
এক্সারসাইজ, ডায়েট, রুটিন: হার্ট ভাল রাখার মূল মন্ত্র এই তিনটিই
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
লাইফস্টাইল মডিফিকেশন। আধুনিক সময়ের চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে এই শব্দবন্ধ। সভ্যতা যত আধুনিক হচ্ছে, ব্যস্ততা যত বাড়ছে, ততই যেন বদলে যাচ্ছে জীবনযাপনের ধরন। আর তা মোটেই সুবিধের হচ্ছে না শরীরের জন্য। হার্টের অসুখও তার ব্যতিক্রম নয়। এখনকার দিনের বড় সমস্যা, দ্রুত হার্টের ক্ষয়, তা রুখতে তাই ভরসা সেই লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্টই। আর সেই ম্যানেজমেন্ট শুরু করার জন্য যদি আপনি অপেক্ষা করেন সমস্যা দেখা দেওয়ার জন্য, তবে তা সামাল দেওয়া কঠিন। শরীরচর্চা থেকে ডায়েটপ্ল্যান– সবটাই শুরু করতে হবে আজই। ছাড়তে হবে সিগারেটের মতো বদভ্যাস। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে কোলেস্টেরল, সুগারের মতো শত্রুকে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে হার্টের, নিয়মিত। এই নিয়েই বিস্তারিত আলোচনায় অ্যাপোলো গ্লেনেগলস হাসপাতালের সিনিয়ার কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, ডক্টর ও অধ্যাপক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
শখে নয়, নিয়মে হোক শরীরচর্চা
শরীরচর্চা করার আগে কয়েকটা বিষয় বুঝে নিতে হবে। কী এক্সারসাইজ করব, কতক্ষণ ধরে করব, রোজই করব কিনা, কত তীব্রতায় করব– এই বিষয়গুলি অনেকের কাছেই স্পষ্ট থাকে না।
প্রথমত, এক্সারসাইজ তিন রকমের হয়। কার্ডিও, স্ট্রেংথ অ্যান্ড পাওয়ার, স্ট্রেচিং। এখন হার্ট ভাল রাখার জন্য কার্ডিও এক্সারসাইজ জরুরি। তা হাঁটা বা দৌড়নো হতে পারে, কেউ ব্যাডমিন্টন খেলতে পারেন, সাইকেল চালাতে পারেন, সাঁতার কাটতে পারেন।
যে যাই করুন, চেষ্টা করা উচিত রোজ অন্তত আধ ঘণ্টা এক্সারসাইজ করা উচিত। এর বেশিও করতে পারেন কেউ ভাল লাগলে। সময়ের অভাব হলে সকাল ও বিকেল দু’বেলা মিলিয়েও করা যেতে পারে। প্রতিদিনই করা ভাল, না হলে সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন করা উচিত শরীরচর্চা।
সবার জন্য একই এক্সারসাইজ নয়
সাধারণ বুদ্ধিতে, একটি ২০ বছরের ছেলে হার্ট ভাল রাখার জন্য যা এক্সারসাইজ করবে, ৭০ বছরের বৃদ্ধ তা করবেন না। ৭০ বছরের বৃদ্ধকে কেবল হাঁটার কথাই বলবেন চিকিৎসক। কিন্তু ২০ বছরের ছেলেটিকে দাপিয়ে খেলাধুলো করতে হবে। কে কোনটা করবেন, তা নির্ভর করছে বয়স, শারীরিক সক্ষমতার ওপর। চল্লিশ বছরের মানুষটি যদি কোনও দিন কিছু না করে হঠাৎ করেই একদিন ছুটতে শুরু করেন, তাঁর সমস্যা হতে পারে।
এছাড়া মাথায় রাখতে হবে, কার কী অসুখ আছে সেটাও। কারও পায়ে আর্থ্রাইটিস থাকলে তাঁকে দৌড়তে বলা বিপদ। আরও ড্যামেজ বাড়বে। কারও আবার ব্লাডপ্রেশার বেশি হলে, খুব বেশি পাওয়ার এক্সারসাইজ করা যাবে না।
সময় বার করে দ্রুত পাম্প করান হার্টকে
এর পাশাপাশি, কে কোন কাজ করছেন, তাও জরুরি। যিনি সারাদিন চেয়ারে বসে কাজ করছেন, তাঁকে আলাদা সময় বার করে ফুসফুস পাম্প করাতে হবে। যিনি সারাদিন রান্নাবান্না করছেন, তিনি সময় বার করে নিজের সুবিধামতো কিছু করবেন।
