
বাংলার হেঁশেল- উৎসবের দিনের বাহারি পদ
সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু
পুজো আসছে। করোনার ভয় কাটিয়ে মানুষজন আশায় বুক বাঁধছেন। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গাপুজো। ধর্ম ছাপিয়ে উৎসবের আনন্দ প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে দুর্গাপুজোয়। দূরদূরান্তে চাকরি করা মানুষরা এই উৎসবে বাড়ি ফেরেন। দেশের বাড়ি। বছরে হয়ত একবারই। কিন্তু ফেরেন। ব্যবসাপত্তর হৈহৈ করে এগিয়ে চলে। বড় বড় শপিংমল আর ফুটপাতের ছোটো ছোটো দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে।
যাঁর যেমন বাজেট তিনি তেমন দোকান খুঁজে নিয়ে কেনাকাটা করেন। ফুটপাতে বড় পলিথিনের ওপর দামি ব্র্যান্ডের নকশা আঁকা নকল সস্তার জামাকাপড়, ব্যাগকে ঘিরে মানুষের চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পায় আগমনীকে ঘিরেই। বাবুবাগানের বস্তির ছুটকি আর বালিগঞ্জ প্লেসের উঠতি মডেল রুমেলার কুর্তির একইরকম প্রিন্ট। মেটেরিয়ালস যদিও আলাদা।
এই সময়েই পুজোর প্যান্ডেল তৈরির জন্য হরেকরকম জিনিসপত্র ফাঁকা মাঠে জড়ো হয়। গ্রামের কারিগররা কাজের বরাত পান। চুটিয়ে কাজ করে বছরকার সংসার চালানোর খরচ তুলে নিয়ে যান শহর থেকে।
উৎসব মানেই রাশি রাশি উপহার।
আত্মীয়স্বজনের ভেতরে পুজোর উপহার দেওয়া নেওয়ার মধ্যে যে আন্তরিকতা এতদিন ধরে লক্ষ্য করা যেত, সেই আন্তরিকতায় মনে হয় ভাটা পড়েছে! কে কাকে কেমন দামের জিনিস দিল এবং তার পরিবর্তে কী পাওয়া গেল… এই তুল্যমূল্য বিচারে উৎসবের নির্মল আনন্দটিই মাটি হবার জোগাড়। এই গ্লানি থেকে মুক্ত হবার জন্যে অনেকে জামাকাপড়ের পরিবর্তে টাকা দেওয়া শুরু করেছেন। “নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে নিও”—– কথাটা যেন অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে দুপক্ষকেই। কিন্তু সেখানেও টাকার পরিমাণ দুপক্ষকেই অস্বস্তিতে ফেলেছে। একপক্ষ একরকম অ্যামাউন্ট দিলে অন্যপক্ষকে কী একটু বেশি দিতে হবে! এই চিন্তা শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। কম তো দেওয়াই যাবে না। কিন্তু সমান সমান দিলে তো উপহার শব্দের ম্যাজিকটাই নষ্ট হয়ে যায়! শোধবোধ, দেওয়া-নেওয়া কথাগুলো তো উৎসবের থেকে বহুদূরে। খুশিতে দেওয়া আর পেয়ে খুশি হওয়াই তো উৎসবের চরিত্র। উৎসবের সেই চরিত্রে কালিমা লেগেছে কী না কে জানে!
