সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
অতিমহামারী আর আতঙ্ক একই কয়েনের দুটো পিঠ। মহামারী যখন আসে শুধু মৃত্যু নিয়ে আসে না, এক ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য বিপর্যয় শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনকেও তছনছ করে দেয়। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আতঙ্ক মানসিক স্থিতিতে বড় রক
অতিমহামারী আর আতঙ্ক একই কয়েনের দুটো পিঠ। মহামারী যখন আসে শুধু মৃত্যু নিয়ে আসে না, এক ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য বিপর্যয় শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনকেও তছনছ করে দেয়। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আতঙ্ক মানসিক স্থিতিতে বড় রকম ধাক্কা দেয়। টালমাটাল হয় যায় গতানুগতিক জীবন। ধরাবাঁধা রুটিন আচমকাই এলোমেলো হয়ে গেলে দিশাহারা হয়ে পড়ে মানুষ। তার স্বাভাবিক সত্তায় চোট লাগে। যার থেকেই তৈরি হয় মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, অসহিষ্ণুতা।
মানসিক অবসাদ শরীরের প্রতিরোধকেও দুর্বল করে দেয়। হরমোনের তারতম্য তৈরি হয়। মানুষ পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মানসিক সত্তার এই কঠিন পরিস্থিতিকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘Pandemic Fatigue’। অর্থাৎ অতিমহামারীর মুখোমুখি হয়ে যে প্রচণ্ড মানসিক দুর্বলতার শিকার হতে হয় মানুষকে। এই দুর্বলতা কীভাবে তৈরি হয়, অবসাদ কখন হানা দেয় এবং তার থেকে মুক্তির উপায় কী, মানসিক স্থিতির নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়েই। জিন অর্থাৎ ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) বিশ্লেষণ করে গবেষকরা মনের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছেন। ভাইরাসের মোকাবিলায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে হলে শুধু রক্তে অ্যান্টিবডি নয়, মনের জোর থাকাও দরকার। অত্যধিক চিন্তা, মানসিক চাপ, স্ট্রেস থেকে যে হরমোনের বৈষম্য তৈরি হয় তাও দুর্বল শরীরে একটা অন্যতম কারণ। আর করোনা তো এই ফাঁকই খোঁজে! শরীর দুর্বল মানেই জাঁকিয়ে বসবে ভাইরাস।
অসহিষ্ণু মন, অন্দরবাসে ক্লান্ত, সংক্রমণের গুরুত্ব বোঝে না
ছটফট করছে মানুষ। এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতা। খোলামেলা মুক্ত পরিবেশে অভ্যস্ত মন অন্দরবাসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। প্রকৃতি আর পরিবেশের সঙ্গে এই সংযোগ বিচ্ছিন্নতাই অতি ভয়ঙ্কর অবসাদের জন্ম দিচ্ছে। মানুষ বাঁধনছাড়া হতে চাইছে। খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে চাইছে। যার কারণেই দেখা যাচ্ছে, লকডাউন সামান্য শিথিল হলেই শয়ে শয়ে লোক রাস্তায় নেমে আসছে। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের পরোয়া করছে না।
লকডাউন মানা হচ্ছে না অনেক জায়গাতেই—খবরের শিরোনামে প্রায় প্রতিদিনই এই বিষয়ে নানা আর্টিকল ছাপা হচ্ছে। আমেরিকা, স্পেন, ইংল্যান্ডে পাব-রেস্তোরাঁগুলিতে ভিড় দেখা যাচ্ছে। মার্কিন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এপিডেমোলজিস্ট অ্যান্থনি ফৌজি সংবাদমাধ্যমের সামনে চিৎকার করে বলছেন সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন, লকডাউন মানছেই না মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গলা ফাটিয়ে বলছে, ভুল পথে হাঁটছে, ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে অনেক দেশ। যার ফল হতে পারে মারাত্মক। করোনা কালে এক ভয়ঙ্কর যুগের মুখোমুখি হয়েছে মানব সভ্যতা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই নিয়ম না মানার প্রবণতা? শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলার মধ্যেই কি আনন্দ? গবেষকরা বলছেন, সেটা অনেকাংশেই নয়। আসলে মানুষ মুক্তি চাইছে। সেই শুরুতে ভাইরাস নিয়ে যতটা ভয়, আতঙ্ক ছিল, তার রেশ কমেছে। অসুখ আর মৃত্যুর মাঝে থেকে মানুষ সেই পরিস্থিতির সঙ্গেও মানিয়ে নিয়েছে। বেপরোয়া ভাব চলে এসেছে। ঘরবন্দি জীবনে হাঁসফাঁস করার থেকে ভাল খোলা হাওয়ায় ভাইরাসের মুখোমুখি হওয়া—এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে অনেকেরই মনে। বিশেষত জেন এক্স ও জেন ওয়াই সংক্রমণের বিভীষিকার থেকেও নিজেদের স্বাধীনতাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। লকডাউনের বন্দি জীবন থেকে নিষ্কৃতী পাওয়ার এটা একটা নীরব প্রতিবাদ, সেখানে ভাইরাসের মহামারী তুচ্ছ হয়ে গেছে।
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...