এবার কে কতটা তীব্রতায় এক্সারসাইজ করবেন, সেটা ঠিক করা মুশকিল। চিকিৎসকরা সাধারণত ব্রিস্ক ওয়াক বা একটু জোরে হাঁটার কথা বলেন। একটু ঘাম হবে, পাল্স রেট বাড়বে, হার্ট একটু দ্রুত পাম্প হবে। এটুকু জোরে হাঁটতেই হবে। সর্বোপরি, এক্সারসাইজ করার পরে ফিট লাগছে কিনা, সারাদিন ঝরঝরে লাগছে কিনা, সেটা বোঝা খুব জরুরি। কেউ যদি খুব বেশি টায়ার্ড হয়ে পড়েন, তবে তিনি হয়তো একটু বেশি এক্সারসাইজ করে ফেলছেন।
খাওয়াদাওয়ার ভারসাম্য খুব জরুরি
আমাদের ভারতীয় জলবায়ুতে, সাধারণ ও সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে ৫০ শতাংশ শর্করা, ৩০ শতাংশ প্রোটিন, ২০ শতাংশ ফ্যাট থাকতে পারে। তবে এটা একেবারেই সুস্থ ও স্বাভাবিক মাপকাঠি থাকা মানুষের জন্য। প্রয়োজন মতো ডায়েট মডিফাই করা যেতে পারে, শর্করা কমিয়ে বা প্রোটিন বাড়িয়ে।
এখন, কোন খাবারে কত শতাংশ কী আছে, কত ক্যালরি আছে, তা বোঝার উপায় কী। সাধারণ ভাবে বললে, আমাদের যা স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, ভাত, রুটি, ডাল, সব্জি, ডিম, মাছ, মাংস, ফলমূল, দুধ– সব মিলিয়েই খেতে হবে খাবার। এখন প্রোটিনের জন্য কাউকে যদি রোজ মাংস খেতে বলা হয়, তবে তা প্রতিটি মানুষের জন্য বলা হল না। সকলে হয়তো অ্যাফোর্ড করতে পারবেন না।
তাই চিকিৎসক জানাচ্ছেন, ডাল রোজ খাওয়া ভাল, যা থেকে প্রোটিনের চাহিদা মিটতে পারে। খেতে হবে সবুজ শাকসব্জি। ফাইবার, মিনারেলস, ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করবে সেগুলিই। ভাত-রুটিতে শর্করার চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে। এর সঙ্গে যদি একটা করে আমিষ পদ কিছু খাওয়া যায়, মাছ সবচেয়ে ভাল, চিকেনও খাওয়া যেতে পারে। অন্তত একটা ডিম, তবে তা শরীরের জন্য ভাল। ভেজ খেতে চাইলে দুধ বা ছানা খাওয়া যায়।
মিষ্টি না খাওয়াই ভাল
মিষ্টিটা এড়িয়ে যাওয়ারই পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসক। ‘কলকাতার রসগোল্লা’ যতই প্রিয় হোক, বাঙালি যতই মিষ্টিপ্রেমী হোন না কেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই আবেগগুলোয় খুব বেশি ভেসে না যাওয়াই ভাল। চিনি খাওয়া বন্ধ করার অভ্যেস করতে শুরু করলে, কয়েক দিন পরে আর তা খারাপ লাগবে না।
তবে সমস্ত শর্করাই যে খুব খারাপ তা নয়। চিনি বা চিনির মতো সিম্পল সুগার খুবই খারাপ। কিন্তু যেগুলো কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, যা বিভিন্ন ফলে থাকে, সব্জিতে থাকে, সেগুলো কিন্তু খেতে হবে। ডায়েটে খুব জরুরি রান্নার পদ্ধতিও। যেমন একটি মাছকে বেক করে খাওয়া খুব ভাল। কিন্তু তাকে তেলে কড়কড়ে করে ভাজলেই সব গুণ নষ্ট। উপরন্তু তা ক্ষতিকর হয়ে যায়। মাংসকে প্রসেসড অবস্থায় খেলেও সেই একই বিপদ শরীরে।
দোকানের ভাজা তেল নাই বা খেলেন
