শেষ আপডেট: 11 January 2024 16:25
দ্য ওয়াল ব্যুরো: গত কয়েকদিন ধরেই সার্চ ইঞ্জিন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং লাক্ষাদ্বীপ। নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সেখানে সফর এবং তৎপরবর্তী বিতর্ক। সেই বিতর্কে নাম জড়িয়েছে মলদ্বীপের। জানুয়ারির শুরুতেই বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উদ্বোধনের জন্য লাক্ষাদ্বীপে গিয়েছিলেন মোদী। সেখান থেকে ফিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করেন তিনি, যা নিয়ে তাঁকে কটাক্ষ করে বরখাস্ত হন মলদ্বীপের ৩ মন্ত্রী। কিন্তু এতে শাপে বর হয়েছে, কারণ তাতে হঠাৎ করেই চেগে উঠেছে লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন ব্যবসা। হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু অনালাইনে লাক্ষাদ্বীপ সফরের বিষয়ে খোঁজ-খবর করতে শুরু করেছেন। কীভাবে সেখানে যাওয়া যায়, খরচ কত, কী কী না দেখলেই হয়, থাকবেন কোথায়- সেই সব তথ্যই আজ দেব আপনাদের।
লাক্ষাদ্বীপ সাগর এবং আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত এই ৩৬টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে তৈরি লাক্ষাদ্বীপ বিখ্যাত মূলত সাদা বালি, আর পান্না সবুজ জলের অগভীর জলাশয়ের জন্য। রয়েছে স্ফটিক স্বচ্ছ জলের হ্রদও। জলের রং কোথাও সবুজ, কোথাও নীলচে সবুজ, কোথাও আবার গাঢ় নীল। এই দ্বীপপুঞ্জে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি আর সুনীল আকাশের সঙ্গেই রয়েছে শ্যামল কানন। সারি সারি নারকেল গাছ যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বার্ড আই ভিউ থেকে লাক্ষাদ্বীপ দেখলে চোখের পলক পড়বে না, এতটাই নয়নাভিরাম সেই দৃশ্য। প্রকৃতি যেন এখানে আপন খেয়ালে সাজিয়েছে নিজেকে, অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছে রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ।
সংস্কৃত ভাষায় লাক্ষাদ্বীপ শব্দের অর্থ লক্ষ দ্বীপের সমষ্টি। ৩২ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিষয়টি এই দ্বীপপুঞ্জ ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে ক্ষুদ্রতম। এখানের দ্বীপগুলিতে মূলতবিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বাস। সেই কারণেই এখানে যেতে গেলে সরকারের থেকে অনুমতি নিতে হয়। প্রায় বছর খানেক আগে থেকে তার প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়। অনলাইনে ফর্ম ফিল আপ করে জমা দিতে হয় সরকারের কাছে। সেসব খতিয়ে দেখে এবং আবেদনকারীর তথ্য যাচাই করার পর ভ্রমণের অনুমতি মেলে। লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের জন্য সরকারি প্যাকেজ তো রয়েছেই, অনেক বেসরকারি ট্যুর অপারেটররাও এখানে ঘুরতে নিয়ে যান। তবে তাঁদের সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। ৩৬টি দ্বীপের মধ্যে মাত্র কয়েকটি দ্বীপে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে কাভারাত্তি, বাঙ্গারাম, আগাত্তি, কদমত, কালপেনি এবং মিনিকয়। সেগুলির মধ্যে এক একটি দ্বীপ বিখ্যাত এক একটি কারণে। কোন কোন দ্বীপে আপনি থাকতে চান, বা যেতে চান, তার উপর নির্ভর করে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন রকম প্যাকেজ রয়েছে।
লাক্ষাদ্বীপে দু'ভাবে যাওয়া যায়। জাহাজে, এবং বিমানপথে। জাহাজে ভ্রমণ এবং থাকার অভিজ্ঞতা প্রতক্ষ্য করতে চাইলে বেছে নিতে পারেন ভারত সরকারের সমুদ্রম প্যাকেজ। পাঁচ দিনের এই ট্যুরে এম.ভি কাভারত্তি নামে একটি জাহাজে করে কাভারত্তি, কালপেনি এবং মিনিকয় দ্বীপপুঞ্জ ঘুরে দেখা যায়। কেরালার কোচি থেকে জাহাজ ছাড়ে। এই প্যাকেজে দিনের বেলা দ্বীপগুলি ঘুরিয়ে দেখানো হয়। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ফেনিল জলরাশির পাশেই সৈকতে। রাতে থাকতে হবে জাহাজেই। এমভি কাভারত্তি জাহাজে ১৫০টি ডায়মন্ড ক্লাসে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। দিনের বেলা দ্বীপ সফরে রয়েছে বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের ব্যবস্থা। সমুদ্র-স্নান, স্নরকেলিং এবং স্কুবা ডাইভিং সহ আরও বিভিন্ন রকমের জল-ক্রীড়ার আয়োজন রয়েছে। এই প্যাকেজে ১০ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের শিশু হিসাবে গণ্য করা হয়।
এছাড়া রয়েছে সোয়েইং পাম প্যাকেজ। এটি মূলত মিনিকয় দ্বীপে ৬-৭ দিনের সফর। সমুদ্র সৈকতে, এবং জলের উপরেই রয়েছে সুদৃশ্য বাতানুকূল কটেজ। সেখানেই পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এমভি আরব সাগর এবং এমভি লক্ষদ্বীপ সমুদ্র, এমভি মিনিকয়, এমভি আমিনডিভি, এমভি কাভারাত্তি জাহাজে করে ঘুরিয়ে দেখানো হয় দ্বীপগুলি।
সমুদ্র ও সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন নিয়ে আগ্রহ থাকলে বেছে নিতে পারেন মেরিন ওয়েলথ অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম। এই প্যাকেজে মূলত কদমাত দ্বীপে ৪-৫ দিনের ট্যুর করানো হয়। ওয়াটার স্পোর্টসের স্বর্গরাজ্য এই দ্বীপ। কদমাতে রয়েছে একটি ওয়াটার স্পোর্টস ইনস্টিটিউট। সেখান থেকেই সাঁতার কাটা, স্নর্কেলিং, কায়াকিং, স্কুবা ডাইভিং, উইন্ড সার্ফিং, ব্যানানা রাইড, জেটস্কি এবং প্যারাসেলিং-এর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
রয়েছে তারাতাশি প্যাকেজ। এই প্যাকেজে ভ্রমণ করতে চাইলে শুধু কাভারাত্তি দ্বীপেই ৪-৫ দিন থাকতে হবে। পর্যটকদের থাকার জন্য সৈকতেই রয়েছে মনোরম কটেজ। সাঁতার কাটা, স্নরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং ছাড়াও রয়েছে নৌকা বিহারের সুযোগ। সেই নৌকাগুলির তলদেশ তৈরি হয় স্বচ্ছ কাচ দিয়ে। নীলচে সবুজ লেগুন দেখার জন্য এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর কীই বা হতে পারে!
