
করোনার মধ্যেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে, চিকিৎসা দেরিতে শুরু হলে বিপদ
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
করোনা সংক্রমণ কমার নাম নেই। তার মধ্যেই কোভিডের নতুন প্রজাতি ওমিক্রনের প্রকোপ বাড়ছে। এদিকে মশাবাহিত রোগও তাণ্ডব করছে শহরে। তিন মাস আগে ডেঙ্গিতে শহরে মৃত্যু হয়েছিল দু’জনের। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ম্যালেরিয়াও। পাঁচটা জ্বরের সঙ্গে ম্যালেরিয়া জ্বরের বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু হালে নানা কারণে সব অসুখের চরিত্রেই কিছুটা বদল এসেছে। তাই সাবধান হওয়া দরকার। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ম্যালেরিয়া মারাত্মক আকার নিতে পারে।
কী ভাবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হই আমরা?
ম্যালেরিয়া একটি পরজীবী বাহিত রোগ। যা এক জন মানুষ থেকে অন্য জন মানুষে ছড়ায় স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে। এদের তিনটে জীবন চক্রের একটা হয় মশার শরীরে। বাকি দু’টো আমাদের শরীরে। মানুষের দেহে একবার ঢুকে পড়লে এরা লিভার ও লোহিত কণিকায় এদের বাকি দু’টো জীবনচক্র সেরে ফেলে।
এ বার দেখতে হবে এই পরজীবীরা কী ভাবে শিকারপর্ব চালায় আমাদের শরীরে। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা কামড়ালে তার লালার সঙ্গেই আমাদের শরীরে ঢোকে এই পরজীবীরা। ম্যালেরিয়ার বাহক পরজীবী চার রকম— প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স, প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম, প্লাসমোডিয়াম ওভিলি এবং প্লাসমোডিয়াম ম্যালেরি। তাদের মধ্যে প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের আক্রমণেই হয় ভয়ঙ্কর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া।
ম্যালেরিয়ার পরজীবী শরীরে ঢুকে রক্তস্রোতে ভেসে সে সোজা গিয়ে পৌঁছয় লিভারে। সেখানে বংশবৃদ্ধি করে মেরোজয়েট দশায় এই পরজীবীরা পৌঁছয় লোহিত রক্তকণিকার (RCB) দরজায়। সেখানে তাদের আরও একটি জীবন চক্র শুরু হয়। দ্রুত বংশবৃদ্ধিও হয়। ফলে অতিরিক্ত চাপে লোহিত রক্তকণিকার দেওয়াল ফেটে যায়। পরজীবীরা তখন ফের উদ্বাস্তু হয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং দূষিত কণা মিশিয়ে দেয় রক্তে। ফলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, যাকেই আমরা ম্যালেরিয়ার লক্ষণ বলি।
ম্যালেরিয়া ছোঁয়াচে নয়, তবে রক্তের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে
তিনভাবে ম্যালেরিয়ার রোগের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। ১) অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া চলার সময় ম্যালেরিয়ার জীবাণু ঢুকতে পারে শরীরে, ২) ব্লাড ট্রান্সফিউশন ৩) একই সূঁচ বা সিরিঞ্জ বহুজনের মধ্যে ব্যবহার করলে রোগের জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে।
কী কী লক্ষণ দেখে অসুখ চিনবেন
ম্যালেরিয়া মানেই প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, বমি ভাব চলতেই থাকে। শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা না হলে রোগী আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, মৃত্যুও হতে পারে।
ম্যালেরিয়া রোগীদের প্রচণ্ড গায়ে হাত-পায়ে ব্যথা হতে পারে। পেট খারাপ, মলের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, তলপেটে ব্যথা, প্রচণ্ড ঘাম, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, খিঁচুনি এই লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। তবে রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপরে নির্ভর করছে কী ধরনের লক্ষণ দেখা দেবে।
ম্যালেরিয়ার প্রথম উপসর্গ হল জ্বর। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবে। কখনও জ্বর কমে যাবে, কখনও আবার তীব্র জ্বর আসবে। সেই রকম হলে সন্দেহ করা হয় আক্রান্তের ম্যালেরিয়া হয়েছে। জ্বর হলে কোনও প্রাথমিক প্রতিষেধকের উপরে ভরসা না রেখে আগে চিকিৎসকের কাছে যান। তার পরে রক্ত পরীক্ষা করালে তবেই ম্যালেরিয়া ধরা পরবে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা হবে।
সচেতন হলেই রোগ ঠেকিয়ে রাখা যায়
ম্যালেরিয়ার কোপে প্রতি বছর বিশ্বে চার লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিনে অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। ম্যালেরিয়ার এই ভ্যাকসিনের নাম আরটিএস, এস/এএস০১ (RTS,S/AS01)। তবে ওষুধ বা ভ্যাকসিনের থেকে সচেতনতা বাড়লে রোগ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব।
মশার উৎপাত বাড়লে মশারি টাঙানো বাধ্যতামূলক।
বাড়ির আশপাশে জল জমতে দেবেন না। বাড়ির কোথাও জল জমতে দেওয়া যাবে না। ফুলের টব, টায়ার, ভাঙা পাত্রে জমা জলে এই রোগের মশা তাদের বংশবৃদ্ধি করে। সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অফিস বা বহুতলের ছাদগুলি বেশিরভাগ সময়ই ব্যবহার করা হয় না। ফলে সেখানে অনেক সময় মশার বংশবৃদ্ধি হয়। এ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অফিসে স্প্রে করার বিষয়েও নজর রাখতে হবে।
ডিডিটি-র মতো কীটনাশক ঘরে স্প্রে করলে মশার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। সরকারি বা এমনকি বেসরকারি ভাবেও মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।