
ব্রোমান্স। ‘ব্রো’ (BRO) মানে ইংরাজিতে ব্রাদার বা ভাইকে বোঝায়। আর রোমান্স মানে তো সকলেরই জানা। তাহলে দুয়ে মিলে দাঁড়াল ব্রোমান্স। সহজ করে বললে, যে ভালবাসায় ভাইয়ের স্নেহ থাকে, বন্ধুত্বের উচ্ছ্বল আবেগ থাকে, একে অপরের ভাল-মন্দ ভাগ করে নেওয়ার অঙ্গীকারও থাকে। এই রোমান্সকে বাঁকা চোখে দেখলে কিন্তু চলবে না। ব্রোমান্স ‘গে-লাভ’ এর পর্যায়ে পড়ে না। মনোবিদরা বলছেন, যৌনতা ছাড়াই দুই পুরুষের নিটোল, নিশ্ছিদ্র বন্ধুত্বের সম্পর্কই ব্রোমান্স। এই সম্পর্ক শারীরিক তৃপ্তি খোঁজে না, মানসিক আরামের আশ্রয় নেয়।
এখন এই ব্রোমান্স নিয়ে আলোচনার একটা কারণ আছে। গবেষকরা বলছেন, আধুনিক সময় সম্পর্কে জটিলতা বাড়ছে। নারী-পুরুষের রোমান্সের চেয়ে ব্রোমান্সই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। ছেলেরা এখন সবসময় মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করার চেয়ে নিজেদের বন্ধু সার্কেলে জমাটি আড্ডা দিতেই বেশি পছন্দ করছে। তার মানে এই নয় যে প্রেমের সম্পর্ক একেবারে উঠে যাচ্ছে, প্রেমটাও থাকছে, সেই সঙ্গে বন্ধুত্বও আরও গাঢ় হচ্ছে। মনের গোপন যে কথাটা বান্ধবীকে বলাই যায় না, ফাঁস হলেই পুরো ফাঁসি যাওয়ার মতো অবস্থা হবে, সে কথাটা অনায়াসেই পুরুষ বন্ধুটির সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও একে অপরের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে ছেলেরা। রাগ, দুঃখ, অভিমান হলে বা মনে মেঘ জমলে, সে খবর সবচেয়ে আগে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটির সঙ্গেই ভাগ নেওয়া যায়। কারণ এখানে সম্পর্কের ছেদ হওয়ার প্রশ্ন নেই, নিজেকে ম্যাসকুলিন বলে জাহির করারও দরকার নেই। প্রেমিকার কাছে কনুই অবধি শার্টের হাতা গুটিয়ে যে ছেলেটি নিজেকে মাচো দেখানোর চেষ্টা করে, প্রাণের বন্ধুর কাছে হয়তো সেই দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে মন হাল্কা করে নেয়।
রোমান্স ভাল নাকি ব্রোমান্স—সেই তুল্যমূল্য আলোচনাতে যাচ্ছি না। নারী-পুরুষের চিরন্তন প্রেম আর দুই পুরুষ বা দুই নারীর মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে এই লেখা নয়। এখানে শুধু পুরুষ-পুরুষ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে শরীর সর্বস্ব ভালবাসা নেই। বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে তার অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেওয়াতেই আনন্দ। ‘মেন অ্যান্ড ম্যাসকুলিনিটিজ’ নামে জার্নালে এই ব্রোমান্স নিয়ে গবেষণার খবর ছেপেছেন বিজ্ঞানীরা। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব উইনচেস্টারের বিজ্ঞানীরা তো আস্ত একটা গবেষণাপত্রই লিখে ফেলেছেন ব্রোমান্স নিয়ে। সমকাম নেই এমন সম্পর্কে থাকা পুরুষদের নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও চালানো হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, বিবাহিত বা অবিবাহিত কিন্তু কোনও মহিলার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে রয়েছেন এমন পুরুষদের নিয়ে পরীক্ষাটা হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে ছেলেরা নিজেদের মধ্যে মানে পুরুষ বন্ধুদের সার্কেলেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তাঁরা একে বিছানায় শুচ্ছেন, একে অপরকে জড়িয়েও ধরছেন, কপালে হাল্কা চুম্বনে নিজেদের মনের কথা ভাগ করে নিচ্ছেন। এমন একটা নিখাদ বন্ধুত্ব যা নিয়ে বাঁকা প্রশ্ন তোলা যাবে না কিছুতেই।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে এমন নিখাদ বন্ধুত্ব তো অনেকেরই রয়েছে, তাহলে হঠাৎ করে ব্রোমান্স নামে শব্দের উৎপত্তি হল কীভাবে? ১৯৯০ সালে ‘বিগ ব্রাদার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ডেভ কার্নি প্রথম এমন একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন। নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্কে যদি রোমান্স বলা যায়, তাহলে পুরুষ-পুরুষ ভাই-ভাই সম্পর্কে ব্রোমান্স বলা যাবে না কেন! স্বভাবতই মানুষ নতুন কিছু খোঁজে। এই শব্দও তাই পরিচিত হতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যেও এমন একটা নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক দেখা গেছে বহুকাল ধরেই। প্রকাশ্যে তাঁদের আলিঙ্গন, খুনসুটিকেও ব্রোমান্স বলতে শুরু করেছিল মিডিয়া। উদাহরণ অবশ্য আরও আছে, খেলার দুনিয়া থেকে টিভি, সিনে তারকা—ব্রোমান্টিক জুটির সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। কম্পোজার ফ্র্যানজ় স্কুবার্ট ও কবি ফ্রানজ় ভন স্কুবার ব্রোমান্টিক জুটি, রক স্টার ডিন মার্টিন-জেরি লুইসের জুটি তো চিরন্তন, বেন অ্যাফ্লেক-ম্যাট ড্যামনের জুটিকে ব্রোমান্টিক সম্পর্কের পথপ্রদর্শক বলা হয়। তারকা জুটিরা ছাড়াও আমাদের চারপাশে, প্রতিদিনের চেনা মুখগুলোর মাঝেও ব্রোমান্টিক জুটি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না।
মনে পড়ে, স্কুলের ভুগোল বা ইতিহাস ক্লাস। পেছনের বেঞ্চে গুজগুজ, খিকখিক। টিফিনে লুকিয়ে একই সিগারেটের ফিল্টারে টান। তুমুল আনন্দে, খুচরো মনখারাপে, প্রচণ্ড কষ্টেও যে কাঁধগুলোতে নির্ভয়ে মাথা রাখা যেত। সেই তো ব্রোমান্স। বন্ধুত্ব মানে দায় নেই, ভার নেই, বন্ধুত্ব মানে মুক্তি। প্রথম প্রেমের চোরা আনন্দ কিংবা প্রথম বিচ্ছেদের দমচাপা কষ্ট নেই। এক ফুরফুরে অনুভূতি যা মনের পুষ্টি জোগায়। তাই ইংরাজি শব্দটাই হয়তো আধুনিক, সম্পর্কগুলো বহুদিনের পুরনো।