শেষ আপডেট: 10th September 2023 08:25
খেয়াল করে দেখবেন শহর ছাড়িয়ে দূরে গ্রামের দিকে ভাতের হোটেলগুলোতে ভাতের সঙ্গে যে তরকারিগুলো দেওয়া হয় সেগুলো বেশ ঘরোয়া এবং সস্তা। গ্রামের ভেতরে তো ফুটপাত বলে কিছু নেই, তাই এগুলোকে ফুটপাতের হোটেল (pice hotel story) বলা যাবে না। রাস্তার হোটেল বললেও এই হোটেলগুলোর প্রতি সুবিচার করা হয় না। সাধারণত বাসস্ট্যান্ড বা স্টেশন রোডের ওপর এই ধরনের ভাতের হোটেল দেখতে পাওয়া যায়। সব হোটেলের সাইনবোর্ড থাকে না। পান্থতীর্থ, জলযোগ, অন্নপূর্ণা, মমতা, তৃপ্তি, হিন্দু হোটেল, মুসলিম হোটেল ব্র্যাকেটে 'নো বিফ' লেখা... এসব হল সাইনবোর্ডওয়ালা হোটেলের নাম। আর যেগুলোর সাইনবোর্ড নেই, সেই সব হোটেলের জনপ্রিয়তাও দেখবার মতো। হোটেল মালিকের নাম আর খাবারের ওপর আস্থা রেখে হালতু'র বাসিন্দা কাকদ্বীপে (Kakdwip) মোটার হোটেলে খেতে গেছেন– এটা নিছক গল্প কথা নয়। ১২৫ টাকার থালিতে মাছের মাথা দিয়ে পুঁই শাকের ছ্যাচড়া (Food Blog: two unique bengali village recipes)। তবে ওই টাকায় ইলিশের মাথা দিতে পারেন না মোটাদা। মাঝারি সাইজের কাতলার মাথা দিয়ে বানানো হয় সেই আঙুল চেটে খাওয়া পদটি।
উত্তর চব্বিশ পরগণার মসলন্দপুরে সাইনবোর্ডবিহীন শঙ্করের ভাতের হোটেলে বসে যিনি গুলে মাছের ঝাল খাননি, তিনি আসলেই হতভাগ্য। গুলে মাছ এমনিতেই খুব দামি মাছ। কিন্তু খুব কাছ দিয়ে ইছামতি নদী বয়ে গেলে এবং গুলে মাছের প্রচুর যোগান থাকলে শঙ্কর কী করে তার কাস্টমারদের গুলের ঝাল না খাইয়ে থাকতে পারে! তবে গুলে বা ডিমভরা পার্শে কিম্বা গোঁফওয়ালা টাটকা তোপসে খেতে চাইলে শীতকালে কোনও একটা দিনে হঠাৎ করে বনগাঁ লোকালে চেপে বসতে হবে। বাজারের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর। চারটে বেঞ্চি পাতা । প্লাস্টিকের টুল। শঙ্করের হোটেলের সুনাম এলাকা ছাড়িয়ে অনেক দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ার কারণে টুল ফাঁকা পাওয়া মুশকিল।
ক্যানিং-এর বাসিন্দা মাছবিক্রেতা ভারতীর কাছে শুনলাম তালদি'র পরে একটা নতুন স্টেশন হয়েছে, নাম মাতলা হল্ট। ভারতী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে স্টেশনের কাছে খাবারের দোকান দিলে না কি খুব চলে! তার ছোট জা খুব ভালো রান্না করে। সে একটা ভাতের হোটেল দিলে না কি রমরম করে চলবে! নতুন যে স্টেশনটা হল, ওখানে একটা দোকান দিতে না পারার আক্ষেপ ভারতীর চোখে মুখে লেগে থাকে। গ্রামের মানুষজন কেন নিজের বাড়িতে না খেয়ে পয়সা খরচ করে ভারতীর জায়ের হোটেলে খেতে যাবে– আমার এই বিরক্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বেশ রেগে যায় ভারতী। বলে "পৃথিবীর সবার রান্না ভালো এ কথা তুমি বিশ্বাস কর? বৌয়ের রান্না মনে ধরে না ব'লে কত ব্যাটাছেলে হোটেলে গিয়ে দু'বেলা পেট ভরে খেয়ে আসে জানো? খুঁত ধরা ব্যাটাছেলেগুলোর জন্যই হোটেল আর খাবারের দোকানের এত্ত বাড়বাড়ন্ত ! আমার জা সামান্য কচুর শাক, কচুর লতি এমনভাবে রান্ধে যে পোতিবেশীরাও ছেলেমেয়ের হাতে বাটি ধরিয়ে পাঠিয়ে দেয়। বলে, যা ছোট্কাকির কাছ থেকে একটুন্ তরকারি চেয়ে আন্।"
বুঝলাম যেকোনও কারণেই ভারতীর সঙ্গে তার ছোট জায়ের সম্পর্ক বড় মধুর। জান লড়িয়ে দেওয়ার মতো সম্পর্ক। আমি ভারতীকে খুশি করার জন্য বললাম তোমার জা তাহলে খুব গুণী মানুষ!