তবে উৎসবের খাওয়াদাওয়াতে একটুও মলিনতা লাগতে দেন না কেউই। আর্থিক কষ্ট বা আরও নানান অসুবিধে থাকলেও পুজোর কটা দিন সকলেই একটু ভালোমন্দ খাবার পছন্দ করেন। কেউ কেউ পুজোর দিনগুলোতে রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে আগ্রহী হন। রান্নাবান্নার একঘেয়েমি থেকে অনেক গৃহিণীর মুক্তি ঘটে ওই কটা দিনে। একটু সাজগোজ করে আশেপাশের ঠাকুরমণ্ডপগুলো ঘুরে আসেন। পুজোসংখ্যা পড়েন। ফেসবুকে ছোটোবেলার পুজোর স্মৃতি নিয়ে লেখেন।খাওয়াদাওয়া এমনই একটা বিষয় যে তাকে কোনো গণ্ডিতে আটকে রাখা যায় না। কেউ কেউ হিন্দুর খাবার, মুসলমানের খাবার… ইত্যাদি তকমা দিয়েও তেমন কিছু সুবিধে করতে পারে নি। কারণ স্বাদকোরকগুলো এমন বজ্জাত যে কী বলব! তার সবকিছুরই স্বাদ নেওয়া চাই। দেশি-বিদেশি, আমাদের-ওদের, বৈধ-অবৈধ… সব ধরণের খাদ্যদ্রব্যের প্রতিই মানুষের ভীষণ টান। এই টানে ম’জে হিন্দুর রেসিপি অহিন্দুর কড়াইতে গিয়ে তাহেলকা মাচায়। মুসলিম বাড়িতে শুক্তো, লাবড়া, ধোকার ডালনা, কইমাছের হরগৌরী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর মুসলিমদের সিমুই, চালের আটার রুটি, ভুনা গোস্ত, তেহারির জন্য অমুসলিমরা ইউটিউব চ্যানেলগুলোর ওপর হন্যে হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই যে আমি হিন্দু আর মুসলিম কথাটা বারেবারে উল্লেখ করছি, আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু মানুষজন তো এমনই ভাবেন। তবে বেশিরভাগ মানুষ এমনটা ভাবেন না। এটাই স্বস্তির। বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে ভেতরকার দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে আলাদা আলাদা ধর্মের মানুষগুলোকে কাছাকাছি আনে। রেসিপি আদানপ্রদানের ফলে লুচি, ছোলার ডাল, ফুলকপির তরকারি আর সিমুইয়ের পায়েসে অষ্টমীর দুপুর জমে ওঠে। সিমুই নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষানিরীক্ষা চলে। পায়েসের মত থকথকে নাকি দম দেওয়া ঝরঝরে সিমুই হবে! সিমুইতে নারকেল কুচি দেওয়া হবে নাকি ড্রাই ফ্রুট! খেজুর কুচিয়েও তো দেওয়া যেতে পারে!
নবমীর দুপুরে তেহারি রান্না হলে রাতে চালের আটার রুটি আর চিকেন ভুনা।
কলকাতার অনেক আবাসনের বাসিন্দারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। চারদিন প্যান্ডেলে পাত পেড়ে ভালোমন্দ খাওয়া চলে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই কটা দিন আনন্দে মেতে ওঠেন। ধর্মকে ছাপিয়ে উৎসব জিতে যায়।
আজ থাকল উৎসবের আগাম রেসিপি…
চালের আটার রুটি
উপকরণ: দেড় কাপ কাপ চালের গুঁড়ি, ২ কাপ জল, এক চিমটে নুন।প্রণালী: চালের আটা মাখা বেশ ঝকমারি ব্যাপার। একটা কড়াইতে দু’কাপ জল গরম করতে দিন। জলে নুন দিন। জল ফুটে উঠলে চালের আটাগুলো গরমজলে ঢেলে দিন। কাদা কাদা হবে না কিন্তু! ঝুরো ঝুরো হবে। ভালো করে খুন্তি দিয়ে মিনিট দুয়েক নাড়ুন। আটার রংটা একটু চেঞ্জ হলে নামিয়ে ঠান্ডা হতে দিন। হালকা গরম থাকা অবস্থাতেই ভালো করে মাখুন। জল দেওয়ার প্রয়োজন হলে গরম জল দেবেন। আর যদি আটা দেওয়ার প্রয়োজন হয়,তাহলে অল্প ময়দা মিশিয়ে নেবেন।
লেচি বানিয়ে রুটির মতন বেলে নিয়ে চাটুতে সেঁকে নিন। খুব তুলতুলে হয় এই রুটি।চিকেন ভুনা
চালের আটার রুটির সঙ্গে ভুনা মাংস একেবারে পারফেক্ট কম্বিনেশন।