উদ্বেগ আর অবসাদের জন্ম হচ্ছে এখান থেকেই। সব বাঁধন ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার এই আকাঙ্খা। মনে যখনই খেয়াল আসবে, আমি বন্দি, বাকিদের থেকে আলাদা-বিচ্ছিন্ন, চাইলেই কাওকে আঁকড়ে ধরতে পারব না, তখনই উদ্বিগ্ন হবে মন। একাকীত্ব গ্রাস করতে থাকবে। যার থেকেই তৈরি হবে অবসাদ। হয় সব নিয়ম ভেঙে মানুষ নিজের মর্জি মতো চলতে থাকবে, নয়তো অসহিষ্ণু মনে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ছোট পরিবারগুলোর বিপদ আরও। সারাদিন মুখোমুখি থেকে ক্লান্ত মন। যে কারণেই বিরক্তিভাব বাড়ছে। মেজাজ হারাচ্ছে মানুষ। গার্হস্থ্য হিংসা বাড়ছে, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ বাড়ছে। বাড়িতেই মহিলা ও শিশুরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। এমনকি সাইবার অপরাধের সংখ্যাও বাড়ছে।
লন্ডনে সম্প্রতি দেখা গেছে, লকডাউন শিথিল হওয়ার দিনেই পাব-রেস্তোরাঁগুলিতে ঠাসাঠাসি ভিড়। শপিং মলে উপচে পড়েছে ভিড়। স্পেনের সমুদ্র সৈকতে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং না মেনেই ভিড় করছেন লোকজন। একই ছবি দেখা গেছে ভারতেও। দোকানে, বাজারে সুযোগ পেলেই গাদাগাদি ভিড়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাস্ক বা স্যানিটাইজারের সুরক্ষা নেই। থুতনির নীচে মাস্ক নামিয়ে দরদাম করে বাজার করছেন লোকজন, ঠিক যেমন আগে করতেন। আসলে মানুষ ‘ওল্ড নর্মাল’-এ ফিরে যেতে চাইছে। যে জীবনে তারা একসময় অভ্যস্ত ছিল। ‘নিউ নর্মাল’ মেনে চলার মতো মানসিক দৃঢ়তা তৈরি হয়নি সমাজের একটা বড় অংশেরই।
রূপ বদলাচ্ছে ভাইরাস! তাতে বয়েই গেল
সাহস ফিরে এসেছে মানুষের মনে। অথবা জোর করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ভাইরাস আর কী করবে! যা হওয়ার তাই হবে ! এমন একটা ধারণা বাসা বেঁধেছে অনেকেরই মনে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিবার মানুষের শরীরে ঢোকার পরে জিনের গঠন বদলে ফেলছে ভাইরাস। ফলে প্রতিটি নতুন ভাইরাল স্ট্রেন হয়ে উঠছে আরও সংক্রামক। বেশি সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করার উপায় খুঁজে নিচ্ছে। তাই মেলামেশায় লাগাম টানতে হবে, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং বাড়াতে হবে।
এই ভাইরাস যে আর পাঁচটা সাধারণ ভাইরাসের মতো নয়, সেটা বুঝতেই পারছে না মানুষ। অথবা বুঝেও গুরুত্ব দিতে চাইছে না। তার কারণ সেই অবসাদ। কোথাও একটা আতঙ্ক বাসা বেঁধে রয়েছে মনে যাকে আড়াল করার জন্যই এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে চাইছে মন। চোখে দেখা যায় না যাদের, তাদেরকে ভয় পেতে হবে নৈব নৈব চ! কানাডার বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা সম্প্রতি সামনে এসেছে। দেখা গেছে, করোনাকে ভয় পাওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমছে। আগে যেখানে ১০০ জনের মধ্যে ৭৩ জনই ভাইরাসের সংক্রমণকে ভয় পেয়ে নিজেদের ঘরবন্দি করে ফেলেছিলেন, এখন সেই সংখ্যা ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আবার অন্যদিকে দেখা গেছে, আগে ১০০ জনের মধ্যে ৫৬ জন মনে করতেন জনবহুল জায়গায় গেলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। অতএব সতর্ক হওয়া উচিত। এখন ৩৬ জনও মনে করেন না যে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে দ্রুত সংক্রামিত হতে পারে। সেই ভয়টাই উধাও হয়েছে মানুষের মন থেকে।