ধনকুবেরদের মতো ব্যক্তিগত দ্বীপে থাকার অভিজ্ঞতা চান, মাত্র কয়েকদিনের জন্য হলেও? তাহলে থিন্নাকারা টেন্ট প্যাকেজ নিতে পারেন। এটি আক্ষরিক অর্থেই প্রাইভেট আইল্যান্ডে থাকার মতো। থিন্নাকারা দ্বীপটি বাঙ্গারাম দ্বীপের ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত। এখানে রয়েছে বিস্তীর্ণ উপহ্রদ। দেখা মিলবে প্রবালেরও। আগত্তি থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই দ্বীপটি সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ। এখানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য অসামান্য। সৈকতে সানবাথ নিতে চাইলে সে সুযোগও রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টস এবং বিচ ভলিবলের ব্যবস্থাও।
বাঙ্গারামে কটেজে থেকে লাক্ষাদ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে বেছে নিতে পারেন এই প্যাকেজ। এখানে পৌঁছতে গেলে আগে বিমানপথে যেতে হবে আগাত্তিতে। সেখান থেকে সমুদ্রপথে যেতে হবে নিঝুম এই দ্বীপে। বাঙ্গারাম প্রবাল প্রাচীর এবং অগভীর লেগুন দ্বারা বেষ্টিত। এটি বিশ্বের সেরা গেটওয়েগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে। এখানে সজারু, তোতা, পাফারফিশ, হারমিট কাঁকড়া এবং সামুদ্রিক পাখির দেখা মেলে। স্কুবা ডাইভিং, বিচ স্পোর্টস, সাঁতার কাটা, স্নরকেলিং এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার মতো অসংখ্য অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ রয়েছে এখানে। সৈকতের উপরেই রয়েছে ৬০ শয্যাবিশিষ্ট একটি রিসর্ট। একটি মাল্টি কুইজিন রেস্তোরাঁও রয়েছে বাঙ্গারামে।
যাঁরা স্কুবা ডাইভিং করতে চান, তাঁদের জন্য একটি আলাদা প্যাকেজ রয়েছে সরকারের তরফে। স্কুবা ডাইভ প্যাকেজ নিলে ডাইভিং-এর সমস্ত সরঞ্জাম দেওয়া হবে ট্যুর অপারেটরের তরফ থেকেই। তবে ডাইভিংয়ের জন্য প্রার্থীকে 'ফিট' ঘোষণা করে ডাক্তারের শংসাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। ডাইভিং কোর্স করার সর্বনিম্ন বয়স ১৪ বছর।
এতগুলি প্যাকেজ থাকলেও সমুদ্রম প্যাকেজটিই লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ এই প্যাকেজে একাধিক দ্বীপে ভ্রমণের সুযোগ মেলে। অন্য প্যাকেজগুলিতে মূলত একটিই দ্বীপে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া সমুদ্রম প্যাকেজের খরচও বাকিগুলির তুলনায় বেশ অনেকটাই কম। সমুদ্রম প্যাকেজের খরচ মাথাপিছু ৩৫,০০০ টাকার আশেপাশে। কোচি থেকে লাক্ষাদ্বীপ ঘুরে কোচি ফেরার সমস্ত খরচ ধরা থাকে এর মধ্যেই।
কখন যাবেন: অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি হল লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়। এই সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। মার্চ থেকে মে মাসেও অনেকে ঘুরতে যান এখানে। এই সময় তাপমাত্রা তুলনায় সামান্য বেশি থাকে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হল অফ সিজন। তবে লাক্ষাদ্বীপের বর্ষাকাল চোখে দেখতে দুঃসাহসী ভ্রমণপ্রেমীরা এই সময়টিকে বেছে নেন। আগাত্তি এবং বাঙ্গারামের সবুজে ঘেরা প্রকৃতি দেখতে চাইলে বর্ষায় লাক্ষাদ্বীপ যেতে পারেন।