Latest News

কলিযুগের সহজ পথ নাম-কীর্তন

স্বামী অলোকেশানন্দ

বর্তমানে  সৎ বুদ্ধি, সৎ আচরণ, ধৈর্য, দয়া, ক্ষমা, বিনয়, শ্রদ্ধা ইত্যাদি সদ্‌গুণাবলী মানুষের মধ্যে হ্রাস পাচ্ছে যার ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষ অমানবিক আচরণ করছে  

বর্তমানে কলিযুগ প্রবাহিত, মানুষ মানুষকে প্রতারিত করছে তাই সমাজে দেখা যায় পশুপাখীর পচা মাংস ভাগাড় থেকে তাজা হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।মানুষের মৃত্যু হবার পর ফ্রিজের মধ্যে মৃত মানুষকে ঢুকিয়ে রাখছে ।যারা অর্থবান তারা সব বিষয়ে সমাজে গুরুত্ত্ব পাচ্ছেন সন্তান মা-বাবার প্রতি ও মা-বাবা সন্তানদের প্রতি হেনস্থা করে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন । অসত্যের প্রভাব এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, আইন- আদালত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঠিক রায় দিতে পারছে না যার অর্থ নেই সে ন্যায় বিচার হারাচ্ছে ব্রাহ্মণ উপবিত ধারণ করেও মিথ্যা বাক্য বিনিময় করছে মাতা ও পিতার অপেক্ষা না করে পাত্র – পাত্রী উভয়েই চুক্তির মাধ্যমে নিজেরা কোনওরকম প্রথা না মেনে বিবাহ করে নিচ্ছেন   গেরুয়া কাপড় গায়ে কমন্ডলু  হাতে দণ্ডচারী সন্ন্যাসী হলেও আচার –আচরণে সাধুর পরিচয় পাওয়া যায় না। মন ও মুখ এক নয়, অথচ কপটতার আশ্রয় নিয়ে সাধুর পরিচয় দিচ্ছে এছাড়াও শাস্ত্র জ্ঞান না থাকলেও চতুরতার সঙ্গে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করছেন  বিভিন্ন তীর্থস্থানের জলাশয় বা নদীগুলি, যে কোন কারণ বশতঃ নোংরা হলেও তাতেই স্নান করে পবিত্রতা রক্ষা করছেন  বিভিন্ন অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অন্তরে গরল, মুখে মধুর হাসি এসব ধরনের মানুষেরা সমাজের শাসন ব্যবস্থায় স্থান পাচ্ছেএসব যা ঘটনা ঘটছে ভবিষ্যৎ এ মানুষ  ঘরে বাইরে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে কি  না ভেবে এখনি শিহরিত হচ্ছি । সমাজের মধ্যে একটি ঘটনা ঘটলে ভুল না ঠিক সেটা নিয়ে বিতর্ক ও কলহ লেগে যাচ্ছে । এক কথায় সুস্থ জীবন – যাপনের  ব্যাঘাত ঘটছে      

 এরূপ পরিস্থিতিতে মানুষ,  জীবনের উদ্দেশ্য কী, তা ভুলে গিয়েছেনপরবর্তী প্রজন্ম কোন দিকে প্রবাহিত হতে যাচ্ছে,  তা আন্তরিক ভাবে ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়

শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলতেন –“মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ”    

এই যুগে যারা আন্তরিকতার সঙ্গে এই বিষয়ে চিন্তা করেন তাদের সংখ্যা খুব সীমিত কোলকাতার  লোকেদের ছোটাছুটি দেখে শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন সকলের পেটের দিকে মন। অধিকাংশ মানুষ টাকার পিছনে ছুটছে । সে পথ ভালো হোক  আর মন্দই হোক। সময় কারও নেই ঈশ্বর চিন্তার জন্য ।    

“আমি সকল কাজের পাই হে সময়, তোমারে ডাকিতে চাহিনে…”।।

শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলতেন – “মানুষ হাঁড়ি, ঘটি, বাটির জন্য কাঁদে, ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদে বলো !”

লোকসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে , সেই ভাবে কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বেকার সমস্যা বাড়ছে, তাদের অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে সামান্য বিষয়ে মনোমালিন্য, বিষয়- আশয়, সম্পত্তি, টাকা-পয়সা নিয়ে কেবল ঝগড়া  এছাড়াও বিভিন্ন ধর্ম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিবাদ চলছে , একটি সংস্থা যদি বলে অমুক প্রতিষ্ঠান – শিব জ্ঞানে জীব সেবা বলে মুরগীর ঠ্যাং খায়, তখন অন্য দল বলে – জীবে দয়া, জীব হত্যা মহা পাপের কথা বলে, তারাই নিরীহ প্রাণী, কথা বলতে পারে না ‘উদ্ভিদ’কে মেরে-কেটে ভক্ষণ করে তাদের যে প্রাণ আছে তারা ভুলে যায়      

অপর দল বলে – উদ্ভিদ  খাও আর প্রাণী মেরে খাও, মনের মধ্যে যদি কোনও ক্রিয়া (হিংসা) না করে তবে খাও, আর যদি মনে কিছু ক্রিয়া করে খাবে না আবার কেউ বলেন  ঢং ঢাং বাদ দাও বাপু ,  কারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা যদি দেখেন , দেখবেন যে বায়ুমণ্ডলের অসংখ্য জীব আমাদের নিঃশ্বাস-  প্রশ্বাসের সঙ্গে মারা যাছে তখন হিংসা হয় না ? এ যেন কলি কালের গৃহ যুদ্ধ

শ্রীমদ্ভাগবতের (১/১/১০) শ্লোকে অনেক কাল আগেই বলা আছে –

প্রায়েণল্পায়ুষঃ সভ্য কলাবস্মিন্‌ যুগে জনাঃ

মন্দাঃ সুমন্দ মতয়ো মন্দভাগ্য হ্যুপদ্রুতঃ ।।

এই কলিযুগে মানুষেরা সকলেই অল্পায়ু উৎসাহ শূন্য অর্থাৎ অলস, মন্দ বুদ্ধি (যে কোনও বিষয় মেনে না নেওয়া অর্থাৎ কলহ করা), ক্ষীণ পূণ্য (সৎ কাজ করার ইচ্ছা নেই) এবং সর্বোপরি বিভিন্ন রোগের দ্বারা আক্রান্ত  

তাই মনে হয়, শ্রী রামকৃষ্ণদেব  ঠিক সময় এসে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, বললেন – “তাঁর নাম সর্বদাই করতে হয় কলিতে নাম মাহাত্ম্য অন্নগত প্রাণ, তাই যোগ হয় না”  

বলছেন জীবে দয়া করার তুই কে রে শালা, শিব জ্ঞানে জীব সেবা কারণ চৈতন্য দেব এসে ‘নাম’ করতে ও ‘জীবে’ সেবার কথা বলেছেন  পাছে লোকে ভুল বোঝে তাই শ্রী রামকৃষ্ণদেব শিব জ্ঞানে জীবকে  সেবার কথা বললেন এই কথা বলে চৈতন্য মহাপ্রভুর মাহাত্ম্য আরো বাড়িয়ে তুললেন,  চৈতন্য মহাপ্রভু সব ঘরে ঘরে গিয়ে ‘হরি’ নাম বিলিয়েছেন কিন্তু শ্রী রামকৃষ্ণদেব নিজে ঘরে ঘরে গিয়ে  সেই ভাবে ঈশ্বরের নাম ছড়াতে না পারলেও , চৈতন্য মহাপ্রভু যে কৃষ্ণ নাম জগৎ কে উদ্ধার করার জন্য দিলেন , এই যুগের লোকেরা ভুল করে ভেবে না বসে যে ‘কৃষ্ণ’ নাম ছাড়া ঈশ্বর লাভ হবে না  

এক কালে রাম , এক কালে  কৃষ্ণ, এযুগে রামকৃষ্ণদেব এক-ই ব্যক্তি কামারপুকুরে ভানু পিসি কে গদাধর রূপে দর্শন, মথুরবাবুকে শিব ও কালী রূপে দর্শন , গোপালের মাকে গোপাল রূপে দর্শন দিয়েছেন তা ছাড়া নিজে সাকার ও নিরাকারের সকল পথ দিয়ে ঈশ্বরের দর্শন করে “যত মত তত পথ” এর বাণী জগতে যুগের প্রয়োজনে রেখে গেলেন  এছাড়াও যে যেই ভাবে ঈশ্বরের নাম করে থাকুন সব পথকেই সঠিক বলে চিহ্নিত করে গেলেন  শিব ,কৃষ্ণ,আল্‌লাহ, গড,  কালী এবং জ্ঞানীদের পথও সত্য  জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল পথ দিয়ে ভগবানকে পাওয়া যায় তবে আন্তরিক  হওয়া চাই

