
এই বিপদকালে বন্ধ ছিল মন্দির-মসজিদ-গির্জা, খোলা ছিল শুধু হাসপাতাল: ডক্টর কৌশিক লাহিড়ী
দ্য ওয়াল: গত দেড় বছরের এই কোভিড পরিস্থিতি, কীভাবে দেখছেন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে?
ডক্টর লাহিড়ী: দেড় বছর আগেও আমরা সার্স কোভ ২ নামটা জানতাম না। করোনাভাইরাসের কথা হয়তো জানতাম, তার নানা সংক্রমণের কথাও জানতাম। কিন্তু কোভিড অসুখটা তখনও অচেনা-অজানা ছিল। গত বছরের জানুয়ারি মাসে যখন এ রোগ আমাদের দেশে এসে পৌঁছে থাবা বসাল, তখন আমরাও ধীরে ধীরে একে জানতে, চিনতে, বুঝতে, শিখতে শুরু করলাম। আর সাধারণ মানুষ শুরু করল আতঙ্কে ভুগতে। তাঁদের দোষ নেই। আমরাই যা জানি না, তাঁরা তো তা নিয়ে আতঙ্কিত হবেনই।
গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রায় লাখ খানেকে পৌঁছয় দৈনিক সংক্রমণ, যা ছিল প্রথম ঢেউয়ের সর্বোচ্চ চুড়ো। এই সময়টা যে কতটা ভয়ের ছিল, তা এখনও ভোলেননি কেউই। কিন্তু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এই পরিসংখ্যান ছারখার করে দেয়। ৯ মাসের রেকর্ড ভেঙে গেল ৯ সপ্তাহে। সুনামির মতো বাড়তে থাকল সংক্রমণ, মৃত্যু। এ বছরের ৬ মে আমরা চার লক্ষ ১৪ হাজার জৈনিক সংক্রমণ ছুঁয়ে ফেলি।
আমরা কেউ বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু এই কোভিড পরিস্থিতি একটা বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সারা পৃথিবী যেন এক হয়ে লড়ছে একটা অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে। চিকিৎসক, সাধারণ মানুষ, বিজ্ঞানী– সবাই একসঙ্গে লড়ছে। এ লড়াই অভূতপূর্ব।
তবে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, এটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহামারী নয়। এর আগেও অনেক মহামারীর সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী। তবে এটা সোশ্যাল মিডিয়া যুগের প্রথম মহামারী। তাই আমরা সকলেই যেন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের হাত ধরে কোভিড-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলাম। এর ফলে প্যানডেমিকের সঙ্গেই জন্ম নিল ইনফোডেমিক। প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় এবং অবৈজ্ঞানিক নানা তথ্যের ভিড়ে মানুষের হাঁসফাঁস দশা। প্রাথমিক ভাবে এটা ভয়ানক পরিস্থিতির জন্ম দেয়। যতটা অসুখের অভিঘাত, তার চেয়েও বেশি ছিল তথ্যের ভার ও আতঙ্ক। এই নিয়ে আমরা কার্যত ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিলাম। সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক, পরিচ্ছন্নতা– এ ছাড়া আমাদের করার মতো বা বলার মতো খুব কিছু ছিল না।
তার উপরে আমাদের সারা দেশের বাজেটের ১.২ শতাংশ মাত্র বরাদ্দ স্বাস্থ্যখাতে। ফলে আমাদের প্রিভেন্টিভ হেল্থ এমনিতেই বেশ দুর্বল। এর কারণে আমাদের প্রস্তুতিতে যথেষ্ট খামতি ছিল। অক্সিজেন, বেড, পরিকাঠামো– কিছুই নেই। একমো, ভেন্টিলেশন যেন দূরকল্পনা। কিন্তু সেই জায়গা থেকে আজ দেড় বছর পেরিয়ে আমরা অনেক পোক্ত ভূমির উপর দাঁড়িয়ে। আমাদের পরিকাঠামো অনেক উন্নত, আমাদের হাতে একাধিক ভ্যাকসিন আছে। আমরা লড়াইটা এখন আরও অনেক শক্তি নিয়ে করতে পারছি।
দ্য ওয়াল: এই কোভিডে বহুল ব্যবহৃত হয়েছে ‘টেলিমেডিসিন’। এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ডক্টর লাহিড়ী: টেলিমেডিসিন একটা যুগান্ত এনেছে। আমি একজন ডার্মাটোলজিস্ট হিসেবে বলতে পারি, এটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। গত বছর মার্চ মাসে যখন লকডাউন শুরু হয়েছিল, তখন থেকে টেলিমেডিসিন আইনত বৈধ ঘোষিত হয় ভারতে। এর ফলে যেটা হল, যে মানুষটি দূরত্বের কারণে বা যে কোনও কারণে কোনওদিনই কোনও বড় শহরে এসে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা করাতে পারতেন না, তিনিও বড় ডাক্তারের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন কয়েক ইঞ্চি স্ক্রিনের মারফত।
আবার উল্টোদিকে, এদেশে চিকিৎসকের সংখ্যাও তো অপ্রতুল! দেড় হাজার মানুষ-পিছু একজন করে ডাক্তার আছেন। সেখানে চিকিৎসক যদি বাড়িতে বসে একাধিক রোগীর কাছে পৌঁছে যেতে পারেন, তাতে পরিষেবার পরিধিও যেমন বড় হয়, তেমন অনেক কম সময়ে বেশি রোগীও উপকার পান।
আমি ডার্মাটোলজিস্ট হিসেবে বলছি, ত্বকের অসুখের খুব কম ক্ষেত্রেই বায়প্সি বা ডার্মাটোস্কোপির মতো আধুনিক পরীক্ষা দরকার হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা চোখে দেখেই রোগ নির্ণয় করতে ও চিকিৎসা করতে পারি। এটা একটা ভিসুয়াল সায়েন্স। ফলে একজন মানুষ গ্রামেগঞ্জে, মাঠেপ্রান্তরে, তাঁর নিজের পরিবেশে বসে চিকিৎসকের কনসালটেশন পাচ্ছেন, এটা একটা দারুণ ব্যাপার। আগেকার দিনে শোনা যেত ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়িতে করে রোগীর বাড়ি পৌঁছে যেতেন চিকিৎসক। এও যেন তেমনই, রোগীর বাড়ি পৌঁছে যাওয়া। কেবল ঘোড়া-গরুর বদলে আধুনিক প্রযুক্তি। এটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
দেখুন কী বলছেন ডাক্তারবাবু।
দ্য ওয়াল: অ্যালার্জি থাকলে কি ভ্যাকসিন নেওয়ার কোনও সমস্যা হতে পারে?
