শেষ আপডেট: 24th January 2024 14:31
সামনে বিশালাকৃতি কাঞ্চনজঙ্ঘা, আকাশ পরিষ্কার থাকলে উঁকি দেবে সেভেন সিস্টারও। সাদা বরফের চাদরে ঢেকে রয়েছে সেই বহু প্রতীক্ষিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেদিকেই তাকাবেন, কোনও না কোনও দৃশ্য দেখে চোখ আটকে যাবেই। সবুজ অরণ্য, ঘন পাইনের জঙ্গল, পাখিদের মিষ্টি কলতান শুনতে শুনতে কখন যে পৌঁছে যাবেন সান্দাকফু, বুঝতেই পারবেন না।
পাহাড় যদি পছন্দ করেন, আর প্রথমবার ট্রেক করতে যেতে চান, তাহলে অবশ্যই যেতে পারেন সান্দাকফু (Sandakphu Trek details planning)। পায়ে হেঁটে বা গাড়িতে, দুভাবেই পৌঁছানো যেতে পারে। তবে পায়ে হেঁটে যাওয়ার কিন্তু মজাই আলাদা। ১১,৯২৯ ফুট উচ্চতায় (৩৬৩৬ মি) কাঞ্চনজঙ্ঘার এক অপরূপ সৌন্দর্যের সাক্ষী হতে গেলে যেতেই হবে সান্দাকফু ট্রেকে। মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত সান্দাকফুতে ট্রেক বন্ধ থাকে, তাছাড়া বছরের বাকি সময় এই ট্রেক রুট সকলের জন্য খোলা থাকে।
সান্দাকফুই হোক বা অন্য কোনও ট্রেক, তার জন্য কিছু সরঞ্জাম গুছিয়ে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- স্পোর্টস শু, রাকস্যাক, শীতকালীন জামাকাপড়, ট্রেক স্টিক, ভাল জলের বোতল, ওষুধপত্র, শুকনো খাবার এবং নিজস্ব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। খেলাধূলার জিনিসপত্র পাওয়া যায় এমন দোকান অথবা নিকটবর্তী যেকোনও ট্রেকিং সরঞ্জামের দোকান থেকে এই সমস্ত জিনিস কিনে নিতে পারবেন সহজেই।
পরিকল্পনা:
এবারে আসা যাক কীভাবে একটা ট্রেক প্ল্যান করবেন সেই প্রসঙ্গে। প্রথমেই কত দিনের জন্য ট্রেক করতে চান সেটা ঠিক করতে হবে, তারপর প্রত্যেকটা দিনের কাজ ভাগ করে নিতে হবে। প্রত্যেকটা দিন একটি জায়গা থেকে অন্য জায়গা বা গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে বেরোতে হবে এবং কোন দিন কোন জায়গায় থাকা হবে, কোন দিন কোন জায়গা থেকে বেরোনো হবে সেই সমস্ত কিছু আগে থেকে ঠিক করে যেতে হবে।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল যাওয়া এবং আসার ট্রেনের টিকিট। সেগুলো কিন্তু আগে থেকেই বুক করে ফেলতে হবে। সামনেই পুজো, তাই ট্রেনের টিকিট কিন্তু এখন এক চান্সে পাওয়া বেশ কঠিন, তাই সময় নষ্ট করা যাবে না। টিকিট কাটা হলে তারপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ট্রেক গাইডের সঙ্গে কথা বলা। পুরো ট্রেকটায় তিনিই কিন্তু আপনার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু।
প্রথম বার ট্রেক করার জন্য সান্দাকফু কেমন?
