শেষ আপডেট: 4th February 2023 09:57
'কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন'… দীপাবলির দিন গান বাজে দিকে দিকে। নারীশক্তির প্রতীক মা কালীর আরাধনায় মেতে ওঠে বাঙালিরা। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে জয়গান গাওয়া হয় মায়ের। কিন্তু রক্তমাংসের মেয়ে বা মায়েরা অনেক সময়েই ভুলে যান তাঁদের শক্তির কথা, যত্নের কথা। তাঁদের মনে করিয়ে দিতেই, প্রতি বছরের মতোই অক্টোবর জুড়ে চলছে স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস (Breast Cancer Awareness Month)। তাই এই মাসেই দেখে নেওয়া যাক, স্তন ক্যানসারের মতো একটা অসুখের সঙ্গে ভারতীয় নারীদের লড়াইটা ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে।
না, এ লড়াই কখনওই এক দিনের নয়, এক মাসের নয়। তবে একটি বিশেষ মাসকে যদি বেছে নেওয়া যায় এ নিয়ে আলোচনার জন্য, সচেতনতার জন্য, তবে তাতে কোনও ক্ষতি অন্তত নেই। সর্বোপরি, যে কোনও উপলক্ষে নারী অধিকারের কথা সামনে এলেই, তার পাশাপাশিই, নারীস্বাস্থ্যের কথা সামনে আসা কম জরুরি নয়। তাই অক্টোবর মাস হোক বা কালীপুজোর দিন-- আলোচনা সবসময় জরুরি। এমনটাই মনে করেন অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তী। স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাসে তিনি মুখোমুখি দ্য ওয়ালের।
ডাক্তারবাবু জানালেন, গ্লোবোকন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় স্তন ক্যানসার। পাশ্চাত্যের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এ দেশে অনেক কম বয়সে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন মহিলারা। ৩০-৪০ বছরের রোগী আকছার পাওয়া যাচ্ছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে এই বয়সটা গড়ে ৫০-৬০। শুধু তাই নয়, এ দেশের মহিলাদের স্তন ক্যানসারের বিষয়টি অনেক বেশি আগ্রাসী। দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি, মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া প্রতি দু'জন ভারতীয় নারীর মধ্যে মারাও যাচ্ছেন এক জন করে।
এই বিষয়ে কয়েকটি অতি জরুরি ও ভয় পাওয়ানো তথ্য তুলে ধরলেন ডক্টর চক্রবর্তী। প্রথমত, সারা বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি কমবয়সি মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন এই ভারতে। দ্বিতীয়ত, কুড়ির কোঠায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া মহিলার সংখ্যা বাড়ছে দেশে। তৃতীয়ত, প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীই ডাক্তারের কাছে এসে পৌঁছচ্ছেন স্টেজ থ্রি-তে পৌঁছে যাওয়ার পরে, ২৫ থেকে ২০ শতাংশ আসছেন স্টেজ ফোরে। অর্থাৎ তখন আর চিকিৎসার বিশেষ সুযোগই মেলে না।
পরিস্থিতি এতটাই খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়ার একটা মূল কারণ হল, সচেতনতার অভাব। ৭৫ শতাংশ মহিলাই অজ্ঞানতা ও অসচেতনতার কারণে এত দেরি করে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছন, যে তখন চিকিৎসায় অনেক দেরি হয়ে যায়। মূলত এই কারণেই এ দেশে স্তন ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