মানসিক চাপে হরমোনের বৈষম্য, স্ট্রেস থেকে কমছে রোগ প্রতিরোধ
একদিকে যেমন মুক্তির জন্য মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে মানসিক চাপও বাড়ছে সমাজের এক অংশের মধ্যে। লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অনেকে, বাড়ি বসে ‘ওয়ার্ক ফর্ম হোম’ কালচারের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও সময় লাগছে, তার উপরে মেলামেশা বন্ধ—সবমিলিয়ে স্ট্রেস বাড়ছে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের কর্টিসল হরমোন। অধিক উদ্বেগ ও আতঙ্কে এই হরমোনের ক্ষরণে সামঞ্জস্য থাকছে না। ফলে মানসিক চাপ দ্বিগুণ হচ্ছে। হরমোনের বৈষম্যে শরীরে রোগ প্রতিরোধে বড় ধাক্কা লাগছে। স্নায়ু দুর্বল হচ্ছে, পেশীর শক্তি কমছে। নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধছে। ‘স্লিপিং ডিসঅর্ডার’ ইনসোমনিয়ায় ভুগছে মানুষ। আরও একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে সেটা হল, এই স্বাস্থ্য সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে শর্টকাট রাস্তা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বেশিরভাগই। মাস্ক পরা বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা অথবা সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে চলার বদলে চটজলদি রোগ প্রতিরোধক ওষুধ খেয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছেন অনেকে। দেখা গেছে, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দিকে ঝোঁক বেড়েছে লকডাউনের এই সময়। অনেকেই নিয়ম না মেনে ওষুধ খেয়ে বিপদ ডেকে এনেছেন। সেই কারণে মৃত্যুও হয়েছে।
ভাল থাক মন, দাওয়াই আছে মানুষের হাতেই
শরীরকে চাঙ্গা রাখতে হলে এই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার বাধা পার হতে হবে। শরীরচর্চা করতে হবে নিয়মিত। মনকে শান্ত রাখতে যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়াম করতে হবে। খোলা হাওয়ায় বের হলে খেয়াল রাখতে হবে সুরক্ষার বিধি যেন মেনে চলা হয়। ওই সময় ভাইরাস নিয়ে চিন্তা নয়, বরং মন অন্য দিকে রাখলে ভাল হয়। প্রকৃতি, পরিবেশ থেকে আনন্দ নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
পুষ্টিকর খাবার এই সময় সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাড়িতে থাকার কারণে শরীরচর্চার ঝোঁক অনেকেরই কমেছে। তাই তেল-মশলাদার খাবারের বদলে হাল্কা খাওয়ার খাওয়াই ভাল। সবুজ শাক-সব্জি, ফল, মাছ খেতে হবে বেশি করে। প্যাকেটজাত খাবারের বদলে বাড়িতেই হাল্কা খাবার বানিয়ে নিলে ভাল। দীর্ঘ সময় পেট ফাঁকা রাখা চলবে না। অফিসের শিফট শুরু হওয়ার আগে ভাল করে পেট ভরে খেয়ে নিতে হবে। জল খেতে হবে সময়ান্তরে। আরও একটা বিষয় হল ঘুম। বাড়িতেই আছি মানে সোশ্যাল মিডিয়া, ল্যাপটপ, মোবাইলে ডুবে থাকা নয়। শরীরেরও বিশ্রামের সময় আছে। টানা ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম না হলেই উদ্বেগ বাড়বে। যার থেকেই হানা দেবে মানসিক চাপ ও শেষে অবসাদ।