক সংস্থা ডিমেনশিয়া রোগীদের নিয়ে কাজ করে। এ শহরে ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য কী ব্যবস্থা আছে, কলকাতাকেও ডিমেনশিয়া-ফ্রেন্ডলি হতে গেলে কী কী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত, কীভাবে এই রোগীদের দেখাশোনা, চিকিৎসা করা দরকার ইত্যাদি নিয়ে দ্য ওয়ালকে বিস্তারিত বললেন বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী। প্রবীণদের নানা সমস্যা, অসুখবিসুখ, তার চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘বাঁচবো’। ডাক্তারবাবু জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার (পশ্চিমবঙ্গ শাখা) সহ-সম্পাদক, প্রোটেক্ট দ্য ওয়ারিয়র্স ও পিডিপিডব্লুএসকে-র উপদেষ্টা।
বয়সকালে ভুলে যাওয়া আর ডিমেনশিয়া গুলিয়ে ফেলবেন না
ডাক্তারবাবু বলছেন, ডিমেনশিয়া রোগীকে আগে চিহ্নিত করা দরকার। রোগের শণাক্তকরণ সঠিকভাবে হলে তবেই তার কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা শুরু করা যায়। বয়সকালে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আর ডিমেনশিয়া এক নয়। অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। তাই স্মৃতিনাশ হচ্ছে সেটা ধরতেই অনেক সময় পেরিয়ে যায়। রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়।

ডিমেনশিয়া হল মস্তিষ্কের এমন এক জটিল রোগ যেখানে স্মৃতির বাক্সটাই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্কে সব কাজের জন্যই আলাদা আলাদা কুঠুরি থাকে। স্মৃতি ধরে রাখার বাক্সও থাকে--একে বলে হিপ্পোক্যাম্পাস। এই এলাকা স্মৃতি তৈরি করে, স্মৃতি সঞ্চয় করে, আবেগ-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে দু’টি হিপ্পোক্যাম্পাস থাকে। স্মৃতিকে বেঁধে রাখার কাজটি করে মাথার এই অংশটিই। আর ‘এনটোরিনাল কর্টেক্স’ নামে আর একটি অংশ হিপ্পোক্যাম্পাসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই এলাকা স্মৃতির জাল তৈরি করে। মস্তিষ্কের স্নায়ুর মাধ্যমে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। এই নেটওয়ার্ক মারফৎ সিগন্যাল বা সঙ্কেত বাহিত হয়ে আসে।
মস্তিষ্ক ঠিক করে কোন ঘটনাকে সঞ্চয় করে রাখা হবে আর কোন ঘটনা মস্তিষ্কে ক্ষণস্থায়ী হবে। স্মৃতির এই বাক্স যখন নানা কারণে অকেজো হয়ে যায়, তখন মানুষ আর কিছু মনে রাখতে পারে না।
শুরুটা হয় রোজকার জীবনের কাজের মধ্যে দিয়ে, শেষে নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা, আত্মীয়-পরিজন সকলকেই ভুলে যেতে শুরু করে রোগী। আগে মনে করা হত ডিমেনশিয়া বুঝি বার্ধক্যেরই রোগ। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, স্মৃতিনাশ যে কোনও বয়সেই হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে বা অন্য কোনও জটিল রোগ থাকলে প্রথমে ডিমেনশিয়া ও তার থেকে পরবর্তীকালে অ্যালঝাইমার্সের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। বুদ্ধিমত্তা বা ‘কগনিটিভ ফাংশন’-এর উপর প্রভাব পড়ে, যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কোচিতে ডিমেনশিয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রকল্প হয়েছে, কলকাতায় খামতি কোথায়?
