
জীবনে যতই ক্ষত-দাগ থাকুক, ত্বক চাই নিখুঁত! লেসার থেরাপি দিয়ে ম্যাজিক করছেন ডাক্তারবাবু
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘জন্মেছিস যখন, তখন দেওয়ালে ‘দাগ’ রেখে যা।’ আবার আধুনিক বিজ্ঞাপনের চটকদারি ভাষা বলছে, ‘দাগ’ আচ্ছে হ্যায়। কিন্তু জীবনের দেওয়ালে বিশেষ কোনও কৃতিত্বের দাগ অথবা পোশাকের উপর খেলাধুলোর দাগ যতই জরুরি ও প্রশংসিত হোক না কেন, মুখের চামড়ায় বা শরীরের কোনওখানে অবাঞ্ছিত দাগ-ছোপ বেশিরভাগ মানুষই পছন্দ করেন না। আর বিশেষ করে সে দাগ যদি মুখের কোনওখানে হয়, তবে তো তা মিলিয়ে গেলেই যেন স্বস্তি।
জন্মগত হোক বা পরবর্তী কোনও কারণে হোক, এই দাগ নিয়ে অনেকেই বড় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এখানেই শেষ নয়। কেউ কেউ আবার ইচ্ছাকৃত ভাবে শরীরে দাগ তৈরি করে, তা নিয়ে পরে পস্তান। শখ করে করানো ট্যাটুও কখনও কখনও মুছে ফেলার প্রয়োজন বা ইচ্ছে হয়।
এ সবেরই উত্তর রয়েছে ত্বক বিশেষজ্ঞদের কাছে। আর সেই উত্তরের চাবিকাঠি হল লেসারথেরাপি। লেসারের মাধ্যমে ত্বকের সমস্যায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্ভব। এমনটাই বলছেন অ্যাপোলো গ্লেনেগলস হাসপাতালের ত্বক বিশেষজ্ঞ, ডক্টর কৌশিক লাহিড়ী।
কী এই লেসারথেরাপি?
লেসার শব্দটির কোনও আক্ষরিক অর্থ নেই। এটি আসলে একটি বড় শব্দবন্ধের ছোট প্রকাশ। ‘light amplification by the stimulated emission of radiation’, সংক্ষেপে laser বা লেসার। সহজ বাংলায় একে বলা যেতে পারে, আলোকরশ্মিকে ঘনীভূত ও তীব্র করে নির্দিষ্ট একটি দিকে চালনা করার পদ্ধতি। এর শক্তি কতটা, তার উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, এই লেসার রশ্মির মাধ্যমে এক সেকেন্ডেই ইস্পাতের গায়ে একটি ছিদ্র তৈরি হতে পারে।
লেসার কীভাবে সারায় ত্বক?
লেসারের কাজ করার পদ্ধতি যদি ব্যাখ্যা করতে হয়, একে সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। ত্বকের যে কোনও ক্ষত বা দাগের উপর লেসার ফেলে আসলে আরও কিছু ক্ষত তৈরি করা হয় আসল ক্ষতর চারপাশে। ত্বকের গভীরে নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষ-কলার মধ্যে যখন রশ্মি পৌঁছয়, তখন মাঝখানের অংশ অবিকৃত থাকে। ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়া কোলাজেন ও ইলাস্টিক তন্তুর গঠন অনেক সহজ হয়। দ্রুত মিলিয়ে যায় ক্ষত।
যেখানে লেসার ট্রিটমেন্ট হবে, কেবল সেই জায়গাটুকুর উপর একটা জেল লাগিয়ে এই থেরাপি চলে। পরের দিনই জল দিয়ে ধোয়া যায় জায়গাটা। কয়েক দিন পরে চামড়ার একটা পাতলা স্তর খোসার মতো উঠে আসে, লাল হয়ে থাকে জায়গাটা। এই অবস্থায় কোনওভাবেই রোদ লাগানো যাবে না বা ঘষাঘষি করা যাবে না। মাস দেড়েক পরে ফের পরের সিটিং। এরকম কয়েকটা সিটিংয়ের পরেই মিলিয়ে যায় ক্ষত, দাগ।
কারও ক্ষেত্রে একটা, কারও ৫-৬টা সিটিংও লাগতে পারে। ভারতে এক একটি সেশনের খরচ পড়ে ৪-৮ হাজার টাকার মধ্যে।
কী কী সারায় লেসার?
