
তেরো সুপার-ফুডে শরীর থাকবে চাঙ্গা, ক্যানসার-জুজু ভাগাতে ডায়েট প্ল্যান বললেন বিশেষজ্ঞ
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
মারণরোগের ফাঁদ মানেই মৃত্যুর দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া। বর্তমান জীবনযাত্রায় যে সব মারণ অসুখ নিয়ত আমাদের ভাবনায় রাখে, তার অন্যতম ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর মতে, ভারতের মতো দেশে প্রতি দিনই ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও আধুনিক জীবনযাত্রার নানা ক্ষতিকারক দিকও এমন মারণ অসুখের দিকে ঠেলে দেয় আমাদের।
মেয়েদের মধ্যে স্তন ক্যানসার, ছেলেদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রবণতা বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই হারে অসুখ বাড়তে থাকলে বিগত ৫ বছরের মধ্যে প্রতি ঘরে এক জন করে ক্যানসার আক্রান্ত থাকবেন। ক্যানসার কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণে হয় না। বরং এটি ‘মাল্টি ফ্যাকটোরিয়াল ডিজিজ’। শরীরের বাড়তি মেদ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, তেল-মশলার খাবার, রেড মিট, ডিপ ফ্রায়েড স্ন্যাক্স, অতিরিক্ত ময়দা ও চিনি খেলে ওজন যেমন তরতরিয়ে বাড়ে, তেমনই ক্যানসারের দিকে এগিয়ে যায় শরীর। ওজন বাড়লে এত রকম জটিলতা শুরু হয় যে শরীর থেকে অসুখ সরানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
সেডেন্টারি লাইফস্টাইলেও সুস্থ, চনমনে থাকতে ফাস্ট ফুডকে যেমন বলতে হবে গুডবাই, তেমনি দৈনন্দিন জীবনেও কিছু বদল আনা প্রয়োজন। নিয়মিত শরীরচর্চা, সঙ্গে হালকা ডায়েট আর অবশ্যই কিছু রুটিন মেডিক্যাল চেকআপ, তাহলেই ক্যানসারের মতো মারণ রোগকে কাবু করা সম্ভব হবে।
সুস্থ শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান হল ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলস, ফাইবার। এই ১৩ রকম খাবার যদি রোজের তালিকায় থাকে তাহলেই শরীর থাকবে একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন।
১) ব্রোকোলি
ফুলকপির মতো দেখতে হলেও পুষ্টিগুণে ফুলকপিকে হার মানিয়েছে ব্রোকোলি। ভিটামিন এ, সি, কে, আয়রন, পটাশিয়াম সমৃদ্ধ ব্রকোলিতে ফ্যাট প্রায় থাকে না বললেই চলে। তাই ডায়েটেশিয়ানদেরো বেশ পছন্দের এই সব্জি।
ব্রকোলিতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভনয়েড, লিউটেন, ক্যারোটিনয়েড, বিটা-ক্যারোটিন-সহ নানা অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে। এতে জলের পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ। ক্যালোরি কম থাকায় ওজন বাড়ার সম্ভাবনা নেই, ডায়েটের পাতে দিব্যি মানানসই ব্রোকোলি। পটাশিয়াম থাকায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। ব্রকোলির গ্লুকোরাফানিন ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের কোষ মেরামতে সাহায্য করে। শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় ব্রোকোলি।
২) গাজর
গাজর হল অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। এই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট জাতীয় খাবার ফ্যাট অক্সিডেশনে বাধা দেয় ও শরীরে ক্যানসারের কোষ উৎপাদন কমায়। রোজের ডায়টে গাজরের স্যালাড বা সিদ্ধ গাজরের সব্দি রাখলে তা কোলন ক্যানসার, পাকস্থলীর ক্যানসার রুখতে সাহায্য করে। গাজর খেলে প্রস্টেট ক্যানসারের সম্ভাবনা প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায়। ফুসফুসের ক্যানসার রুখতেও গাজরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
৩) বিনস
বয়ঃসন্ধিতে মেয়েদের রোজকার ডায়েটে পর্যাপ্ত আয়রন না থাকলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা হয়। গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকা শুধু নয় শহরেও কম বয়সি মেয়েদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার খুব বেশি। বয়ঃসন্ধিতে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবারই লিন বডি মাস (LBM) বাড়ে, যা পরবর্তী কালে সার্বিক ভাবে ভাল থাকতে সাহায্য করে। এই বয়সে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন চিকেন, বিনস ডায়েটে রাখা দরকার। বিনস খেলে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে।
৪) বেরি
বেরি জাতীয় ফলে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে। নানা ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধে বেরি জাতীয় ফলের বিশেষ ভূমিকা আছে।
৫) দারুচিনি