কোচিতে ‘উদ্বোধ’ প্রকল্প সরকারি উদ্যোগে শুরু হয়েছে। কলকাতায় তেমন কোনও প্রকল্প বা সরকারি পরিকল্পনা এখনও নেই। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের উদ্যোগে ডিমেনশিয়া রোগীদের নিয়ে কাজ করে। অর্থাৎ কোনও সুপরিকল্পিত রূপরেখা নেই, বিক্ষিপ্তভাবে কাজ হচ্ছে। সঠিক গাইডলাইন না থাকার কারণে রোগীদের চিহ্নিত করাও সম্ভব হয় না অনেক সময়। ডাক্তারবাবু বলছেন, বেশিরভাগ ডিমেনশিয়ার রোগীর জানেনই না তাঁরা রোগে ভুগছেন, এমনকি তাঁদের পরিবারের লোকজনও এ ব্যাপারে অবগত নন। তাই রোগের চিকিৎসাও হচ্ছে না।

কলকাতায় এআরডিএসআই (অ্যালঝাইমার্স অ্যান্ড রিলেটেড ডিসঅর্ডারস সোসাইটি অব ইন্ডিয়া) ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্সের রোগীদের নিয়ে কাজ করে। তাদের ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। সেখানে রোগীদের একসঙ্গে করে নানারকম থেরাপি করা হয়। মিউজিক্যাল থেরাপি, মুভমেন্ট থেরাপি, ডান্স থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে রোগীদের অ্যাকটিভ রাখার চেষ্টা করা হয়। কলকাতায় ডিগনিটি ফাউন্ডেশনও সচেতনতা মূলক কাজ করে। ডাঃ ধীরেশ চৌধুরীর সংগঠন ‘বাঁচবো’ বয়স্কদের নিয়েই কাজ করে। প্রায় ৫০০ প্রবীণ এই সংগঠন থেকে উপকৃত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশই ডিমেনশিয়ার রোগী। তবে এই ধরনের সংস্থার সংখ্যা হাতে গোনা। সার্বিক স্তরে সরকারি উদ্যোগে কাজ সেভাবে শুরু হয়নি। ডিমেনশিয়া রোগীদের দেখাশোনা কীভাবে করতে হবে সে ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানই নেই অনেকের। খামতির জায়গাটা সেখানেই।
কলকাতাকে ‘ডিমেনশিয়া-ফ্রেন্ডলি’ হতে গেলে কী কী পরিকল্পনা এখনই করা দরকার
ডাক্তারবাবু বলছেন, কোচির মতো এ শহরকেও ডিমেনশিয়া-জয় করতে হলে একটা সার্বিক পরিকাঠামো দরকার। কয়েকটি বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে এবং অবশ্যই সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা দরকার। কোচিতে মূলত সচেতনতামূলক কাজই শুরু হয়েছে, কলকাতাতেও তা শুরু হওয়া দরকার।
কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—
১) রোগীদের শণাক্তকরণ-- আগে লক্ষণ দেখে রোগীদের চিহ্নিত করতে হবে। পরিবারের লোকজনই তা পারবেন। সবসময় নিউরোলজিস্ট দেখাতে হবে তা নয়, উপসর্গ বুঝলে স্থানীয় বা পারিবারিক ডাক্তারকে দেখাতে পারেন। তিনি রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে অন্য জায়গায় রেফার করবেন।
প্রথমত দেখতে হবে রোগী কী কী বিষয় ভুলতে শুরু করেছেন এবং কতদিন ধরে তা চলছে। সাধারণ দৈনন্দিন ব্যাপার যেমন ব্রাশ করা, স্নান করা, জামাকাপড় পরা ইত্যাদি ভুলতে থাকলে তখন সতর্ক হতে হবে।
স্থান, কাল, সময় ভুলতে বসেছেন কি না তা দেখতে হবে। হয়ত দেখলেন নিজের বাড়ির ঠিকানা ভুলে যাচ্ছেন রোগী, রাস্তা চিনতে পারছেন না। আজ কী দিন, কোন বার বা কোন সাল সবই ভুলে যাচ্ছেন।
মানুষজনের নাম ও মুখ ভুলে যাচ্ছেন। রোজ দেখা হয় যাঁদের সঙ্গে বা পরিবারের আপনজন, সকলকেই যদি ভুলতে বসেন তাহলে বুঝতে হবে বিপদ ঘনাচ্ছে। অনেক সময় রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে রোগী নিজের নামও ভুলে যান, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানকেও চিনতে পারেন না।
