শেষ আপডেট: 28th March 2024 15:22
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'খাই খাই করো কেন এস বসো আহারে/ খাওয়াব আজব খাওয়া ভোজ কয় যাহারে'... বাঙালি বরাবরই 'চর্ব্য ও চোষ্য' খেয়ে বেঁচেছে। তাই গ্যা,-অম্বল-চোঁয়া ঢেঁকুরে ভোগান্তিও বেড়েছে। ঘরে ঘরে প্রেসার-সুগার-কোলেস্টেরল। কারও গেঁটে বাত, তো কারও কোষ্ঠকাঠিন্য। ওই যে বাবা-কাকারা বলতেন না, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়.. এই কথাটা যে হাড়ে হাড়ে সত্যি তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। ভোজনরসিক বাঙালিও ধীরে ধীরে খাদ্য-সচেতন হচ্ছে। পুষ্টিবিদরা বলছেন, ডায়েট চার্ট যদি মানতে হয় তাহলে 'ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য' খেলে ঠিক আছে। ভাজাভুজি, তেলমশলা, প্রাণীজ প্রোটিন বেশি খেলেই তা শরীরে গিয়ে খটামটি বাঁধাবে।
এখন তো ওজন কমানোর জন্য লো ক্যালরি ডায়েটের দিকে ঝুঁকছেন সকলে। সে মধ্যবিত্ত ঘরে গৃহবধূ হোক বা ফ্যাশনিস্তা সেলিব্রিটি-হরেক রকম ডায়েট নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছেন সকলে। প্রোটিন ডায়েট, ডিউক ডায়েট, ড্যাশ ডায়েট, টিএলসি ডায়েট, কিটো ডায়েট, ব্লাড টাইপ ডায়েট, ‘র’ ফুড ডায়েট, মেডিটেরিয়ান ডায়েট আরও কত কী! পুষ্টিবিদরা বলছেন, মিথের পিছনে আমরা সকলেই ছুটি। কিন্তু লো ক্যালরি ডায়েট ঠিক কাকে বলে? ঠিক কতটা ক্যালরি আমাদের প্রয়োজন প্রতি দিন? তা হলে জেনে রাখুন এর কোনও নির্দিষ্ট হিসেব নেই। বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে দৈনন্দিন ক্যালরির পরিমাণ। রোজ আমরা কী খাচ্ছি, কতটা খাচ্ছি, সেই খাবার থেকে শরীরে কতটা পুষ্টি উপাদান যাচ্ছে আর কতটা খারাপ জিনিস ঢুকছে, তার সঠিক পরিমাণ বের করে সুষম খাবারের তালিকা তৈরি করার নামই ডায়েট। কী খাচ্ছি, কখন খাচ্ছি, কতটা খাচ্ছি—এই তিনটে জিনিস বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে খাওয়া এমন হবে যাতে শরীরও ঠিক থাকবে আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এইসব নিয়ম যদি একসঙ্গে মানতে হয় তাহলে একটা ডায়েটের নামও উঠে আসে—ব্লু জ়োন ডায়েট (Blue Zone Diet)।
এমন ডায়েটের নাম অনেকের কাছেই নতুন। ব্লু জ়োন কোনও ডায়েটের নাম নয়, এমন একটা ভৌগোলিক এলাকা যেখানকার বাসিন্দারা একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে খাওয়াদাওয়া করেন। সেই খাওয়ার অভ্যাস এমনই যে তা মানুষের শরীরে সমস্ত অসুখবিসুখ সারিয়ে দেয়। ব্লু জ়োনের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই দীর্ঘজীবী, এদের রোগব্যাধি তেমন নেই। গত বছর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ‘লিভ টু হান্ড্রেড – সিক্রেট অব দ্য ব্লু জ়োনস’। তার পর থেকেই এই ব্লু জ়োন নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। বিশ্বের পাঁচটি জায়গা ব্লু জ়োনের মধ্যে পড়ে-- গ্রিসের ইকারিয়া, ক্যালিফর্নিয়ার লোমা লিন্ডা, কোস্টারিকার নিকোইয়া, জাপানের ওকিনাওয়া এবং ইতালির সার্ডিনিয়া। আর ব্লু জ়োনের বাসিন্দারা যে ধরনের ডায়েট প্যাটার্ন মানছেন তার নাম দেওয়া হয়েছে ব্লু জ়োন ডায়েট।