মুখের দাগ অনেক কারণেই হতে পারে। সেই অনুযায়ী চিকিৎসার রকমফের হয়। অনেকের জন্মগত কারণ, যেমন জড়ুল থাকতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় নিভাস। লেসার থেরাপির মাধ্যমে এই জড়ুলের দাগ মুছে ফেলা সম্ভব। আবার অনেক সময়েই ছোটবেলায় বা বড় হয়ে কোনও চোট-আঘাত লাগার কারণে ক্ষত তৈরি হয় মুখে, সেই ক্ষত মিলিয়ে গেলেও থেকে যায় দাগ। কিশোরবেলায় ব্রণ হওয়ার কারণেও দাগ বা গর্ত থেকে যায়। ভারতীয়দের ত্বকে আবার বেশি হয় মেচেতা। এর একটা বড় কারণ কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলের ব্যবহার। তবে তা ছাড়াও হতে পারে অনেক কারণে। মেচেতার দাগও সারে লেসারে, তবে তার চিকিৎসা দীর্ঘস্থায়ী।
শুধু তাই নয়। লেসার থেরাপির মাধ্যমে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে মুখে বা শরীরের অন্য কোনও অংশে জন্ম নেওয়া ছোট ছোট আঁচিল। চিরস্থায়ী ভাবে তুলে ফেলা যেতে পারে মুখের অবাঞ্ছিত লোম। কোনও রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই মুছে ফেলা যায় ট্যাটুর ছাপ। কারও আবার পুড়ে যাওয়ার কারণে ত্বক নষ্ট হয়ে যায়।
ত্বকের সমস্যার প্রধান তিনটি ধরন
প্রথম যে সমস্যা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ আসেন চিকিৎসকের কাছে, তা হল স্কার। বা আক্ষরিক অর্থেই ক্ষত। এই ক্ষতর কারণ যেমন হতে পারে কোনও দুর্ঘটনা, আগুনে পুড়ে যাওয়া, তেমনি হতে পারে বসন্ত রোগ, ব্রণ খুঁচে ফেলার গর্ত। এই ধরনের সমস্যায় কার্বন ডাই অক্সাইড লেসার ট্রিটমেন্ট করা হয়। এই ক্ষেত্রেই মূলত জেল লাগিয়ে থেরাপি দিতে হয়। জেলটি লাগালে জায়গাটি অসাড় হয়ে যায়। সাধারণত ৬-৭টি সিটিংয়ে সেরে যায় স্কার।
দ্বিতীয় সমস্যা হল, পিগমেন্টেশন। তা হতে পারে মেচেতা, ফ্রেকেলস বা জন্মগত জড়ুল। ট্যাটুর দাগও এই ভাগে পড়ে। এক্ষেত্রে এনডি ইয়াভ লেসার থেরাপি দেওয়া হয়। এটিতে একেবারেই ব্যথা হয় না। তাই অসাড় করারও প্রয়োজন পড়ে না। কারও ক্ষেত্রে ২-৩টে সিটিং প্রয়োজন হয়, কারও আবার ৫-৬টা সিটিং লাগে।
তৃতীয় সমস্যা হল হেয়ার রিমুভাল। এটিও খুবই সহজ ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। মুখের অবাঞ্ছিত লোম তুলে ফেলা যায় কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই, চিরস্থায়ী ভাবে। এই ক্ষেত্রে কতগুলি সিটিং লাগবে, তা নির্ভর করে, লোম গজানোর তীব্রতা ও ঘনত্বের উপর। মূলত মহিলারা এই সমস্যা নিয়ে আসেন, যার কারণ হিসেবে লুকিয়ে থাকে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। তাই আমরা সেক্ষেত্রে রোগীকে হরমোন থেরাপিও করাতে বলি, ওজন কমাতে বলি, হরমোনের ব্যালেন্সের জন্য। সেটার ওপর নির্ভর করে, কত বেশি ও কত ঘনঘন সিটিং লাগবে রোগীর।