কথামৃতের পাতায় পাতায় দেখা যায় শ্রী রামকৃষ্ণদেব একটু ঈশ্বরের প্রসঙ্গ করতে করতে মাঝে মধ্যেই বলতেন একটু তাঁর নাম শোনাও তো কখনো বলতেন হরিনাম করতে, কখনো বলতেন মা’র গান শোনাও তো কোন গায়ক এলে বলতেন

একটা কীর্তন শোনাও ওই সব গান শুনতে শুনতে ঠাকুর বাহ্য জ্ঞান হারাতেন  কোন ঐশ্বরিক নাম কে কখনো ছোট করেন নি বলতেন নাম ও নামী এক আবার বলতেন গানে মন শান্ত হয়  

কীর্তন হলে বলতেন নাচ, কেউ লজ্জায় না নাচলে বলতেন – লজ্জা, ঘৃণা, ভয়  তিন থাকতে নয় নিজেও নেচে নেচে এমন ভাবস্থ হয়ে পড়তেন যে অধিকাংশ দিন কীর্তনের সময় গায়ে কাপড় থাকতো না যে কোন ঈশ্বরের গানেই তিনি বাহ্যজ্ঞান হারাতেন ।  

আসলে এসব এযুগের মানুষের জন্য দেখিয়ে গেলেন  

কে কোথায় পড়ে আছেন ? এসব ভগবান  দেখেন না শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলতেন – যার মন তাঁতে (ঈশ্বরে) থাকে সেই ভক্ত সেই সাধু    

অনেক জায়গায় দেখি ভালো ব্যান্ড দিয়ে ‘হরিনাম ’ করছেন বিভিন্ন শুরে, এতে আমার মত আছে, প্রথম প্রথম এসে তার নামে নাচ ও গান করুক , শরীর সুস্থ হোক, পরে হরি প্রেমের আস্বাদ পেলে আর ঐ নাম ছাড়বে না কারণ এই যুগে মানুষের মন ঈশ্বরের দিকে দেওয়া খুব কঠিন, শুধু এই যুগে নয় , চৈতন্যদেবের সময় লোকে প্রথম প্রথম মেনে নিতেন না ধীরে ধীরে ঈশ্বর নামের আস্বাদ পেলে আর যেতে চাইতেন না এই বিষয়ে শ্রী রামকৃষ্ণদেবের একটি কথা মনে পড়ে –   

“ সংসারী লোকদের যদি বল যে সব ত্যাগ করে ঈশ্বরের পাদপদ্মে মগ্ন হও, তা তারা কখনও শুনবে না তাই বিষয়ী লোকদের টানবার জন্য গৌর-নিতাই দুই ভাই মিলে পরামর্শ করে এই ব্যবস্থা করেছিলেন – ‘মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী মেয়ের কোল, বোল হরি বোল ’ প্রথম দুইটির লোভে অনেকে হরিবোল বলতে যেত হরিনাম – সুধার একটু আস্বাদ পেলে বুঝতে পারত যে , ‘মাগুর মাছের ঝোল’ আর কিছুই নয়, হরিপ্রেমে যে অশ্রু পড়ে তাই ; ‘যুবতী মেয়ে কিনা ’ – পৃথিবী ‘যুবতী মেয়ের কোল কিনা’ – ধুলায় হরি প্রেমের গড়াগড়ি ”    

কলি যুগে নাম মাহাত্ম্য বা ভক্তিযোগের কথা  বলে সত্য যুগ শুরু করে দিয়ে গেলেন শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন  যদি কেউ ১২ বছর এই যুগে সত্য কথা বলেন তাঁর সব হয়ে  যাবে সত্য কথা কলির তপস্যা

“অনন্ত পথ ,তার মধ্যে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি- যে পথ দিয়ে যাও, আন্তরিক হলে ঈশ্বরকে পাবে …… ঈশ্বরের নাম-গুণকীর্তন এই সব করে সর্বদা তাঁতে মন রাখা কলিযুগের পক্ষে ভক্তিযোগ সহজ পথ ভক্তি যোগই যুগ ধর্ম”

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কথা মত , মনের গতির মোর  ধর্মের দিকে ফেরাতে হবে কারন বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ জীবন যাপন দিতে   কলি যুগের সহজ পথ নাম কীর্তন সর্বদাই যে কোন ভগবানের নাম-গুনগান করাই  এ যুগের সহজ পথ ।

সত্য যুগের প্রারম্ভে শ্রী রামকৃষ্ণদেবের নাম মাহাত্ম্য স্মরণ করে বলি –  

রামকৃষ্ণ শরণম্‌, রামকৃষ্ণ শরণম্‌, রামকৃষ্ণ শরণম্‌ শরণ্যে ……

You might also like