পরিসংখ্যান আবার বলছে, এ দেশে গ্রামীণ এলাকার তুলনায় শহরাঞ্চলে মহিলারা বেশি ভুগছেন স্তন ক্যানসারে। এর পিছনে যুক্তিও রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার অন্যতম মূল কারণ হল হরমোনাল ডিসব্যালেন্স। ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ বেশি হলে এই ঝুঁকি বাড়ে। এখন খারাপ লাইফস্টাইল, ওবেসিটি, তৈলাক্ত খাবার বেশি খাওয়া-- এগুলি সবই ইস্ট্রোজেনের আধিক্য বাড়াতে থাকে।
এছাড়াও এখন মহিলারা অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে, চাকরিতে সেটল করে তার পরে বিয়ে করছেন ও পরিবারের কথা ভাবছেন। অনেকে সন্তান ধারণ করছেন না, অনেকে সন্তানধারণ করলেও বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন না। কম বয়সে সন্তানধারণ করা, বুকের দুধ খাওয়ানো—এগুলো সবই ব্রেস্ট ক্যানসার প্রতিরোধী ফ্যাক্টর। ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ কমায় এসব অভ্যেস। যদিও এর কোনওটাই নিয়ম করে ঠিক করার বিষয় নয়, বিয়ের বয়স বা সন্তানধারণের বাধ্যতা বাইরে থেকে ঠিক করে দেওয়া যায় না, তবে স্তন ক্যানসারের যে মহামারী-সম বিস্তার হয়ে চলেছে দেশজুড়ে, সেই পরিস্থিতিতে এ বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন।
ডাক্তারবাবু তাই বলছেন, ক্যানসার এড়াতে সবার আগে মডিফাই করতে হবে লাইফস্টাইল। তৈলাক্ত, প্রসেস্ড খাবার, জাঙ্কফুড বন্ধ করতে হবে, মদ্যপানে পরিমিতি চাই। সময়মতো সন্তানধারণ ও বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো জরুরি। নিয়মিত শরীরচর্চাও করতে হবে।
শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে প্রতিটি মহিলার ক্ষেত্রেই জরুরি প্রতি মাসে ব্রেস্টের সেল্ফ এক্সামিনেশন করা। অর্থাৎ নিয়মিত, সময় করে এবং গুরুত্ব সহকারে নিজেদেরই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, স্তন উন্মুক্ত করে, পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনও টিউমার বা অস্বাভাবিকতা রয়েছে কিনা। কোনও সমস্যা বুঝলেই সংকোচ, জড়তা, ভয় সব দূর করে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, পরীক্ষা করাতে হবে। তথ্য বলছে, দশ জন মহিলার বুকের লাম্পের মধ্যে ন’জনের ক্ষেত্রেই ক্যানসার ধরা পড়ে না। এমনিই সাধারণ কোনও টিউমার পাওয়া যায়, যা অস্ত্রোপচারে বা ওষুধে সেরে যায়। কিন্তু যে একটি লাম্প ক্যানসার হয়ে ওঠে, সেই একটিকে সময়ে ধরতে পারা ও রুখতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিগত দু’দশকে বিশ্বজুড়ে ক্যানসার চিকিৎসারও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। একথা বলাই যায়, উন্নত রেডিয়েশন, সার্জারি, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে আজ স্তন ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। এমনকি স্টেজ ফোর ক্যানসারের রোগীকেও সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে বছরের পর বছর। কিনতু এর প্রথম ধাপই হল, যত দ্রুত সম্ভব অসুখ নির্ধারণ করে চিকিৎসা শুরু করা।
পিরিয়ড শেষ হওয়ার চার-পাঁচ দিন পরে এই পরীক্ষা করতে হবে। পিরিয়ড চলাকালীন করলে এমনিই কিছু অস্বাভাবিকতা ঠেকতে পারে, তবে তা ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তাই পিরিয়ডের লাস্ট ডেট নোট করে, তার চার-পাঁচ দিন পরে পরীক্ষা করুন। যাঁদের মেনোপজ হয়ে গেছে, তাঁরা মাসের নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে নিন স্ক্রিনিং করার জন্য।
