কেয়া শেঠ
একটা কথা আজ না বললেই নয়। এই বিষয়টা আজ সারাদিন বড় তৃপ্ত করেছে আমায়। কাল বিশেষ প্রয়োজনে একটু বেরোতে হয়েছিল বাড়ির কাছেই। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, চিনতে পারছিলাম না জায়গাটা। নিজের বাড়ির আশপাশটাই যেন অচেনা ঠেকছে। এত পরিচ্ছন্ন, এত ফাঁক
একটা কথা আজ না বললেই নয়। এই বিষয়টা আজ সারাদিন বড় তৃপ্ত করেছে আমায়। কাল বিশেষ প্রয়োজনে একটু বেরোতে হয়েছিল বাড়ির কাছেই। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, চিনতে পারছিলাম না জায়গাটা। নিজের বাড়ির আশপাশটাই যেন অচেনা ঠেকছে। এত পরিচ্ছন্ন, এত ফাঁকা! সবসময় ঘিঞ্জি হয়ে থাকে যে পথঘাট, নোংরা পড়ে থাকে ইতিউতি, সে সব উধাও! যেন মনে হচ্ছে, অন্য কোনও শান্ত দেশে চলে এসেছি। দেশই বা বলি কেন। যে ঝকঝকে নীল আকাশ চোখে পড়ল, আমি শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারলাম না।
শুধু তাই নয়। আসল স্বস্তি পেয়েছি আর একটা দৃশ্য দেখে। এক জায়গায় কয়েক জন কথা বলছেন রাস্তায়। কিন্তু এত সুন্দর করে নিজেদের মধ্যে গ্যাপ মেনটেন করে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা! ঠিক যেন মেপে মেপে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। কথা বলে চলেও গেলেন। দেখেই বোঝা যায়, আড্ডা মারা বা জটলা করার উদ্দেশ্য তাঁদের নয়। অর্থাৎ মানুষ কিন্তু সচেতন হচ্ছেন। একেবারে সব কিছু অমান্য করে যে সবাই নিজের মতো চলছে, তা কিন্তু নয়। সে শাসনেই হোক বা সচেতনতাতেই হোক।
তাই আজ বলতে চাই, এই ২১টা দিন মেনে চললে হয়তো আগামী ২০২১ সালটা আরও সুন্দর, সুনীল হয়ে আসবে আমাদের কাছে। রোগমুক্ত হয়ে তো বটেই। মনে মনে আমিও হয়তো জানি, ২১ দিনটা বাড়তে পারে। কিন্তু আপাতত আমরা ২১-কেই পাখির চোখ করতে পারি। কে বলতে পারে, নতুন করে সেজে আরও ফ্রেশ হয়ে আসবে আগামী বছরটা! নতুন একটা পরিষ্কার, স্বচ্ছ পৃথিবী উপহার পাব আমরা, এই ক'দিনের বিনিময়ে। ২১ দিনের মধ্যে তো আট দিন চলেই গেল। আর ক'টা দিন পারব না আমরা?
আমাদের সকলের প্রিয়জন আছে। বাবা, মা, সন্তান, বন্ধু-- কেউ না কেউ আছে। আমরা এই ক'টা দিন তাদের জন্য দিই না হয়। নিজেদের একঘেয়েমি, বন্দিদশার যা যা অসুবিধা, সে সব কিছু আমরা মানিয়ে নিতে পারি প্রিয় মানুষের কথা ভেবে। আমাদের এটা বুঝতেই হবে, যে মহামারীর মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি, তা থেকে নিজেকে বাঁচানো যতটা কঠিন, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন নিজের থেকে আশপাশের মানুষদের বাঁচানো।
এই সময়টা না দিলে পৃথিবী হারিয়ে যাবে, আমরাই হারিয়ে যাব পৃথিবী থেকে। সেই হারানোর মুখ থেকে কিন্তু রিকভার করছে চারপাশটা। প্রায়ই শুনছি, হারিয়ে যাওয়া পাখিরা ফিরে এসেছে চারপাশে। জোনাকি ফিরে এসেছে। আমার নিজের ঘরে বড়বড় তিনটে গাছ আছে, যে গাছগুলো বাড়ি তৈরির সময়ে না কেটে রেখে দেওয়া হয়েছিল, এমনভাবে বাড়ি তৈরি হয়েছিল, যাতে গাছগুলো ভেতর দিয়ে বড় হয়ে ছাদে পৌঁছে যায়। সেই ছাদে এখন বিশাল ঝাঁকড়া এক আম গাছ, নিমগাছ আর কাঠগোলাপ গাছ আছে। যাদের শিকড় মাটিতে আর মাথা তিনতলা ছাদেরও ওপরে। সেই ছাদ-বাগানে কত পাখি দেখছি রোজ। বাসাও বেঁধেছে অনেক পাখি। আমার তো বেশ লাগছে এই সহাবস্থান।
সহাবস্থান বলতে মনে পড়ল, এই কথাটা যদিও আগেও বলেছি, বারবারই বলি, আমাদের আশপাশের না-মানুষদের নিয়ে চলতে হবে আমাদের। আমার অফিসে নিয়ম করা আছে, কাজ করলে একটা গাছ আর একটা মাছের দায়িত্ব নিতেই হবে। প্রতিটি কর্মীর টেবিলে ছোট বোলে মাছ থাকে। গাছও। লকডাউনের ঘোষণায় যখন হুড়মুড় করে অফিস বন্ধ করতে হল, প্রত্যেকে কিন্তু সেই মাছ আর গাছ সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। কেউ না এলে, তারটা অন্য কেউ নিয়ে গেছে। কারণ তাদের বাঁচাতে হবে। এটুকুই তো চাওয়া।
সবাই হয়তো গাছ না কেটে বাড়ি করা অ্যাফোর্ড করতে নাও পারতে পারে। কিন্তু অন্য গাছ ভালবেসে আপন করে নেওয়া-- এটুকু সবাই পারে। সবাই মাছ পুষবে, তার কোনও মানে নেই। কিন্তু রাস্তার কুকুরটাকে খেতে সবাই দিতে পারে।
এই পারাগুলোর শিক্ষা আমরা আরও ভাল করে গ্রহণ করি এই লকডাউন পিরিয়ডে। আমরা যেমন সময় দিচ্ছি নিজেদের, ভালবাসছি পরিবারের সদস্যদের, সারিয়ে তুলছি শারীরিক খুঁতগুলো, যত্ন করছি মনের, চর্চা করছি সুন্দর যাপনের, তেমনি না হয় সারানোর সময় দিচ্ছি প্রকৃতিকেও! আর নাহয় মনে মনে অঙ্গীকারও করছি, ২১ দিন পরে আমরা আরও বড় একটা মন নিয়ে ঘরের বাইরে পা রাখব, যে মনে প্রকৃতির জন্য পশুপাখির জন্য আলাদা একটু জায়গা থাকবে। যে মনটা সুন্দর পৃথিবীর আর্তিতে আরও একটু যত্ন করবে ফিরে পাওয়া প্রকৃতিকে।
আগামী সময় আমরা কেউ জানি না। কিন্তু আগামীকে সুন্দর করার জন্য এই সময়ে কী করা যায়, সেটা সবাই জানতে চেষ্টা করতে পারি। আমি আমার মতো বললাম। আপনারাও ভাবুন। প্রতিজ্ঞা করুন, এই ২১ দিনের বিনিময়ে একটা সুন্দরতর ২০২১ সালে পৌঁছব আমরা।