কথা সাজিয়ে বলতে সমস্যা হলে সতর্ক হতে হবে। অসংলগ্ন কথা, গুছিয়ে বাক্য বলতে না পারলে সতর্ক হতে হবে।
জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলতে শুরু করবেন। হাতে লিখতে পারবেন না কিছু।
মুড সুয়িং হতে থাকবে। আচার-আচরণ, ব্যবহারে বদল আসবে। রোগী সকলের থেকে আলাদা থাকতে পছন্দ করবেন। যে কোনও রকম সামাজিক অনুষ্ঠান, গল্প-আড্ডা এড়িয়ে চলবেন।
নিজে থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। নিজের শখ-আহ্লাদও ভুলে যাবেন।
২) আয়াদের সঠিক প্রশিক্ষণ—বয়স্ক লোকেদের দেখাশোনার জন্য আয়া রাখেন অনেকে। ২৪ ঘণ্টা যাঁদের নজরে থাকেন প্রবীণরা তাঁদের প্রশিক্ষণ আগে দরকার। কেরলে এই আয়া বা কেয়ারগিভারদের ট্রেনিং শুরু হয়েছে। ডাক্তারবাবু বলছেন, বয়স্কদের দেখভাল কীভাবে করতে হবে তার সঠিক জ্ঞান নেই অনেকেরই। তার ওপর ডিমেনশিয়া রোগীকে কীভাবে দেখভাল করতে হবে সেটা জানা জরুরি। রোগীর কী কী লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, কীভাবে তাঁকে অ্যাকটিভ রাখতে হবে তার জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। সেটা সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে করতে হবে। কারণ প্রশিক্ষণ পর্ব চলার সময় তাঁদের রোজগারের দিকটাও মাথায় রাখতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এই উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু তা সার্বিকভাবে সফল হয়নি। তাই সরকারের সহযোগিতা দরকার। স্পেশাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম করতে হবে যেখানে রোগীর পরিবারের লোকজনকেও প্রাথমিক প্রশিক্ষণটুকু দিতে হবে।
৩) কাউন্সেলিং দরকার—প্রবীণদের কাউন্সেলিং দরকার। তাঁদের নানা কাজে সক্রিয় রাখতে হবে। ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য বিভিন্ন রকম থেরাপি আছে। কোন রোগীর জন্য কী থেরাপি দরকার সেটা ডাক্তারকেও ভালভাবে বুঝতে হবে। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সেজন্য খুবই কার্যকরী।
৪) নিরাপত্তা দরকার, উদ্যোগ নিক থানা-লোকাল ক্লাব—অনেক ডিমেনশিয়া রোগী একা থাকেন, বা হয়ত বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী দু’জন, তাঁদের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়ার রোগী। এমন ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সবচেয়ে আগে দরকার। সে জন্য স্থানীয় থানাগুলির সক্রিয়তা খুব দরকার। শহরের প্রবীণ নাগরিকদের আপদে-বিপদে সাহায্য করার জন্য কলকাতা পুলিশ ‘প্রণাম’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছিল। তবে শহরের সমস্ত প্রবীণদের বা সব স্তরের রোগীদের সহযোগিতা করতে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় ক্লাবগুলোকেও হাত মেলাতে হবে। পুলিশের তত্ত্বাবধানে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবের সদস্যরা ডিমেনশিয়া রোগীদের চিহ্নিত করা তাঁদের দেখাশোনা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। তবে সরকারের আর্থিক অনুদানও দরকার।
পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকা 'সুখপাঠ'