প্রতীকী ছবি
শেষ আপডেট: 22nd December 2024 17:07
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২০২৪ সালকে বিশ্বজুড়ে এক অস্থির এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। রাজনৈতিক পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে এ বছরটি ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনা মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তেজনা, নির্বাচনী উত্তাপ কিংবা বিশ্বনেতাদের প্রভাবশালী ভূমিকা— ২০২৪ ছিল সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি বছর। তার থেকেই বাছাই করে সেরা দশটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হল।
১. জাপানে ভূমিকম্প
২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি, যখন সারা বিশ্ব নববর্ষ উদযাপনের আনন্দে মেতে ছিল, তখন প্রকৃতির ভয়ংকর রূপ দেখল জাপান। রিখটার স্কেলে ৭.৬ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশটি। ভূমিকম্পের পরপরই আসে তীব্র সুনামি, যা জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। বছরের প্রথম দিনেই এমন মর্মান্তিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শোকের ছায়া নেমে আসে উদীয়মান সূর্যের দেশ জাপানে।
২. বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জয় এবং পতন
বছরের গোড়ায় জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কয়েক মাস পর থেকেই রাজনৈতিক দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং দমননীতির প্রতিবাদে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নামে, এবং সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। শেখ হাসিনা রাতারাতি দেশ ছেড়ে চলে যান, আশ্রয় নেন ভারতে। সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে বাংলাদেশ।
৩. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর
২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দু'বছর অতিক্রম করে:s। এই যুদ্ধে দুই দেশের সীমান্ত জুড়ে হিংস তীব্রতর হয়েছে। হাজার হাজার সেনার প্রাণহানি, সাধারণ মানুষের দুর্দশা এবং অস্ত্রের বিশাল অপচয় সারা বিশ্বে অশান্তির আঁচ ছড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চিমী দেশগুলো ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা করার ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, যুদ্ধের তীব্রতাও তত বেড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, জ্বালানি সংকট এবং খাদ্য সরবরাহেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই যুদ্ধ।
৪. ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যা: ৮০ বছরের রেকর্ড ভাঙা দুর্যোগ
২০২৪ সালের ৫ মে ব্রাজিলে প্রবল বর্ষণের কারণে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। প্রকৃতির এই রুদ্ররোষে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ রিও গ্র্যান্ডে ডো সুলে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান এবং প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। বন্যার তাণ্ডবে গ্রাম থেকে শহর—সবই তলিয়ে যায় জলে। পোর্তো আলেগ্রে ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর মধ্যে একটি। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ভেঙে পড়ে, উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৪৯৭টি শহর এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ৮০ বছরে এটি ব্রাজিলের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. লেবাননের পেজার বিস্ফোরণ
২০২৪ সালে লেবাননের রাজধানী বেইরুটে ঘটে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যা শহরের বিশাল অংশকে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। নানা প্রান্তে পেজার, মোবাইল, টেলিফোনে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এই ইজরায়েলি আক্রমণে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হন। এই দুর্ঘটনা লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং দেশটিতে মানবিক সংকটও চরমে ওঠে। পরদিন থেকেই লেবাননে সামরিক অভিযান শুরু করে ইজরায়েল। ২৭ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলি সেনার আক্রমণে হেজবোল্লার প্রধান হাসান নাসরাল্লা নিহত হন।
৬. ইরান-ইজরায়েল সংঘাত: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা
২০২৪ সালের ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে এক ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় অন্তত ১৩ জন প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে ছিলেন তিনজন ইরানি সেনাকর্তাও। ইরান সরাসরি এই হামলার জন্য ইজরায়েলকে দায়ী করে এবং পালটা হুঁশিয়ারি দেয়। তীব্র উত্তেজনার মধ্যে ১৩ এপ্রিল ইরান ইজরায়েলের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই প্রায় ৩০০টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে ইজরায়েলে। এর পরে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পালটা আক্রমণ চালায়। এই অভিযানে ইরানের একাধিক শহরে বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুই পক্ষের এই সংঘাত দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।
৭. সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পর ২০২৪ সালে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকার অবশেষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। দেশটির জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপ, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফলে আসাদ প্রশাসনের পতন ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে এটি একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানের আশার আলো জ্বলে ওঠে। তবে দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এখনও অনিশ্চিত।
৮. মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন
২০২৪ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিভাজন এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক বড় দৃষ্টান্ত। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন ইস্যু যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চরমে ওঠে। দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা হয়। নির্বাচনের ফলাফল মার্কিন রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শেষমেশ বিপুল জয়ে মসনদে ফিরেছেন ট্রাম্প। রাজনৈতিক বিভাজন এবং উত্তেজনার কারণে দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো নতুন প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
৯. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং চাকরি সংকট
২০২৪ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) দ্রুত উন্নতি বিশ্ব অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়াগুলোর কারণে প্রচুর চাকরি বিলুপ্ত হয়, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে কর্মহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। উৎপাদন, সেবা, এবং প্রযুক্তি খাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই সংকট আরও গভীর হবে। এর পাশাপাশি, এআই-এর ব্যবহার নিয়ে নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নও জোরালো হয়ে উঠেছে।
১০. গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলার রেকর্ড হার
২০২৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলার হার রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। গবেষকরা জানান, এই বরফ গলা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বন্যা এবং স্থানচ্যুতির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গোটা বিশ্বকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতেও এই ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে হবে ও কার্যকর পদক্ষেপ করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।