সামাজিক দূরত্বে রুখবে মহামারী, আইসোলেশন-কোয়ারেন্টাইন ভীতি নয়, সুস্থ থাকার টিপস দিলেন বিশেষজ্ঞ
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
বিশ্বজোড়া মহামারীকে ঠেকাবার একটাই উপায়—দূরত্ব বজায় রাখা। এই দূরত্ব নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি, গুজব, কৌতুক তৈরি হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ এতদিনে গিয়ে এই দূরত্বের আসল মর্ম বুঝেছে। দূরত্ব মানে কী—পারস্
বিশ্বজোড়া মহামারীকে ঠেকাবার একটাই উপায়—দূরত্ব বজায় রাখা। এই দূরত্ব নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি, গুজব, কৌতুক তৈরি হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ এতদিনে গিয়ে এই দূরত্বের আসল মর্ম বুঝেছে। দূরত্ব মানে কী—পারস্পরিক দূরত্ব মানে শারীরিক ব্যবধান রেখে চলা, সামাজিক স্তরে দূরত্ব অর্থাৎ অবাধে মেলামেশা, আলিঙ্গন, হাত মেলানো আপাতত বন্ধ রাখা। আর গোষ্ঠী স্তরে দূরত্ব বলতে বিশাল কোনও জমায়েত, উৎসব-অনুষ্ঠানে বহু মানুষের ভিড় বন্ধ করা। যে মারণ ভাইরাস সংক্রামক বা মানুষের থেকে মানুষে ছড়াবার কৌশল শিখে গেছে, তাকে থামাতে গেলে এই দূরত্বের গুরুত্ব বুঝতে হবে মানুষকেই।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই সামাজিক দূরত্ব?
ভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে কতটা উপযোগী এই সামাজিক দূরত্ব (Social Distancing)
বিজ্ঞানীদের আগে ধারণা ছিল, বিটা করোনাভাইরাসের এই সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেন হাওয়ায় (অ্যারোসল) ছড়ায়। ভাইরাস এয়ার ড্রপলেটে ছড়াতে পারে এই বিষয়ে গবেষণার রিপোর্ট সামনে এনেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC), লস এঞ্জেলসের বিজ্ঞানীরা । কিন্তু পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানায়, করোনাভাইরাস এয়ারবোর্ন নয়। অর্থাৎ বাতাসে ভেসে ছড়ায় না।
যে কোনও ভাইরাসেরই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাহিত হওয়ার জন্য একটা আধার দরকার হয়। যাকে অবলম্বন করেই এরা ছড়িয়ে পড়তে পারে অথবা এক শরীর থেকে অন্য শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। এই মারণ ভাইরাসের বাহিত হওয়ার আধার হল মানুষের হাঁচি-কাশি-থুতু-লালা ইত্যাদি, যাকে বলে ‘রেসপিরেটারি ড্রপলেট’। এই রেসপিরেটারি ড্রপলেট এতটাই ভারী যে এটি বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারে না। মাটিতে বা কোনও সারফেসে জমে থাকে। কিন্তু যদি আক্রান্ত ব্যক্তির খুব কাছাকাছি কেউ থাকে (এক মিটারের কম দূরত্বে) তাহলে সেই ড্রপলেট সুস্থ ব্যক্তির শরীরের সংস্পর্শে এসে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়। আর এইভাবেই মানুষের থেকে মানুষে সংক্রমণ (Human to Human Transmission) ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই ভাইরাসকে মহামারী হওয়া থেকে আটকাতে সবচেয়ে আগে পারস্পরিক দূরত্ব বাড়াতে হবে।
আরও একটা গুরুত্ব আছে এই সামাজিক দূরত্বের। বিজ্ঞানীদের তথ্যেই জানা যাচ্ছে, এই ভাইরাস এমনভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে যাতে অনেক মানুষের শরীরেই প্রাথমিকভাবে উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। যার শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে অথচ বাইরে কোনও উপসর্গ নেই এমন লক্ষণহীন বাহকের থেকেই সামাজিক স্তরে (Community Transmission)সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। তাই পারস্পরিক দূরত্ব সবসময় এক মিটার রাখা উচিত।
এমনটা তো হতেই পারে, আপনার পাশের মানুষটিই ভাইরাসে আক্রান্ত, অথচ তাঁর শরীরে কোনও উপসর্গ নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে আপনারও শরীরে। তাই কোনও গুজব বা ভীতি নয়, শুধুমাত্র সতর্ক থেকে এই সামাজিক দূরত্বের বিধি মেনে চলা উচিত। যতদিন না আশঙ্কার মেঘ কাটছে, সচেতন থাকতেই হবে মানুষকে, বাঁচার ও সুস্থ থাকার এটাই আদর্শ উপায়।
উপসর্গ দেখা দিলেই কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক
কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে কেন? এই প্রশ্ন এখন অধিকাংশ মানুষেরই। এই কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া নিয়েই অনেক তর্ক-বিতর্ক, ভুল বোঝাবুঝি। আসলে এই কোয়ারেন্টাইন নিয়েও অনেক ভুল ধারণা আছে। মানুষকে বুঝতে হবে, কোয়ারেন্টাইন মানে জেলখানা নয়, নিজেকে আলাদা করে সুস্থ রাখার প্রয়াস। কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া মানে নিজেকে বাঁচানো তো বটেই, নিজের প্রিয়জনদেরও রোগ থেকে দূরে রাখা। কোভিড-১৯ সংক্রমণের যে উপসর্গের কথা হু বা ডাক্তারি জার্নালে লেখা হয়েছে, সেই সব উপসর্গ যেমন সর্তি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা অনেকের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া, বয়স্কদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া, ঘন ঘন শ্বাসের সমস্যা, ইত্যাদি দেখা দিলেই সবচেয়ে আগে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। দরকার হলে বাড়িতেই অথবা কোনও মেডিক্যাল সেন্টারে গিয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে।