আবার ফ্যাটের ক্ষেত্রেও স্যাচুরেটেড ফ্যাট যতটা ক্ষতিকর, আনস্যাচুরেটেড ততটা নয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাটও শরীরে দরকার, তাই চিকিৎসকরা অনেক সময়েই এক চামচ করে ঘি খেতে বলেন সকলকে। তবে যেটা ট্রান্সফ্যাট, দোকানের ভাজাভুজি খাবারে থাকে, তা কিন্তু, হার্টের জন্য ও সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই খারাপ। আবার এক চামচ কাঁচা সর্ষের তেল যতটা খারাপ, এক চামচ ডালডা তার চেয়ে কয়েক গুণ খারাপ। সব মিলিয়ে তেল বা তেলজাতীয় খাবার একেবারে মেপে খাওয়াই ভাল। বাড়ির রান্নায় নানা রকমের তেল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর সবশেষে অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে নুন। কাঁচা নুন তো বটেই, রান্নাতেও যত কম নুন ব্যবহার করা যায়, তত ভাল। নুন বেশি খেলে রক্তচাপ বাড়ার সম্ভাবনা বাড়ে, যা হার্টের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ।
নির্দিষ্ট স্লিপিং প্যাটার্ন খুবই জরুরি
শরীর ভাল রাখার জন্য, হার্ট সুস্থ রাখার জন্য ঘুম অবশ্যই জরুরি। সেখানে খেয়াল রাখতে হবে, স্লিপ প্যাটার্ন মেনটেন করা যাচ্ছে কিনা। মানুষের ঘুম দু’রকম হয়। গভীর আর অগভীর। যাঁদের ঘুম গভীর নয়, তাঁদের রক্তচাপ বাড়ার ঝুঁকি থাকে, হরমোনের গন্ডগোলও হয়। যাঁদের ঘুম গভীর, তাঁরা ৬ ঘণ্টা ঘুমোলেও সমস্যা মিটে যায়। চিকিৎসকরা সাধারণত বলেন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা নিয়মিত ঘুম শরীরের জন্য সবচেয়ে ভাল। আবার ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমোলে আবার অনেক সময় অন্য নানা সমস্যা হয়। তা খুব স্বাভাবিক নয়।
তবে কখন ঘুমোতে যাচ্ছেন, সেটা খুব জরুরি। প্রতিটি মানুষ ছোট থেকে রাতে ঘুমোনো ও সকালে ওঠার সাইকেলে অভ্যস্ত হন। কিন্তু পরবর্তী কালে অনেকেরই রাতে বেশিক্ষণ জাগার অভ্যেস বেড়ে যায়। এখনকার সময়ের একটা বড় অংশের মানুষ রাত ১-২টো পর্যন্ত জাগেন, সকালে বেলায় ওঠেন। এটা শরীরের জন্য খারাপ, হজমও ভাল হয় না। ঘুমেও সমস্যা বাড়ে। রাত ১২টার পরে আর না জাগাই ভাল। আর যখন ঘুমোচ্ছেন, তার ২-৩ ঘণ্টা আগে খাবার খেয়ে নেওয়াই ভাল।
উদ্বেগ থাকবেই, স্পোর্টিংলি ফেস করুন
স্ট্রেস-ফ্রি জীবন হয় না। অসম্ভব একটা ব্যাপার। স্ট্রেস থাকবেই। সময় যত এগোবে, স্ট্রেস তত বাড়বে। স্ট্রেস কখনও কমানো যায় না। যেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা হল স্ট্রেসের প্রতি মানুষের অ্যাটিটিউড। এক একটি স্ট্রেসফুল ঘটনায় এক এক জন মানুষ এক এক রকম ভাবে রিঅ্যাক্ট করেন। সেটাই নির্ধারণ করে অনেক কিছু। একটি স্ট্রেসের প্রতি কে কীভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন, তার উপর নির্ভর করে হার্টের গতি, হরমোনের ক্ষরণ– এসব কিছু। সার্বিক ভাবে শরীরের সুস্থতা অনেকটাই ঠিক করে দেয় এই প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি।
কেউ স্ট্রেসের মুখে খাওয়া বন্ধ করে দেন, সিগারেট খেয়ে ফেলেন, এক্সারসাইজ বন্ধ করে দেন– এগুলো কিন্তু স্ট্রেস কমানোর বদলে উল্টে বাড়ায়, বরং আরও ক্ষতিও করে। কিন্তু কেউ যদি ভাবেন, ঠিক আছে, দেখা যাক কী হয়, স্পোর্টিংলি নেন বিষয়টাকে, তাহলে তাঁর শরীরের মাপকাঠিগুলি অনেকটাই ভাল থাকে।