
যৌনসুখে বিভোর থাক বার্ধক্যও, কামসূত্রের বর্ণনায় রতিক্রিয়ার আসল মানে বোঝাচ্ছেন সীমা
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শিব-পার্বতীর রতিক্রিয়ার কথা শুনলে কান চাপা দেবেন অনেক সংস্কারি, ধার্মিক মানুষ। অথচ পুরাণ থেকে হোক বা আধ্য়াত্মিক ব্যাখ্যায় কাম বা রতিক্রিয়া বা আধুনিক সময়ের সহজ ভাষায় বলা যৌনতা–সেই আদি ও অকৃত্রিম উৎস থেকেই আসছে। এখানে কোনও ছুঁৎমার্গ নেই, নাক সিঁটকানো লজ্জা বা গোপনীয়তা নেই। সৃষ্টির কারণকে স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়াতেই বেঁধেছিলেন মহর্ষি বাৎসায়ন। তাঁর ‘কামসূত্র’ কোনও মামুলি যৌনতা বিষয়ক গ্রন্থ নয়, নারী-পুরুষের কাম ও রতির সুস্থ-স্বাভাবিক জৈবিক ব্যাখ্যা। কামসূত্র তাই কাব্যের থেকে অনেক বেশি বিজ্ঞান। সেখানে নারী ও পুরুষের অধিকারও সমান সমান–যৌনতা বা সেক্সকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন মাইথোলজিস্ট তথা সেক্স এডুকেটর সীমা আনন্দ (Seema Anand)।

ফেসবুক, ইউটিউবে সীমার একাধিক ভিডিও দেখে ছি ছি করেন অনেকেই। ৬১ বছরের সীমা যেভাবে যৌনতাকে মেলে ধরেছেন তা অকপট ও সহজ। তাঁর ভিডিওকে যৌনগন্ধী, রগরগে মশলাদার ‘এক্স’ ভিডিওর তকমা দিলেও তা ধোপে টেকেনি। কারণ আড়ালে-আবডালে সেইসব কথা শুনেছেন ও বাস্তবের জীবনে তার মিলও পেয়েছেন অনেকেই। যৌনতায় গোপনীয়তা থাকে ঠিকই (কারণ মানুষ পশু নয়), কিন্তু যৌনতাকে অশ্লীলতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে ঘোর আপত্তি সীমার। তাঁর কথা শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই। যৌনতার নানা ধাপ বিশ্লেষণ করেছেন সীমা, একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। যৌনতাকে যেমন বয়সের গণ্ডিতে বেঁধে রাখেননি ৬১ বছরের সেক্স এডুকেটর, তেমনই যৌনতায় নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রসঙ্গও তুলেছেন তিনি (Seema Anand)।

কামসূত্রে যৌনতা বা বিশদে বললে রতিক্রিয়া বা সঙ্গমে নারী ও পুরুষকে তার বিশেষ বিশেষ জায়গায় রেখেছিলেন বাৎসায়ন। সীমা তাঁর বই The Arts of Seduction এ বলেছেন, যৌনতা শব্দটার সর্বাঙ্গে পুরুষের দাপটের চিহ্ন লেগে আছে। শব্দটির মূলে আছে যোনি শব্দটি। যা যোনি সম্বন্ধীয়, তা-ই যৌন। রতিক্রিয়ায় পুরুষ উপরে থাকবে না নারী–সেই নিয়েও পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা আছে। পুরুষই উপরে থাকতে স্বচ্ছন্দ বা তার পৌরষত্ব প্রদর্শনের উপায় মনে করে। কিন্তু কামসূত্র তা বলে না। রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন ‘পজিশন’ নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন বাৎসায়ন যেখানে নারীকেও ঊর্ধ্বেই রেখেছেন তিনি।