ডক্টর লাহিড়ী: প্রায় প্রতিদিন এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হই আমরা। ‘ডাক্তারবাবু, আমার অ্যালার্জি আছে, আমি কি ভ্যাকসিন নিতে পারব?’ এই প্রশ্নের উত্তরে আমি মজা করে এটাই বলি, আপনার অ্যালার্জি, চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি যাই থাকুক, সে সব সামলে নেওয়া যাবে। কিন্তু কোভিড তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা।
এই প্রসঙ্গে বলি, অ্যানাফাইল্যাক্সিস একটা জীবনঘাতী সমস্যা। এটা অনেক সময় নির্দিষ্ট কোনও ইঞ্জেকশন বা ওষুধ থেকে হতে পারে। কারও যদি এমন সমস্যা থাকে, ছোটবেলায় বা আগে ঘটে থাকে, তাহলে আমি বলব ছোট কোনও ক্যাম্পে বা পুরসভার শিবিরে ভ্যাকসিন না নিয়ে, কোনও হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন নিন। সেখানে গিয়ে মেডিক্যাল অফিসারকে বলুন, ছোটবেলায় একবার অ্যানাফাইল্যাক্সিস হয়েছিল। সেখানে যদি কোনও সমস্যা হয়, তাহলে রোগীকে বাঁচানোর উপায় থাকবে। তবে এই অসুখ অতি বিরল।
তাই সকলে ভ্যাকসিন নিন। বাড়ির বৃদ্ধ সদস্যদের নিয়ে যান ভ্যাকসিন দিতে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই ৩২ কোটি মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। একদিনে আমরা ৮৮ লক্ষ মানুষকেও ভ্যাকসিন দিতে পেরেছি। এটা অনেক বড় জয়। মনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিন দিয়েই পোলিও নির্মূল করা গেছে পৃথিবী থেকে, দূর করা গেছে গুটিবসন্তকে। তাই বিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখতে হবে। কোনও সমস্যা হলে ডাক্তারবাবুরা পাশে আছেন সামাল দেওয়ার জন্য। তাই সকলের কাছে অনুরোধ, ভ্যাকসিন নিন।
দ্য ওয়াল: ১ জুলাই ডক্টর্স ডে। এই দিবস উপলক্ষে যদি কোনও বিশেষ বার্তা দেন আমাদের পাঠকদের জন্য।
ডক্টর লাহিড়ী: এই দেড় বছরের কোভিড পর্বে সমস্ত মন্দির, মসজিদ, বাবাজি, সাধুসন্তদের দুয়ার বন্ধ ছিল। মানুষের সমস্যার সমাধানে খোলা ছিল একমাত্র হাসপাতালগুলি, কাজ করে গেছেন চিকিৎসকরাই। এই চিকিৎসকদের জন্যই কাঁসরঘণ্টা বাজানো হয়েছে, পুষ্পবৃষ্টি হয়েছে, আবার এই চিকিৎসকদেরই নানা রকম সামাজিক সমস্যায় ফেলা হয়েছে। কাউকে বাড়ি ফিরতে বাধা দেওয়া হয়েছে, স্টাফ স্পেশ্যাল ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়নি। এর মধ্যেই আমরা হাজার দেড়েক সহকর্মীকে হারিয়েছি। তাই আজকের দিনটা শুধু চিকিৎসক দিবস নয়, এটির নাম বদলে হয়েছে কোভিড শহিদ চিকিৎসক দিবস। অনুরোধ করব, চিকিৎসকদের গায়ে যেন কোনও পরিস্থিতিতেই হাত না পড়ে। এই কোভিড দুর্দিনে তাঁরাই মানবসভ্যতাকে রক্ষা করে চলেছেন।