খুব উপকারী দারুচিনি। বহু দিন ধরে খাবারদাবারে দারুচিনি ব্যবহারের চল রয়েছে, এর নানা ধরনের গুণের জন্য। যে কোনও ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ রুখতে এর বড় ভূমিকা রয়েছে। নানা ধরনের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে দারুচিনি। নষ্ট কোষগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতেও এ ভূমিকা রয়েছে। ডায়াবিটিস ও হৃদরোগের চিকিৎসাতেও দারুচিনির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
৬) বাদাম
প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই মৌল। তাই ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ সঠিক থাকলে ইনসুলিনের সঠিক কার্যকলাপ বজায় থাকে। তাছাড়া চিনাবাদামে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার থাকে। চিনাবাদাম খেলে রক্তচাপ ও খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল)-এর পরিমাণ কমে যায়। বলাই বাহুল্য, খারাপ কোলেস্টেরলই মেদ বাড়ায়, হার্টের রোগের ঝুঁকিও বাড়ায়।
৭) হলুদ
হলুদে থাকে এমন এক ম্যাজিক যৌগ যা শরীরের জন্য অন্যতম উপকারী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এই যৌগের নাম কারকুমিন। কারকুমিন ছাড়াও হলুদে আছে যথেষ্ট পরিমাণ ফোলেট ( ফলিক অ্যাসিডের মূল উপাদান), নিয়াসিন, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, ভিটামিন কে, ভিটামিন ই, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট। কাঁচা হলুদে আছে ভিটামিন সি। সুতরাং বহু রোগের প্রতিকার হতে পারে হলুদেই।
8) লেবু জাতীয় ফল
সুস্থ থাকার জন্য শরীরে অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান ভিটামিন-সি। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসেবেও এর কদর রয়েছে। ফ্রি র্যাডিকালস ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের হাত থেকে শরীরকে বাঁচায় ভিটামিন সি। কাজেই সুস্থ শরীরের জন্য বেছে নিতে হবে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল। লেবু জাতীয় ফলে ভিটামিন-সি বেশি পরিমাণে থাকে যা শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাছাড়া লেবুতে থাকে ভিটামিন বি১, বি২, বি৫, বি৬, ক্যালসিয়াম, কপার, আয়রন ও পটাসিয়াম।
৯) অলিভ তেল
রান্নায় অলিভ তেল যোগ করলে শরীরে টক্সিনের সঞ্চয় কম হবে। অলিভ অয়েল কেবল মেদ ঝরায় এমনই নয়, রান্নায় অলিভ অয়েল ব্যবহার করা বা অতটা না পারলেও অন্তত স্যালাডের উপর কিছুটা অলিভ অয়েল ছড়িয়ে খেলে তা কাজে আসে। ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রুখতে এই তেলের ভূমিকা রয়েছে। খারাপ টক্সিন জমতে দেয় না শরীরে
১০) তিসির বীজ
তিসি বা ফ্ল্যাক্স সিড অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট, প্রোটিন ও ফাইবারে ভরপুর। শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হার্ট ভাল রাখে ফ্ল্যাক্স। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতেও সাহায্য করে তিসি। ফ্ল্যাক্স সিড খেতে গেলে বীজ শুকনো খোলায় ভেজে নেওয়া জরুরি। অনেকে রোস্ট করার পরে গুঁড়িয়ে নেন তিসি। ক্যানসার ঠেকাতে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।
১১) টম্যাটো
চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল, আমিষ-নিরামিষ সব রকম রান্নাতেই টোম্যাটো ব্যবহার করা যায়। টোম্যাটো রান্নাঘরের এমনই এক সব্জি যা কাঁচাও যেমন খাওয়া হয়, তেমনই রান্নাতেও ব্যবহার করা হয়। একটি মাঝারি আকারের টোম্যাটোতে থাকে মাত্র ২৫ ক্যালরি। টোম্যাটো ফাইবার সমৃদ্ধ একটি সব্জি। ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-১২, ফোলেট, ক্রোমিয়াম এ সবই থাকে এতে। তাই ডায়েটে নিয়ম করে টম্যাটো রাখতে বলছেন চিকিৎকরা।
১২) রসুন
প্রথমেই বলতে হয় রসুনের কথা। রসুন আমাদের অনেক রকমের শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে রাখে। গন্ধটা খুব কটূ হলেও এ উপকারিতা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের। রসুনকে বলে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রসুন খুব উপকারী। রসুন খাওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৩) ফ্যাটি ফিশ
খাদ্যনালির ক্যানসার রুখতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত মাছ খুবই উপকারী। ওমেগা থ্রি থাকায় এই সব মাছ খেলে তা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়। তা ছাড়া এতে ভিটামিন ডি থাকায় তা ত্বকের ক্যানসার রুখতেও খুবই কার্যকর।