এই পিরিয়ডে সবচেয়ে বেশি দরকার শারীরিক পরীক্ষা করানো। থুতু বা লালারসের নমুনা অথবা নাক-গলা থেকে নমুনা নিয়ে (Throat Swab) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করলেই ধরা পড়বে কোভিড-১৯ পজিটিভ কিনা। অনেক সময় উপসর্গ দেখা না দিলেও যদি কেউ করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে ফেরেন অথবা তেমন কোনও মানুষের সংস্পর্শে আসেন তাহলে বাধ্যতামূলকভাবেই ল্যাব-টেস্ট করানো দরকার। যতদিন না এই টেস্টের রিপোর্ট আসছে ততদিন নিজেকে কোয়ারেন্টাইনে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আইসোলেশনে ভীতি নয়, রোগ শুরুতে ধরা পড়লে সারানো সম্ভব
কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় সংক্রমণ ধরা পড়লে পরবর্তী পর্যায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা শুরু হয়। কোনও রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়লে তাকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হয়, আবার সংক্রমণ গোড়াতেই ধরা পড়লে তারও ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসায় দ্রুত কাজ দেয়। মৃদু সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেককেই হোম-আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা করা হয়। এই আইসোলেশনে রাখার অর্থ হল, রোগীর চিকিৎসা করা ও সংক্রমণ যাতে তার থেকে বাকিদের মধ্যে না ছড়ায় সেটা নজর রাখা।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সংক্রমণ যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, মানুষ যত বেশি সচেতন হবে এবং রোগ লুকিয়ে রাখার মানসিকতা কমবে, তত দ্রুত মারণ ভাইরাসকে ঠেকানো যাবে। বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সুস্থও হয়ে উঠছেন অনেকেই। তার জন্য চাই সচেতনতা।
আতঙ্কের লকডাউন নয়, মন ভাল রাখতে নতুন কিছু করুন
দীর্ঘদিন গৃহবন্দি মানেই একঘেয়েমি, ডিপ্রেশন। তার উপর টিভির পর্দায় নিত্যদিন নানা খবর শুনে আতঙ্ক। একে কাটানোর উপায় বার করতে হবে নিজেকেই। একাকীত্ব কাটাতে ঘরেই জমুক আড্ডা, তবে অবশ্যই দূরত্ব রেখে। ছবি আঁকা, বই পড়া, ইন্টারনেটে নতুন কোনও বিষয় জানা, এই সবের মধ্যেই নিজেদের পুরনো অবসর যাপনের দিনগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কাজের চাপে নিজেদের প্যাশন বা পছন্দের কাজ যাঁরা ভুলতে বসেছিলেন, সেসব ফের শুরু করে মনকে চাঙ্গা রাখা যেতে পারে। মন ভাল থাকলেই শরীর তরতাজা থাকবে, আর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও বাড়বে।
রুটিন বানিয়ে ফেলা যেতে পারে—সকাল থেকে রাত অবধি কী কী করণীয় তার একটা তালিকা বানানো যেতে পারে। দিনের শুরুটা হোক শরীরচর্চা দিয়ে। এই সময় সুস্থ থাকাটা খুবই দরকারি। হেলদি ডায়েট অবশ্যই। এখন রসন অল্প, তার মধ্যেই পুষ্টিকর খাবার রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে, পারলে ফলের রস থাকুক ডায়েটে। সিট্রাস ফুড বা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াটা দরকার এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। দিনের একবার অন্তত মেডিটেশন করার চেষ্টা করলে ভাল, এতে অবসাদ কমবে অনেকটাই।
সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব নয়, যোগাযোগ বাড়ুক—ফোন বা ভিডিও কলে পুরনো বন্ধুত্ব তরতাজা করে নেওয়া যায়। আত্মীয়-প্রতিবেশী যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না, তাদের খবর নেওয়া যেতে পারে। কে কী করছেন, পরের পরিকল্পনা কী সেই নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। আতঙ্ক বা গুজব নয়, নতুন নতুন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা ভাল, এতে মনও ভাল থাকবে, সম্পর্কও মজবুত হবে।
ইন্টারনেটে নতুন টপিক খুঁজুন— পছন্দের বিষয় খুঁজে নিন। অনেক নতুন কিছু জানার থাকে ইন্টারনেটে, সেই টপিক খুঁজে বার করতে হবে। যদি ছবি আঁকতে ভাল লাগে, তাহলে পেন্টিং-এর বিষয় পড়াশোনা করুন। পজিটিভ স্টোরি খোঁজার চেষ্টা করুন, যা অনুপ্রেরণা দেবে।
মন থাক সুখে—মনকে ঝকঝকে রাখতে ইতিবাচক রাস্তা খুঁজে নিতেই হবে। সব কিছুতে অসন্তোষ বা আতঙ্ক খুঁজলে হবে না। মন ভাল থাকে এমন কাজ করা উচিত। গল্পের বই পড়া, গাছের পরিচর্চা, কোনও ভাল জার্নাল ঘাঁটা, আর সবচেয়ে বড় উপায় হল আপনজনের সান্নিধ্য খুঁজে নেওয়া।