প্রথমে সরাসরি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন, কলার বোনের ওপরে বা নীচে কোনও পরিবর্তন আছে কিনা। তার পরে দেখুন স্তনবৃন্ত দু’টি একই উচ্চতায় আছে কিনা, কোনও শিরা উপশিরা প্রকট হয়ে আছে কিনা তাও দেখুন। অস্বাভাবিক কোনও লালচে ভাব থাকলে সেটাও লক্ষ করুন। এর পরে ডান হাত দিয়ে বাঁ স্তন এবং বাঁ হাত দিয়ে ডান স্তনটি তুলে নীচের খাঁজটা পরীক্ষা করুন।
এর পরে হাত দুটি উপরে তুলুন। বগলের নীচে লক্ষ করুন ভাল করে। বগলের লিম্ফনোড সবার আগে আক্রান্ত হয়। কোনও ফোলা ভাব আছে কিনা লক্ষ করুন। কিছু পরিবর্তন দেখলে ডাক্তার দেখান।
এর পরে হাতের তালুতে তেলজাতীয় বা সাবানজাতীয় কিছু লাগিয়ে ভাল করে স্তনে হাতটা বোলাতে থাকুন। ফিল করুন কোনও মাংসপিণ্ড বা টিউমারজাতীয় কিছু বুঝছেন কিনা। বগল পর্যন্ত এভাবে হাত বুলিয়ে দেখুন। সব শেষে নিপলে আলতো করে চাপ দিয়ে দেখবেন, রস জাতীয় কিছু বেরোচ্ছে কিনা। অনেক সময়ে নিপলেই একমাত্র ব্রেস্ট ক্যানসারের লক্ষ্মণ দেখা যায়।
এখানে বিজ্ঞানের পাশাপাশি সমাজেরও ভূমিকা অসীম। কারণ সমাজে তৈরি করা লিঙ্গবৈষম্যই একজন নারীকে বাধ্য করে নিজের শারীরিক সমস্যা গোপন করতে। স্তনে কোনও অস্বাভাবিকতা অনুভব করলে আজও বহু ক্ষেত্রেই তা সংকোচে লুকিয়ে রাখতে হয় মা-বোনেদের। আজও বহু মেয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হন নিজের শারীরিক সমস্যা নিয়ে, বিশেষ করে গোপন কোনও অঙ্গের সমস্যা নিয়ে অন্যকে বিব্রত করতে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়, কেবল মহিলাদের নয়, ছেলেদেরও ব্রেস্ট ক্যানসার অবশ্যই হতে পারে। সংখ্যাটা মহিলাদের তুলনায় অনেক কম, ১১২৮ জন পুরুষের মধ্যে একজনের ব্রেস্ট ক্যানসার হতে পারে। তবে ভয়ের বিষয় হল, ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যানসার অনেক বেশি আগ্রাসী, ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক দ্রুত ছড়িয়েও পড়ে পুরুষদের ব্রেস্ট ক্যানসার। তাই কোনও পুরুষ যদি কোনও অস্বস্তি বোঝেন, তাহলে লজ্জা পাবেন না। ডাক্তার দেখান, চিকিৎসা করান।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির কথা মনে পড়ে? ২০১৩ সালে আমেরিকার লেনক্স হিল হাসপাতালে ম্যাস্টেক্টমি করিয়ে দু'টি স্তন বাদ দিয়ে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন এই হলিউড অভিনেত্রী। তিনি পারিবারিক ভাবে বহন করছিলেন ক্যানসারের জিন। তাই ঝুঁকি না নিয়ে, কোনও সম্ভাবনা না রেখে, অস্ত্রোপচার করিয়ে বাদ দেন নিজের দুটি স্তন।
এই ঘটনা সামনে আসার পরেই স্তন ক্যানসারের জেনেটিক টেস্টিং-এর প্রবণতা বেড়ে যায়। সক্কলে পরীক্ষা করাতে শুরু করেন। তবে এই অতি-সচেতনতার জেরে আগাম সার্জারি আদৌ উচিত কিনা, তা নিয়ে তর্কও রয়েছে। ভারতের মতো দেশে এত সহজে এই পরীক্ষা ও সার্জারির দোরগোড়া অবধি পৌঁছনোও সম্ভব নয় সমাজের সমস্ত শ্রেণির মহিলাদের। কিন্তু ন্যূনতম সচেতনতা তো পালন করাই যায়! তার সঙ্গে কিন্তু কোনও আপস নয়।
ডাক্তারবাবুর কথায়, 'স্তন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই কখনও একমুখী নয়। এক্ষেত্রে শুধু চিকিৎসার পাশেই জরুরি যথেষ্ট সামাজিক সচেতনতাও। এই অক্টোবর মাসকে নির্ধারণ করা হয়েছে স্তন ক্যানসার সচেতনতার জন্যই। আমরা সকলে অর্থাৎ রোগী, চিকিৎসক, পরিবার, সমাজ—সবাই মিলে যদি হাত ধরে লড়াই করি, ভারত একদিন স্তন ক্যানসার থেকে মুক্ত হবেই।'
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির পথে মেদিনীপুরের মৌসুমী, ব্রেস্ট সার্জারির বেনজির সাফল্য কলকাতায়