এই পাঁচ জায়গার বাসিন্দারা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে খুব সচেতন। শোনা যায়, এই ব্লু জ়োনর বাসিন্দারা দীর্ঘজীবী। তাঁদের অসুখবিসুখ তেমন করে না। ১০০ বছর বা তার বেশি বেঁচেছেন এমন মানুষের সংখ্যা এখানে বেশি। ব্লু জ়োনের লোকজনেরা শাকসবজি, ফলমূল, দানাশস্য বেশি খান। ব্লু জ়োন প্যাটার্নে আমিষের ব্যবহার কম। অর্থাৎ এখানকার বাসিন্দারা মাছ, মাংস, ডিম কম খান। বদলে নানা ধরনের শস্য, শাকসবজি, মরসুমি ফল, বাদাম, সিডস এইসবই খাওয়া হয়। সবজি কাঁচা, সেদ্ধ বা হাল্কা রান্না করে খাওয়া হয়। তেল, মশলার প্রয়োগ কম। রান্নায় অলিভ অয়েলের চল বেশি। চিনি, প্যাকেটজাত, প্রক্রিয়াজাত যে কোনও খাবার, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলেন এই ব্লু জ়োনের বাসিন্দারা। নানারকম ভেজিটেবল ও ফ্রুট স্যালাড, সবজি সিদ্ধ, স্যুপ, দানাশস্য দিয়ে রান্না খাবারই বেশি খাওয়া হয়। প্রতিদিনের ডায়েটে থাকে প্রচুর পরিমাণ সবুজ সবজি ও ফল। সঠিক ডায়েট, শরীরচর্চা, মানুষের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক, স্পিরিচ্যুয়াল লার্নিংই এখানকার মানুষজনের বেশিদিন সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার কারণ।
এই ব্লু জ়োনের মানুষেরা জীবনধারণ সম্পর্কে ভীষণ সচেতন। শোনা যায়, এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং হৃদরোগের ঘটনা নেই বললেই চলে। কোভিডের পর পুষ্টিবিদেরাও জোর দিচ্ছেন এই ডায়েটের উপর।
ব্লু জ়োনের বাসিন্দারা পলিফেনল (এক ধরনের বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ) সমৃদ্ধ শাক-সবজি, বাদাম, বীজ বেশি করে খান। ইতালির সার্ডিনিয়ার বাসিন্দারা এক ধরনের রেড ওয়াইন পান করেন, যার নাম ক্যানোনাউ। তার সঙ্গে বার্লির তৈরি ডাম্পলিং, বিনস ও টমেটো দিয়ে তৈরি মাছ খেয়ে থাকেন।
গ্রিসের ইকারিয়ার লোকজনেরা শীতের মরশুমে বিটরুটের তৈরি স্যালাড খান।
ক্যালিফর্নিয়ার লোমা লিন্ডার মানুষেরা মৌরি ও কমলালেবুর স্যালাডের সঙ্গে ব্ল্যাক সি ব্যস খান। এটা এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ।
ডায়েট প্লানে ব্রাউন রাইস খুব জনপ্রিয়, আর থাকে ওটমি, কিনোয়া, নানা রকম বাদাম। দিনে অন্তত পাঁচটি করে ফল খাবেনই এখানকার বাসিন্দারা।
প্রতিদিন শরীরচর্চা এখানে মাস্ট। তবে শরীরচর্চা মানে জিম নয়, ব্লু জ়োনের বাসিন্দারা জোর দেন যোগব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি, দৌড়নো, সাঁতার, জগিং, ঘরের কাজ, বাগান করা ইত্যাদির উপর।
‘৮০% রুল’ মানেন এখানকার বাসিন্দারা। অর্থাৎ কখনওই পেট ঠেসে খাওয়া হয় না। পেট ৮০শতাংশ ভরে গেলেই খাওয়া বন্ধ, ২০শতাংশ পেট ফাঁকা রেখে খান এখানকার মানুষজনেরা।
