
দূরত্ব দূর হোক! ৩ বছর ধরে ক্যানসার দিবসে একই থিম, চিকিৎসার অধিকারে কেন এত বেশি গুরুত্ব
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
ক্যানসারের যে অ্যানসার রয়েছে, তা এখন অনেকেই জেনে গেছেন। ‘দুরারোগ্য’, ‘মারণব্যাধি’– এই তকমাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ক্যানসার আজ এমন একটা লড়াই হয়েছে, যা লড়া যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে রোগী আর ততটা অসহায় নন। কিন্তু এ জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’ (Close the Care Gap)।
আজ, ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবসে এটাই থিম। শুধু এ বছর নয়, গত বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে শুরু হয়েছে এই ‘ক্লোজ দ্য গ্যাপ’ প্রচার। আগামী বছরেও চলবে এই থিম। অর্থাৎ মোট তিন বছর ধরে এই একই থিম পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যানসার কন্ট্রোল বা ইউআইসিসি এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’ (Close the Care Gap) ব্যাপারটা ঠিক কী?
বিগত দু’দশকে বিশ্বজুড়ে ক্যানসার চিকিৎসার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। একথা বলাই যা, উন্নত রেডিয়েশন, সার্জারি, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে আজ ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। এমনকি স্টেজ ফোর ক্যানসারের রোগীকেও সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে বছরের পর বছর।
কিন্তু এই চিকিৎসার সুবিধা কি সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছচ্ছে?
উত্তরটা এক কথায়– না। এই জায়গাটায় একটা বিরাট বৈষম্য বা ‘গ্যাপ’ রয়েছে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে। শুধু ধনী ও দরিদ্র নয়, নারী পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে, সাদা, কালো, বাদামী চামড়ার মানুষের মধ্যে, শিশু, যুব সম্প্রদায়, বৃদ্ধদের মধ্যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে, শহর, গ্রাম ও মফস্বলের মধ্যে, এমনকি কে বেশি সঠিক তথ্য জানার সুযোগ পাচ্ছেন এবং কে পাচ্ছেন না, তার মধ্যেও।
অথচ সমাজনীতি বলে, সকলের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সমান। তাই ইউআইসিসি মনে করেছে, এই বৈষম্য দূর করার চেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য সমস্যাটির সম্যক অনুধাবন দরকার এবং সংঘবদ্ধ হয়ে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বার্তা পৌঁছে দেওয়া দরকার রাষ্ট্রনায়কদের কাছে। কারণ এ বৈষম্য ভাঙার মূল চাবিকাঠি তাঁদের হাতেই রয়েছে।
কিন্তু, আমরা, যাঁরা সাধারণ মানুষ, যাঁরা এসব বৈষম্যের মধ্যেই মিলেমিশে রয়েছি, তারা কি এই বিভেদ দূর করতে কিছুই করতে পারি না (Close the Care Gap)?
এই উত্তরটা আমরা চাইলেই ‘হ্যাঁ’ হতে পারে। আমাদের সমাজে তৈরি করা যে বৈষম্য একজন নারীকে বাধ্য করে নিজের শারীরিক সমস্যা গোপন করতে, তা আমরাই দূর করতে পারি। স্তনে কোনও দলা অনুভব করলে বা মেনোপজের পরে রক্তপাত হলে কেন সেটা সংকোচে লুকিয়ে রাখতে হয় আমাদের মা বোনেদের? কেন আজও বহু মেয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হন নিজের শারীরিক সমস্যা নিয়ে অন্যকে বিব্রত করতে? আবার এমনই কোনও সংকোচ বা দ্বিধা থেকে একজন বয়স্ক পুরুষও নীরবে সহ্য করে যান প্রস্রাবের সমস্যা।
কেন আমাদের এটুকু সামাজিক সুরক্ষা থাকবে না, যেখানে একজন মানুষ নিঃসংকোচে তাঁর অসুস্থতার কথা বলতে পারেন? এই দায়িত্বটুকু তো আমরা নিতেই পারি।
আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা কেন এড়িয়ে চলেন চিকিৎসালয়ের দরজা? কেন সমান সহমর্মিতা, সমান যত্ন সমাজ তাঁদের জন্য দেখাতে পারে না। কী কারণেই বা ক্যানসারের চিকিৎসা কেবল বড় বড় শহরেই সীমাবদ্ধ? মফস্বলের, গ্রামের মানুষকে সঠিক পরামর্শ কে দেবেন? কেন তাঁদের দূর-দূরান্তে ছুটে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য?
শুধু তাই নয়। যেখানে সঠিক পরামর্শ, সঠিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে, সেখানে কেনই বা ভুল তথ্য, বিকৃত তথ্য, বিভ্রান্তকারী বিজ্ঞাপনকে প্রচারের অনুমতি দেওয়া হবে? ভুল ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচার বন্ধ করতে সরকার আরও সচেষ্ট হবে না কেন। কেন বিকল্প চিকিৎসার নামে ক্যানসার চিকিৎসার অমুল্য সময় নষ্ট করতে দেওয়া হবে!

ক্যানসার চিকিৎসার বিপুল উন্নতি পৌঁছে দিতে হবে প্রতিটি মানুষের কাছে। এ জন্য জোটবদ্ধ হয়ে, সমস্যা অনুধাবন করে এর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলিয়ে দূর করতে হবে দূরত্ব, ‘ক্লোজ’ করতে হবে ‘কেয়ার গ্যাপ’।
ঠিক এই কথাটাই বলছে ইউআইসিসি, এটাই তাদের প্রচার। তিন বছরের প্রচার। ২০২২ সালে সমস্যা অনুধাবন করার কথা বলেছিল তারা, ২০২৩ সালে বলছে, সারা পৃথিবীর মানুষকে সংঘবদ্ধ হতে হবে এই চেষ্টায়, সবার সমান ক্যানসার চিকিৎসার দাবিতে আওয়াজ তুলতে হবে। এবং শেষতম বছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালে এই আওয়াজ পৃথিবীর সব দেশের নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তাঁদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে সমান চিকিৎসার অধিকারের দাবিতে।
এক কথায় বলতে গেলে, সকল ক্যানসার রোগীর সমান যত্ন ও চিকিৎসা চাই, সমস্ত বৈষম্য দূর করতে হবে। এই স্লোগানই ক্যানসার দুনিয়ায় প্রচার করতে চাইছে ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যানসার কন্ট্রোল।
হাতিদের ক্যানসার হয় না, সম্ভাবনাও নেই, কেন? বিশ্ব ক্যানসার দিবসে জানুন এর রহস্য