প্রথমবারেরর ট্রেকিং ডেস্টিনেশন হিসেবে সান্দাকফু খুবই ভাল। তবে সান্দাকফু ট্রেক কিন্তু সহজ নয়। সান্দাকফুকে বলা হয় ইজি-মডারেট ট্রেক, অর্থাৎ কিছু কিছু জায়গা ট্রেক করার জন্য সহজ এবং কিছু কিছু জায়গা খুব কঠিন না হলেও খুব সহজও নয়, যাকে বলা হয় মডারেট। যে কোনও ট্রেকে যাওয়ার আগে শারীরিকভাবে ফিট থাকা জরুরি, সান্দাকফুও ব্যতিক্রমী নয়। কারণ সান্দাকফু ট্রেক রুটে চড়াই-উতরাইয়ের পরিমাণ বেশ অনেকটাই। কম করে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটতে হবে রোজই। কোনওদিন সেটা বেশিও হতে পারে আবার কোনওদিন সেটা দশের কমও হতে পারে।
যাতায়াত পর্ব:
বাকি সব তো ঠিক আছে, কিন্তু সান্দাকফু পৌঁছাবেন কী করে? সেটার তথ্যও রইল আপনাদের জন্য। শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার যে কোনও ট্রেনের টিকিট কেটে নিতে হবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পর্যন্ত। সান্দাকফু থেকে আবার ফালুট পর্যন্ত হাঁটার পরিকল্পনা না থাকলে সাধারণত ৭ দিনই সান্দাকফু ট্রেকের জন্য যথেষ্ট। ৭ দিনের জন্য ট্রেকিংয়ের পরিকল্পনা করলে যাতায়াত মিলিয়ে পুরো ট্রিপ শেষ করতে দশদিন মতো সময় লাগবে।
প্রথম দিন রাত্রে ট্রেনে উঠলে পরের দিন সকালবেলা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে গাড়ি বুক করে চলে যেতে পারেন মানেভঞ্জন অর্থাৎ যেখান থেকে ট্রেক শুরু হবে। এই মানেভাঞ্জন পৌঁছানোর জন্য আগে থেকে গাড়ি বুক করা যেতে পারে অথবা এনজিপি স্টেশনে নেমে তখনই গাড়ি বুক করে চলে যেতে পারেন।
সাধারণত সান্দাকফু ট্রেক মানেভঞ্জন থেকে শুরু হয়। প্রথম দিন মানেভঞ্জন পৌঁছে গিয়ে চারদিকটা ঘুরে দেখুন, নিজের শরীরকে পাহাড়ি উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় দিন, বিশ্রাম নিন। আগে থেকে কথা বলা থাকলে গাইড আপনাকে এখান থেকেই সঙ্গে দেবে।
পকেটের টান:
পুরো ট্রেকটা মোটামুটি ১০ হাজার টাকার ভিতরে কমপ্লিট হয়ে যেতে পারে, আরও কম হতে পারে যদি অনেকে মিলে একসঙ্গে যান। এছাড়া থাকা, খাওয়া এবং ওখানে গিয়ে আপনি কীভাবে খরচ করবেন, তার উপর নির্ভর করছে মোট খরচ। যত উপরে উঠবেন খাওয়া-দাওয়ার খরচ বেশি হবে। তাই নিজেদের সঙ্গে শুকনো খাবার, বিস্কুট, ম্যাগি নুডলস ইত্যাদি রাখলে সুবিধা হবে।
ট্রেক রুট:
এনজেপি স্টেশন থেকে গাড়ি করে আসতে হবে মানেভঞ্জন অথবা চিত্রে। পরের দিন থেকে শুরু হবে ট্রেক। সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের ভিতর থেকে সুন্দর ট্রেকিং রুট ধরেই পৌঁছে যেতে পারেন সান্দাকফু। প্রথম দিন মানেভঞ্জন (৭০৫৩ ফুট) থেকে টুমলিং (৯৫১৪ ফুট) ৮ ঘণ্টার ট্রেকিং। পথ গিয়েছে ছবির মতো গ্রাম চিত্রের বুক চিরে। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে অনেক সময়ে চিত্রে থেকেও ট্রেক শুরু করা যায়। যাত্রাপথে পড়বে অপূর্ব সুন্দর মেঘমা গ্রাম। টুমলিংয়ে পৌঁছে ওখানেই ঘাঁটি গেড়ে নিন সেদিনকার মতো।
পরদিন ভোরে উঠে অপূর্ব সূর্যোদয় দেখতে দেখতেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিন। খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে কালাপোখরির (১০৪০০ ফুট) উদ্দেশে। চেষ্টা করবেন যাতে কালাপোখরি দুপুর দুপুর পৌঁছাতে পারেন, কারণ এই অপূর্ব জলাশয়ের পাড় থেকে সূর্যাস্তের এক অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
পরদিন সকালের যাত্রাপথ হল কালাপোখরি থেকে সান্দাকফু (১১ হাজার ৯২৯ ফুট)। ৪ ঘণ্টার টানা খাড়া পথ ধরে পৌঁছাতে হয় সান্দাকফুতে। যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তবে সান্দাকফু থেকেও সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় দুইয়েরই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে পাবেন।
ফেরার পথ -
সান্দাকফু থেকে এনজেপির দিকে নেমে আসার সময় যেই গ্রামটি প্রথমে পড়বে তা হল গুরদুম। এদিন সম্পূর্ণ রাস্তাটি ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে নামতে হবে। জঙ্গলের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং বিভিন্ন রংবেরঙের পাখি, সঙ্গে তাদের কলকাকলি শুনে মনে হবে এ যেন এক অন্য পৃথিবী। এইসব উপভোগ করতে করতে কখন যে গুরদুম পৌঁছে যাবেন নিজেও টের পাবেন না।
পরদিন সেখান থেকে শ্রীখোলা হয়ে সেপি, তারপরের দিন রিম্বিক এবং রিম্বিক থেকে গাড়ি ধরে বাগডোগরা বিমানবন্দর অথবা এনজেপি স্টেশনে চলে আসতে পারবেন।