উপকরণ: ৫০০ গ্রাম বোনলেস চিকেন, ১০০ গ্রাম টকদই, ঘিয়ে ভাজা পেঁয়াজ আদা রসুনবাটা, হলুদ গুঁড়ো, শুকনো লংকার গুঁড়ো, রোস্টেড বেসন ১ টেবিল চামচ, নুন, চিনি, গরম মশলার গুঁড়ো, রোস্টেড জায়ফল জয়িত্রির গুঁড়ো, সাদা তেল, ১ চা চামচ কাঁচালংকা কুচি।প্রণালী: বোনলেস চিকেনগুলোতে ভিনিগার মাখিয়ে দুঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তারপর কড়াইয়ে সাদা তেল গরম করে চিকেনগুলোকে একটু ভাজা ভাজা করে নিতে হবে। এর মধ্যে খুন্তি দিয়ে চিকেনগুলোকে ছিঁড়ে কুচি কুচি করতে হবে। চিকেনে হলুদ গুঁড়ো, লংকার গুঁড়ো দিতে হবে। ঘিয়ে ভাজা পেঁয়াজ আদা রসুন বাটা দিয়ে কষে অল্প গরম জল দিতে হবে। আঁচ কমিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর ফ্যাটানো টকদই, নুন, মিষ্টি দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। তাওয়ায় সেঁকে নেওয়া এক টেবিল চামচ শুকনো বেসন দিয়ে দিতে হবে। বেশ থকথকে হয়ে এলে রোস্টেড জায়ফল জয়িত্রীর গুঁড়ো আর গরম মশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতে হবে। নামানোর আগে কাঁচালংকা কুচি দিতে হবে।
চিকেন তেহারি
উপকরণ: ৫০০ গ্রাম চাল ধরে এমন একটা বাটির এক বাটি গোবিন্দভোগ চাল, সাড়ে সাতশো গ্রাম চিকেন, আলুর দমের সাইজের ছোট ছোট আলু সেদ্ধ ১০টা, ঝিরি ঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ ৩টে, ১ চা চামচ আদা বাটা, ১ চা চামচ রসুন বাটা, এক টেবিল চামচ কাঁচা লংকা বাটা, আধ চা চামচ গোলমরিচের গুঁড়ো, নুন, চিনি, আস্ত কাঁচা লংকা ১০ টা, ১০০ গ্রাম টক দই, গরম মশলার গুঁড়ো ১ চা চামচ, গোটা গরম মশলা (৫টা ছোটো এলাচ, ২টো দারচিনির কাঠি, ৫টা লবঙ্গ) তেজপাতা ২ টো, সাদা তেল পরিমাণমত, ঘি ১ টেবিল চামচ, চালের বাটিটার মাপে দেড় বাটি গরম জল, ওই বাটিরই মাপে আধবাটি চিকেনের গ্রেভি।প্রণালী: প্রথমে একটা কড়াইতে সাদা তেল গরম করে ঝিরি ঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ হালকা ব্রাউন করে নেবেন। তারপর ওতে আদা-রসুনবাটা, কাঁচা লংকাবাটা, গোলমরিচের গুঁড়ো দেবেন। এবার টক দই দিয়ে মশলাটা খুব ভালো করে কষবেন। চিকেন দিয়ে ভালো করে নেড়ে ঢেকে দিন। কিছুক্ষণ পরে ঢাকা তুলে একটু গরম জল দিন। সেদ্ধ আলুগুলো এই সময়ে দিয়ে দিন। নুন, একটু চিনি দিয়ে আবার ঢেকে দিন। চিকেন সেদ্ধ হয়ে গেলে এবং গ্রেভি হাফ বাটি মত থাকলে গরম মশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে গ্যাস অফ করে দিন।
এবার একটা ডেকচিতে ঘি গরম করুন। গোটা গরম মশলা আর তেজপাতা দিন। মশলার সুগন্ধ বেরোলে ধুয়ে রাখা গোবিন্দভোগ চালগুলো দিয়ে বেশ করে নাড়ুন। দেড় বাটি গরম জল দিয়ে গ্যাস কমিয়ে ঢাকা দিন। কিছুক্ষণ পর দেখবেন আধসেদ্ধ চালের মধ্যে গর্ত গর্ত হয়ে গেছে। এইসময় একটু নুন, মিষ্টি দিন। বেশি নুন বা চিনি দেবেন না। কারণ মাংসে পরিমাণমত নুন-চিনি দেওয়া আছে। এবার ঝোলসমেত চিকেন আলু সব পোলাওয়ের ডেকচিতে ঢেলে দিয়ে হালকা হাতে মিশিয়ে দিন। গ্যাসে তাওয়া গরম করে আঁচ সিমে রেখে পোলাওয়ের ডেকচিটা তাওয়ার ওপর বসিয়ে ঢাকনা এঁটে মিনিট ২৫ দমে রাখুন। মাঝে আর একবার ঢাকা খুলে হালকা হাতে নেড়েচেড়ে আস্ত কাঁচা লংকাগুলো ভাতের মধ্যে একটা একটা করে গুঁজে দিন। দম হয়ে গেলে ঢাকা অবস্থাতে আরও মিনিট ১৫ রেখে তারপর সার্ভ করুন।
লেখিকা পেশায় স্কুলশিক্ষিকা, ভালোবাসেন রকমারি রান্না আর রন্ধনবিষয়ক আড্ডা।