"গুণী বলে গুণী! দুটো পাশ দেওয়া মেয়ে। ওর সেলাই দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সুঁই সুতো দিয়ে ছবি আঁকে মেয়েটা! কাপড়ের ওপর সুতো দিয়ে কত যে ছড়া বোনে! মা মরা মেয়েটার খুব ভালো ঘরে বিয়ে হতে পারত! ভাইরা গ্রাহ্যি করেনি। মেয়েটার একটা পা একটু ছোট। টেনে টেনে হাঁটে। শুধু ওই খুঁতটুকুনির জন্য যেমন-তেমন একটা বিয়ে হল। আমার ছোট দেওর গ্রামের টাটকা শাকসবজি কলকাতার বড় বড় মলে সাপ্লাই দেয়। রোজগার ভালোই করে। কিন্তু রাখতে পারে না। কিসের পেছনে যে টাকা ঢালে ভগমান জানে! কোথায় যায়! কার সাতে মেশে! কোনও মেয়েমানুষের খপ্পরে পড়েছে কি না এসব জানার জন্যে ওর পেছনে একটা লোক লাগিয়েছিলাম।"
– 'বল কী! ডিটেকটিভ লাগিয়েছিলে? কত খরচা পড়েছিল?' ভারতীর রাগ ভাঙানো খুবই সহজ। টুক করে সব রাগ গলে জল হয়ে গেল ।
"আরে ওসব নয়। আমার চেনা মানুষ। মানুষটা ভালো। বিশ্বাস করা যায়।" ভারতী বলেই চলে…
দেওর ব্যাকফুটে চলে যায়, মুখ্য হয়ে ওঠে চেনা মানুষটা।
ভারতী বলে চলে "মানুষটা আমার লেগে নিজের সব কাজকম্ম ফেলে থুয়ে হন্যে হয়ে দেওরের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। শুদু আমি বলেছি বলে! ওই মানুষটার উপরে আমি চোখ বুজে ভরসা করতে পারি।"
বুঝতে পারলাম এটা ট্রু লাভ। কিন্তু ওকে না থামালে আমার কইমাছ কটা বেছে দেবে কখন!
বললাম তোমার 'চেনা' এবং 'ভালো' মানুষটা কিছু হদিশ দিতে পেরেছে?
ঠোঁট ব্যাঁকালো ভারতী। "উঁহু! দেওর গভীর জলের মাছ। অত সহজে ধরা দেবে না। তবে আমিও ছাড়ব না। নিতাইকে বলেছি তুমি আরেকবার খোঁজখবর করো। দরকার হলে এক দু ঘা দিতে হবে।"
এতক্ষণে ভারতীর 'চেনা' এবং 'ভালো' মানুষটার নাম নিতাই, সেটা জানতে পারা গেল।
"নিতাই বলেছে ইস্টিশানের কাছে একটা জায়গা দেখবে। মাতলা হল্টে জায়গা না পেলে ঘোলা বা তালদিতে একটা জায়গার ব্যবস্থা করে দেবে। আমিও জাকে বলেছি একবার ব্যবসাটা শুরু কর– তোমার যা রান্নার হাত দূর দূর থেকে লোক এসে খেয়ে যাবে। আমার জায়ের হাতের আঙুলে অন্নপূর্ণার বাস। সে যা রাঁধবে, লোকে এসে পয়সা দিয়ে খেয়ে যাবে।"
আপনারা কখনো যদি দক্ষিণের দিকে কোনও একটা স্টেশনসংলগ্ন রাস্তায় 'শান্তির হোটেল' নামে ভাতের হোটেল দেখতে পান, জানবেন ওটাই ভারতীর ছোট জায়ের হোটেল। ভারতী়র ছোট জা শান্তি মন্ডল। কী করে নিশ্চিত হবেন? দেখবেন ঝুপড়ির দেওয়ালে তার সূচসুতোর কাজ ফ্রেমবন্দি হয়ে ঝুলছে, সাদা কাপড়ের ওপরে সবুজ আর বাদামি রঙের সুতো দিয়ে লেখা চারটে লাইন–
এই সংসার মরুময়
কেহ কাহারও নয়।
একমাত্র পথের দেখা
দু ' দিনের পরিচয়।
আজ ভারতীর ছোট জায়ের কাছ থেকে শেখা অনবদ্য দুটো সহজ এবং সুস্বাদু রেসিপি রইল।
