ভয়েজার মহাকাশযান, শিল্পীর কল্পনায়।
শেষ আপডেট: 23rd April 2024 18:03
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক হওয়া যায়? গানে গানে উত্তর খুঁজেছেন কবীর সুমন। দূরে যাওয়ার কি কোনও সীমা আছে? দূর বলতে আমাদের চৌহদ্দি এই নীল গ্রহ। অথচ মানুষের জ্ঞান, গবেষণা, বুদ্ধি ও চেষ্টায় মানুষের নাগাল গিয়েছে এমন প্রান্তে, যা সৌরজগতের গণ্ডিরও বাইরে!
পোশাকি নাম ভয়েজার-১। ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে স্থানীয় সময় দুপুর একটা নাগাদ টাইটান রকেটে চেপে রওনা দিয়েছিল নাসার এই মহাকাশযান। লক্ষ ছিল সৌরজগতের দূরতম গ্রহগুলোকে কাছ থেকে দেখা। এমন নিখুঁত অঙ্ক কষে পাঠানো হয়েছিল ভয়েজারকে, যাতে একইসঙ্গে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের গা ঘেঁষে উড়ে যেতে পারে। উড়ন্ত অবস্থাতেই স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরায় ছবি তুলে পাঠাবে সে, যা আদতে বিজ্ঞানীদের কাছে ওই গ্রহগুলিকে নিয়ে জানতে বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার হয়ে উঠবে।
সে কাজ সাফল্যের সঙ্গেই করেছিল ভয়েজার-১। কিন্তু তারপরেও তার যাত্রা থেমে থাকেনি। ঘন্টায় ৫৪০০০ কিলোমিটার বেগে সে উড়তে থাকে আরও দূরের দিকে। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে ৪৬ বছর। এই ৪৬ বছর ধরে সে এই গতিবেগে উড়েই চলেছে সৌরজগতের বাইরের দিকে। মহাকাশে কোনও বাহ্যিক বল নেই। ফলে নিউটনের প্রথম সূত্র বলছে, ভয়েজারের থামারও কোনও উপায় নেই।
এইভাবে যেতে যেতে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট ভয়েজার-১ সরকারিভাবে সৌরজগতের সীমা অতিক্রম করে চলে যায় এক অনন্ত মহাশূন্যে। তার ওপারে কী আছে, কেউ জানে না। মানবসৃষ্ট কোনও কিছু তার আগে অতদূরে যায়নি। ২০২৪ সালের আজকের হিসেবে, ভয়েজার রয়েছে পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ, প্রায় দুই হাজার চারশো কোটি কিলোমিটার! সেখান থেকে রেডিও বার্তা আসতে সময় লাগে প্রায় গোটা একটা দিন, সাড়ে বাইশ ঘণ্টা মত।
সম্প্রতি কয়েক মাস যাবত এই ভয়েজার-১ মহাকাশযানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল নাসার। ভয়েজারের কম্পিউটারের সঙ্গে মার্কিন ইঞ্জিনিয়াররা অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। ভাবা হচ্ছিল, সম্ভবত ভয়েজারের জীবনে ইতি ঘটতে চলেছে। কিন্তু সম্প্রতি নাসা জানিয়েছে, বহু চেষ্টার পরে ভয়েজারের কম্পিউটারের সেই যান্ত্রিক ত্রুটির উৎস খুঁজে বের করতে পেরেছেন ইঞ্জিনিয়াররা। সেই ক্ষতিগ্রস্থ 'চিপ'-এর কোড বদল করে আবার চেষ্টা করে দেখেছেন, পুনরায় তথ্য পাঠাতে শুরু করেছে ভয়েজার।
মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাফল্য একদিন ব্রহ্মাণ্ডের ওপারে চলে যাবে, এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন ভয়েজার প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত কিংবদন্তী বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান। তাই ভয়েজারের পে-লোডে তাঁর উদ্যোগে জোড়া হয়েছিল এক অদ্ভুত তথ্যভাণ্ডার। আজও ইতিহাস যাকে চেনে 'ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড' বলে। এই ফোনোগ্রাফ রেকর্ডে মানুষের সৃজনক্ষমতার কিছু নজির ভরে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ছিল ১১৬-টি ছবি এবং বিভিন্ন শব্দের রেকর্ড। যার মধ্যে ছিল পৃথিবীর বাছাই করা ৫৫-টি ভাষায় সম্ভাষণ। স্যাগান বলেছিলেন, যদি এই মহাকাশযান সুদূর ভবিষ্যতে কোনও ভিনগ্রহ ও অন্য নক্ষত্রের জগতে গিয়ে পৌছয় ও যাতে সত্যিই কোনও উন্নত জীবনযাত্রা থেকে থাকে, হয়ত এই রেকর্ড তাদের কাছে এলে তারা বুঝবে ব্রহ্মাণ্ডের অন্য প্রান্তে এরকম একটা নীল গ্রহ আছে, যার বাসিন্দারা এরকম সম্ভাষণ করে পাঠিয়েছে। সেই ৫৫ টি ভাষার মধ্যে আছে আমাদের বাংলাও। যাতে বলা, 'নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক।'