'খাই খাই' করতে করতে আমরা ভুলেই যাই পাকস্থলীর একটা ধারণ ক্ষমতা আছে। লিভারেরও একটা হজম শক্তি আছে। সেইসব ছাপিয়ে গেলেই শরীরে হাজারটা রোগ বাসা বাঁধে। বদহজম, অম্বল-বুক জ্বালা, গ্যাস, ফ্যাটি লিভার, কিডনির রোগ, হার্টের রোগ, হাই কোলেস্টেরল ইত্যাদি তালিকাটা লম্বা। ডায়েট আমাদের সেই সীমাটাই বলে দেয়, কতটা খেতে হবে, কখন খেতে হবে এবং কী পরিমাণে খেতে হবে।
ডায়েট মানে হল ব্যালান্সড চার্ট। মানে যার শরীরে যতটা সয়, তাকে ঠিক ততটাই খাবার দেওয়া। আর খাবার দিলেই হল না, তাতে পুষ্টি উপাদান কতটা আছে সেটাও যাচাই করা দরকার। ডায়েট সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়। ব্লু জ়োনের বাসিন্দারা যেভাবে খান বা যা যা খান তা এখানে সবসময় মেনে চলা সম্ভব নয়। তাহলে ব্লু জ়োন ডায়েট মানবেন কীভাবে?
ব্লু জ়োন ডায়েটে থাকে মূলত ফাইবার সমৃদ্ধ, উদ্ভিদজাত খাবার। এ দেশে সহজলভ্য খাবারের মধ্যে তালিকায় রাখা যেতে পারে চাল, গম, মিলেট, বিভিন্ন ধরনের ডাল, বিভিন্ন রকম বীজ, বিনস ও বাদাম।
কার্বোহাইড্রেট খেতে হবে মেপে। একটা মাঝারি রুটি/এক পিস পাউরুটি/আধকাপ ভাত–ওট্স–পাস্তা৷ ব্রাউন রাইস খেলে সবচেয়ে ভাল। হোল হুইট পাস্তা, ব্রাউন ব্রেড, আটার রুটি খেলে ফাইবার ও পুষ্টি বেশি পাওয়া যাবে।
সবুজ শাকসব্জি বেশি করে খেতে হবে। ফলে প্রচুর ভিটামিন, ফাইবার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম থাকে৷ লাঞ্চের পরে ফল খেতেই হবে। ফ্রুট স্যালাড বানিয়ে খেতে পারেন। ফ্রুট জুস খান। তবে কেনা প্যাকেটজাত ফ্রুট জুস না খাওয়াই ভাল। দিনে অন্তত পাঁচ রকম ফল খেতে হবে।
রাতের খাবারে হোল গ্রেন শস্য যেমন বার্লি, ওটস ইত্যাদির সঙ্গে রাখতে পারেন সিদ্ধ আনাজ। স্যুপ বা ভেজিটেবল স্টু বানিয়ে খেতে পারেন।
চা খাওয়া কমিয়ে জল বেশি করে খেতে হবে। অ্যালকোহলের মাত্রা কমাতেই হবে।
চিনি, গুড়, মধু আর যে কোনওরকম মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
রান্নায় অলিভ অয়েল বা নারকেল তেল ব্যবহার করা ভাল। রান্নায় বেশি মশলা ব্যবহার করা যাবে না। মানে ঝালেঝোলে অম্বলে, কষিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়া যাবে না একেবারেই।
দুধ, দই, ছানা, চিজে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও প্রোটিন থাকে। দিনে এক কাপ কম চর্বির স্কিম মিল্ক, বা ছানা অথবা দই খেতে পারেন।
জলখাবারের পর এবং বিকেলের দিকে এমন কোনও স্ন্যাক্সের বন্দোবস্ত রাখুন যা পেট ভরায়, কিন্তু বাড়তি ক্যালোরির বোঝা চাপায় না। সম্ভব হলে পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে ডায়েট প্ল্যান তৈরি করুন। ঘুম থেকে ওঠার দু’ ঘণ্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট খান, রাতে শুতে যাওয়ার দু’ ঘণ্টা আগে খান ডিনার। সেই সঙ্গে শরীরচর্চা ও মেডিটেশন মাস্ট।