রসুন লঙ্কা দিয়ে কচুর লতি
উপকরণ: কচুর লতি আঁশ ছাড়িয়ে আঙুলের সমান মাপে টুকরো করে কাটা একবাটি, শুকনোলঙ্কা, গোটা কালো সর্ষে, রসুনবাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা, নুন, চিনি, হলুদ গুঁড়ো, সর্ষের তেল, এক চামচ আমতেল।
প্রণালী: গরম জলে নুন দিয়ে ওর মধ্যে কিছুক্ষণ লতি ভিজিয়ে রাখতে হবে। তাহলে গলা চুলকাবে না। জল থেকে তুলে ভাপিয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে।
এবার কড়াইতে সর্ষের তেল দিয়ে সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে। তারপর অনেকটা রসুনবাটা দিতে হবে। এক চা চামচ কাঁচালঙ্কা বাটা, হলুদ গুঁড়ো দিয়ে মশলাগুলো একটু ভেজেই লতিগুলো দিয়ে দিতে হবে। মশলা ভাজার সময় আঁচ একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে একটু ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। ঢাকা খুলে নুন-মিষ্টি দিতে হবে। আবার ভালো করে নেড়েচেড়ে ঢাকা দিয়ে গ্যাস অফ করে দিতে হবে। নামানোর আগে এক চা চামচ আমতেল ছড়িয়ে দিন। খেয়ে কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না ।
কচুপাতাবাটায় চিংড়ি
উপকরণ: কচুপাতা (কচুপাতা বা কচুর লতি, ডাঁটা খেলে অনেকের গলা চুলকায়। কচুগাছের গোড়ায় জল জমে থাকলে সেই গাছের পাতা, লতি, কচু খেলে গলা চুলকোবেই। শুকনো জায়গায় হওয়া গাছের পাতা বা লতি বা ডাঁটা খেলে গলা একটুও চুলকোবে না।), আধ চা চামচ পাতিলেবুর রস, কালো সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা-নারকেল বাটা– সব মিলিয়ে ২ টেবিল চামচ, নুন, হলুদ গুঁড়ো, সর্ষের তেল, কিছুটা কুচো চিংড়ি।
প্রণালী: এক চিমটি নুন দিয়ে কালো সর্ষে , পোস্ত, নারকেল,কাঁচালঙ্কা সব একসঙ্গে বেটে নিতে হবে।
এবার একটা কড়াইতে জল আর আধ চা চামচ লেবুর রস দিয়ে কচুপাতাগুলোকে ভাপিয়ে নিতে হবে। তারপর জল ঝরিয়ে শিলে পিষে নিতে হবে।
এবার আবার গ্যাসে কড়াই বসান। বেশ খানিকটা সর্ষের তেল দিন। তেল গরম হলে নুন হলুদ মাখানো চিংড়িমাছগুলো হালকা করে ভেজে নিয়ে একটা বাটিতে তুলে রাখুন। ওই তেলেই কচুপাতা বাটা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাড়ুন। তারপর সর্ষে পোস্ত নারকেল আর কাঁচালঙ্কা বাটার মিশ্রণটা দিয়ে দিন। আবার বেশ করে নাড়ুন। নুন দিন। নারকেল ব্যবহার করা হয়েছে বলে আলাদা করে মিষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এবার তুলে রাখা চিংড়িগুলো দিয়ে নাড়ুন । একটু শুকনো শুকনো হয়ে এলে শাক চিংড়ির ওপরে এক চামচ কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে গ্যাস অফ করে দিন। তারপর থালায় গরম ভাত নিয়ে বসে পড়ুন।