পুরাণ একে বলে বিপরীত রতিক্রিয়া, যেখানে পুরুষ নীচে ও নারী উপরে। বাৎসায়ন বলেছেন, নারী যখন উপরে তখন সে তার নিতম্বের সঞ্চালন করবে, নিতম্ব, কোমর, সারা শরীরে নারী এমন সব অলঙ্কার পরবে যা তার প্রতি পুরুষের আকর্ষণ বহুগুণে বাড়াবে। রতিক্রিয়ার সময় নারীর কোমরে বাঁধা অলঙ্কার থেকে কোনও রিনিরিনি শব্দ হবে না, শুধু তার কম্পন বোঝা যাবে। এর মানে হল, নারী জোর করে সঙ্গমে বাধ্য করেনি, বরং শরীরকে সেই স্পর্শ দিতে চেয়েছে যার স্বাদ পাওয়ার বাসনা রাখে কোনও পুরুষ। ইংরেজিতে সেক্স শব্দের মধ্যে কিন্তু কেবল স্ত্রীলিঙ্গের চিহ্ন লেগে নেই, সেক্স-এর একটা মানে হতে পারে ‘দ্য স্টেট অফ বিয়িং আইদার মেল অর ফিমেল’। অর্থাৎ তুমি স্ত্রী না পুরুষ। আর একটা মানে হতে পারে ‘সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটি ইনভল্ভিং দ্য পেনিস অর ভ্যাজাইনা’। এই বাসনার কাজে (activity) পুরুষ-নারী দুইই আছে। সীমা আনন্দ তাঁর বইয়ে এমনই ব্যাখ্যা করেছেন যৌনতার।

এখনকার সময় যৌনতার নাম নিতেই লজ্জা পান নারীরা। সীমা বলছেন, সমাজব্যবস্থায় যৌনতাকে রগরগে অশ্লীল কোনও বিষয়ের তকমা সেঁটে রাখা হয়েছে। অথচ সুপ্রাচীন কাল থেকে যৌনতাই ছিল খোলামেলা। সেখানে নারীকে স্বাধীনচেতাই বলা হয়েছে। নারী নিঃসঙ্কোচে যৌনতার কথা উচ্চারণ করতে পারে, নিজের যৌন বাসনার কথা জানাতে পারে। য়ৌন তৃপ্তির জন্য একজন পুরুষের কাছে নিজের বাসনা ব্যক্ত করতে পারে অকপটে। কারণ সেটা স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়া, এতে কোনও অপরাধ বা অশ্লীলতা নেই।
উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুর মা যখন স্বামীর অনুমতি না নিয়েই অন্য এক জন পুরুষের সহগামিনী হচ্ছেন তখন তিনি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। সেই সময় বিয়ে নামক কোনও বন্ধন ছিল না। বাবা উদ্দালক (জৈবিক পিতা নন) তাঁকে শান্ত করে বলেছিলেন: ‘‘তুমি রাগ কোরো না পুত্র, এটাই স্ত্রীলোকের চিরাচরিত ধর্ম, সে গাভীর মতো স্বাধীন। এই দেহের অধিকার তার। কাজেই অন্যগমন অন্যায় নয়।’’ প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব এ কথাও বলেছে, নারী স্বাধীন আর এই বিচরণ স্ত্রীলোকের প্রতি প্রকৃতির অনুগ্রহের সূচক। এখনকার সময় যা ভাবনাচিন্তারও অতীত।
সীমা বলছেন, যৌনতার একটি উদ্দেশ্য কখনও-সখনও সন্তান-উৎপাদন হতে পারে, কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। স্ত্রীলোক পশুদের থেকে আলাদা, কারণ সে সন্তানধারণের উপযুক্ত সময় ছাড়াও রমণে প্রবৃত্ত হয়। পুরুষের মতো নারীও আনন্দের জন্যই যৌনতা চায়। আর সেটা বয়সের সীমাতেও বাঁধা নয়। বৃদ্ধ বয়স মানেই যৌনতা অপরাধ সেটাও নয়। ‘বাধাই হো’ নীনা গুপ্তার অভিনীত ছবি সে ট্যাবুও ভেঙে দিয়েছে। ৬৫ পেরিয়ে যাওয়া কোনও প্রৌঢ় যদি পরম আশ্লেষে তাঁর ৬০ বছরের স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করে মিলন চায়, তাহলে তা অপরাধ নয়।
রতি মানে আসক্তি, তন্নিষ্ঠতা, প্রীতি, রাগ, অনুরাগ। রত আর রতি, দুই শব্দের মূলেই রম্ ধাতু। রত শব্দে তো নারী-পুরুষ উভয়ের ক্রিয়াকেই বোঝায়। রতিক্রিয়া উভয়ের ক্রিয়া। এ দিক থেকে যদি বলা হয়, মেয়েরাও তাঁদের রতিকথা বলবেন, রতির ইচ্ছে জানাবেন, এই চরম সত্যিটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন সীমা আনন্দ।